১৪ মে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বার্ষিক ১ হাজার ৬০২ মার্কিন ডলার। গত বছর এপ্রিলে জানানো হয়েছিল মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলার। বেশ দ্রুত হারেই বাড়ছে বাংলাদেশের জিডিপি/জিএনপি বা জাতীয় আয়, সেই সঙ্গে মাথাপিছু আয়। এর মধ্যে এই আয় কয়েক দফা বেড়েছে হিসাব-নিকাশের পদ্ধতিগত পরিবর্তনের কারণে।
ভারতের মাথাপিছু আয় ও জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার আর দারিদ্র্য বিমোচন হার ইত্যাদির পদ্ধতিগত বিষয় নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা অনেক প্রশ্ন তুলছেন, বিতর্ক হচ্ছে। ডেটার গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যেও এ সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হচ্ছে। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের তথ্য-উপাত্ত পরিসংখ্যান হিসাব-নিকাশ প্রবৃদ্ধির গতি-প্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ অনেক বেশি থাকলেও বাংলাদেশে এ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা বা বিতর্ক নেই। সরকারি ভাষ্যের সঙ্গে মেলে না এ রকম যুক্তি, তথ্য, প্রশ্ন আর বিতর্ক সরকার পছন্দ করে না বলে প্রায় সব অর্থনীতিবিদ, থিংক ট্যাংক, মিডিয়াও বিনা প্রশ্নে সব গ্রহণ করতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। জিডিপি উচ্ছ্বাসে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে অনেক জরুরি প্রশ্ন। বিনিয়োগের সঙ্গে জিডিপির পরিমাণগত বৃদ্ধির অনুপাতের স্বীকৃত হিসাবও মিলছে না।
যাহোক, কতটা এবং কীভাবে তা নিয়ে অনেক প্রশ্নের অবকাশ থাকলেও বাংলাদেশের জাতীয় আয় যে বেড়েছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কোনো দেশের অর্থনীতিকে জিডিপি/জিএনপি দিয়ে পরিমাপ করায় বিশ্বব্যাংক–আইএমএফই প্রধান পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করে। বিশ্বব্যাংকই সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করে থাকে। এগুলো হলো: (১) নিম্ন আয়ভুক্ত দেশ (মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত)। (২ক) নিম্ন মধ্যম আয়ভুক্ত দেশ (১ হাজার ২৬ মার্কিন ডলার থেকে ৪ হাজার ৩৫ ডলার)। (২খ) উচ্চ মধ্যম আয় (৪ হাজার ৩৬ মার্কিন ডলার থেকে ১২ হাজার ৪৭৫ ডলার)। (৩) উচ্চ আয়ভুক্ত দেশ (১২ হাজার ৪৭৬ মার্কিন ডলার থেকে বেশি)।
সে হিসাবে বাংলাদেশের বার্ষিক গড় মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২৫ ডলার অতিক্রম করায় দেশ ২০১৩ সাল থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ভারতের অর্থনীতির ভিত বাংলাদেশের চেয়ে শক্ত হলেও গতি-প্রকৃতিতে অভিন্নতা আছে। উদীয়মান পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভাবের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও ভারত এখনো বাংলাদেশের মতো নিম্ন মধ্যম আয়ভুক্ত দেশ। সেখানে মাথাপিছু আয় এখন প্রায় ১ হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার। এটি প্রকৃত চিত্র দেয় না, কারণ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রায় ৭০ শতাংশ ভারতীয় জনগণের আয় দৈনিক ১ দশমিক ২৫ মার্কিন ডলারেরও নিচে (বৈশ্বিকভাবে গৃহীত দারিদ্র্য সূচক) বা ১০০ রুপির নিচে, যদিও তাদের জাতীয় গড় মাথাপিছু আয় বছরে ১ লাখ রুপি বা দিনে ২৫৫ রুপি। দিল্লিতে মাথাপিছু আয় ভারতের গড় মাথাপিছু আয়ের তিন গুণ।
একটি দেশে জিডিপি বৃদ্ধি দ্রুতগতি লাভ করলেও টেকসই উন্নয়ন দুর্বল হতে পারে। মাথাপিছু আয় বেশি হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্ন হতে পারে। এ বিষয়ে অমর্ত্য সেন অনেক কাজ করেছেন। ভারতের ভেতরেই রাজ্য থেকে রাজ্য তফাত দেখিয়েছেন। আফ্রিকার বহু দেশে মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি, মধ্যম আয়ের বিবরণে তারা বাংলাদেশ থেকে অনেক আগে থেকেই এগিয়ে, কিন্তু সেখানে মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্ন। মিয়ানমারে মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের প্রায় সমান। নাইজেরিয়ার মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু তাদের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশের চেয়ে ভালো, এটা বলা যাবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং আরও খারাপ। সে জন্য মানব উন্নয়ন সূচকে নাইজেরিয়া বাংলাদেশেরও পেছনে।
সে জন্য মাথাপিছু আয় দিয়ে একটি দেশের আর্থিক লেনদেন বা বাণিজ্যিক উৎপাদন, বিতরণ, পরিষেবা খাতের বিস্তার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেলেও তা দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বোঝা যায় না। যে সমাজে বৈষম্য বেশি সেখানে গড় আয়ের হিসাব আরও বিভ্রান্তিকর। একটি পরিবার যদি ১০ লাখ টাকা আয় করে, পাশাপাশি অন্য একটি পরিবার যদি ১০ হাজার টাকা আয় করে তাহলে উভয় পরিবারের গড় আয় হবে ৫ লাখ ৫ হাজার টাকা। এতে কি দুই পরিবারের প্রকৃত অবস্থা বোঝা যায়? বর্তমান মাথাপিছু আয় হিসাবে আমাদের দেশে চার সদস্যের পরিবারের বার্ষিক গড় আয় হয় প্রায় ৬ দশমিক ৫ হাজার মার্কিন ডলার অর্থাৎ মাসে প্রায় ৫২ হাজার টাকা। তার মানে বাংলাদেশের সব নাগরিক, শিশু, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবারই মাথাপিছু আয় মাসে এখন প্রায় ১৩ হাজার টাকা। অথচ সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশের শতকরা ৮০টি পরিবারের গড় মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার নিচে।
সর্বশেষ সরকারি হিসাবে দেখা যায়, আয়ের দিক থেকে নিম্ন স্তরের ৭০ শতাংশ মানুষের হাতে মোট জাতীয় আয়ের মাত্র ৩৭ শতাংশ। উল্টোদিকে আয়ের দিক থেকে ওপরের স্তরের ২০ শতাংশ মানুষের হাতে ৪২ শতাংশ, ৫ শতাংশের হাতে ২৫ শতাংশ জাতীয় আয়। এই হিসাবে চোরাই টাকা ধরা হয়নি, যারা লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে, তাদের সম্পদের বড় অংশ এই হিসাবে নেই। তা ধরা হলে চিত্র আরও বৈষম্যমূলক হবে। একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে জিডিপি ফুলে ফেঁপে উঠলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অবস্থায় তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। সে জন্য পরিসংখ্যানে আমরা দেখছি, গত সাত বছরে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়েছে, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রশ্ন, আমার আয় কোথায় গেল? শিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত, বেকার, অর্ধবেকারদের প্রশ্ন আসতে পারে—আমার কাজ, আমার আয় কোথায়?
বস্তুত বাংলাদেশের জিডিপি এবং মাথাপিছু আয়ের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির পেছনে বড় অবদান হচ্ছে প্রবাসী আয়ের। এ ছাড়া আছে গার্মেন্টস ও কৃষি। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ভূমিকাও কম নয়। অথচ এসব ক্ষেত্রে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষের আয় এবং জীবনের নিরাপত্তা দুটিই ঝুঁকিপূর্ণ, অনিশ্চিত। চোরাই অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিমূলক তৎপরতায় জিডিপি বাড়ে কিন্তু সমাজের বড় একটা অংশের জীবন-জীবিকা বিপদগ্রস্ত হয়। দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও তার কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বড় দেখায়, জিডিপির অঙ্ক বাড়ে। নদী-নালা, খাল-বিল, বন দখল ও ধ্বংসের মাধ্যমেও জিডিপি বাড়তে পারে, শিক্ষা, চিকিৎসার
ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণেও জিডিপি বাড়ে। কিন্তু এসব তৎপরতা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন বিপন্ন করে, দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে।
পরিমাণগত দিক গুরুত্ব দিয়েই শুধু হিসাব করায় অনেক গুণগত দিক আড়াল করা সম্ভব। এটি করপোরেট শাসকগোষ্ঠী ও তাদের অর্থশাস্ত্রের জন্য সুবিধাজনক। জিডিপি/ জিএনআই এবং মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে উন্নয়ন পরিমাপ করা নিয়ে মূলধারার অর্থশাস্ত্রেও এখন তাই সংশয় ও প্রশ্ন ক্রমেই বাড়ছে। সে জন্য মানব উন্নয়ন সূচক (হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স), টেকসই উন্নয়ন পরিমাপ করার জন্য প্রকৃত উন্নতি নির্দেশক (জেনুইন প্রগ্রেস ইন্ডিকেটর), মোট জাতীয় সুখ (গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস) ইত্যাদি বহু পথ ও পদ্ধতি নেওয়া হয়েছে। (বিস্তারিত আলোচনা দেখুন: জিডিপি-উচ্ছ্বাস ও বাস্তবতা, সর্বজনকথা, ফেব্রুয়ারি, ২০১৭) বিশ্বের বহু দেশে এ বিষয়ে উদ্যোগ দেখা যায়।
তথাকথিত অনুন্নত দেশ হলেও ভুটান মাথাপিছু জাতীয় আয়ে বাংলাদেশ থেকে অনেক এগিয়ে, আইএমএফের বৈশ্বিক রিপোর্টে বাংলাদেশে যখন মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২০০ ডলার অতিক্রম করেছে, তখনই ভুটানে মাথাপিছু আয় তার দ্বিগুণেরও বেশি, আড়াই হাজার ডলার। তারপরও ভুটান জিডিপি–মাথাপিছু আয় নিয়ে সীমাহীন উচ্ছ্বাসে গা ভাসায়নি বরং জিডিপিকেন্দ্রিক উন্নয়ন ধারণাকেই প্রত্যাখ্যান করেছে। বিশ্বকে দেওয়া তাদের নিজস্ব উদ্ভাবনী পদ্ধতি ‘মোট জাতীয় সুখ’ অর্থনীতির পরিমাণগত দিকের ওপর সব ছেড়ে না দিয়ে মানুষের জীবন ও পরিবেশ নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে বেশি। এই হিসাব পদ্ধতিতে মোট নয়টি ক্ষেত্র বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়: মানসিক ভালো থাকা, সময়ের ব্যবহার, সম্প্রদায়, জীবনীশক্তি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, বাস্তুতান্ত্রিক স্থিতিস্থাপকতা, জীবনযাত্রার মান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সুশাসন। এ ছাড়া এসব ক্ষেত্রের বিশ্লেষণে মাথাপিছু আয়সহ ৩৩টি নির্দেশক আছে। অন্যান্য নির্দেশক হলো নিরাপত্তা, সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক, সাক্ষরতা, বাস্তুতান্ত্রিক বিষয়, ঘুম এবং কাজে ব্যয়কৃত সময়। দুঃখের বিষয় বাংলাদেশ এখনো গড্ডলিকাপ্রবাহেই আছে, তাতে অর্থনীতিবিদ আমলাদের নতুন চিন্তার ঝুঁকি নেই, ক্ষমতাবানদেরও সুবিধা।
সামনে বাজেট। বৃহৎ প্রকল্পে ব্যয়ের লাগামহীন বৃদ্ধি, আর্থিক খাত থেকে অভাবনীয় মাত্রায় লুণ্ঠন ও পাচার অব্যাহত থাকার কারণে সরকারকে আরও বেশি বেশি আয়ের উৎস খুঁজতে হচ্ছে। যেহেতু চোরাই কোটিপতিদের থেকে সম্পদ সংগ্রহে সরকার অনিচ্ছুক, সেহেতু সহজ পথ জনগণের ঘাড়ে লুণ্ঠনের বোঝা চাপানো। সে জন্যই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমলেও জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়নি, সে জন্যই ভ্যাট অস্ত্র প্রয়োগ করা হচ্ছে বিস্তৃতভাবে। এ কারণে সামনের দিনে বাংলাদেশের মানুষকে ঘরভাড়া, গাড়িভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম আরও বেশি দিতে হবে। জিনিসপত্র কিনতে হবে আরও বেশি দামে। সব নিত্যব্যবহার্য পণ্যেই মানুষকে বাড়তি টাকা গুনতে হবে। বন, নদীবিনাশী তৎপরতা চলবে। দেশে ঋণ ও কর বৃদ্ধি পেলেও জনগণের নিরাপত্তাহীনতা কমবে না বরং তার ওপর উন্নয়নের নামে সন্ত্রাস বাড়বে। সরকার কোনো ব্যাখ্যা দেবে না। কারণ, সর্বজনের কাছে তার কোনো দায় নেই। আলোচনাও তেমন হবে না, কেননা স্তুতিগান ছাড়া বর্তমান সংসদেরও আর কোনো ভূমিকা নেই। আমরা খুশি থাকব, কারণ সরকারি পরিসংখ্যানে জিডিপি বেড়েছে, আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে!
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন