কথাটি ভুলতে বসেছিলাম। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদের মন্তব্য পড়ে কথাটি নতুন করে মনে পড়ল। তিনি লিখেছেন, নির্বাচন কমিশন কেন ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পরিষদসহ পৌরসভা, সিটি করপোরেশনের নাম পরিবর্তনের সুপারিশমালা তৈরি করেছে, সেটা তাঁর বোধগম্য নয়। তাঁর কথায়, ‘এটা জনগণের বুঝতে খুব অসুবিধা হচ্ছে।’ আসলে সেটা তো হওয়ার নয়, বরং মানুষের বুঝতে বেশ সুবিধা হচ্ছে। কালিঝুলি তো অসম্ভব লেগেছে। তো সেটা মুছে ফেলার চেষ্টা থাকবে না? সুশাসন দুর্বল থাকলে ‘নির্বাচনী সুশাসন’ ঢুকবে কোথা থেকে? অথবা নির্বাচনী সুশাসন বিলুপ্ত প্রজাতি হলে তো সুশাসনের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হওয়ারই কথা।
যা বলছিলাম, কথাটি ভুলে যাওয়ার মতো নয়। প্রথমেই মনে পড়ছে ১৯৯২ সালের রায়টি। এইচ এম এরশাদের স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটে নব্বইয়ের ডিসেম্বরে। কুদরত-ই-ইলাহী পনির বনাম নির্বাচন কমিশন মামলার রায় বের হয় দুই বছরের কম সময়ের ব্যবধানে। একটা মাইলফলক রায়। এই রায় স্থানীয় সরকারের নামকরণ বদলের একটি কুষ্ঠিনামা। আইয়ুব, জিয়া ও এরশাদ কী করে অযথা নামকরণ করেছেন, তার একটি চিত্র আঁকা হয়েছে রায়টিতে। অগণতান্ত্রিক শাসন আর নামকরণ বদল করা ঐতিহাসিকভাবে সমর্থক।
ওই রায় যাঁরা দিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই (পাঁচজন) প্রধান বিচারপতি হয়ে অবসর নিয়েছেন। রায়টিতে অবশ্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিবর্তন বিস্তারিত আলোচিত হয়। এটি পড়লে বোঝা যাবে কেন নির্বাচন কমিশন নাম-পদবি পরিবর্তনের দিকে ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। অবশ্য অবনতি যেটা ঘটেছে তা হলো, আগে যেটা করত প্রশাসন বিভাগ, এখন সেটা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে করে দিচ্ছে সাংবিধানিক সংস্থাটি।
নির্বাচন কমিশন নাম বদলাতে এত কিছু ভেবেছে, সেখানে এটির নামের আগে যে ‘কমিশন’ শব্দটি আছে, সেদিকে কেন নজর দিল না, সেটা একটা প্রশ্ন। এখন এই ‘কমিশন’ শব্দটির যদি বাংলা করা হতো, তাহলে মনে হয় মানুষ বেশি খুশি হতো। এখন কমিশন কত প্রকার ও কী কী—এটা তো একটা ধাঁধা হয়ে উঠেছে।
যাক, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মন্তব্য দিয়েই শুরু করি। তিনি বলেছিলেন, ‘সামরিক শাসকগণের মধ্যে একটা সাধারণ প্রবণতা আছে। আর তা হলো তাঁরা বৈধতার সংকটে ভোগেন। আর সেই বৈধতার সংকট পূরণে তাঁরা প্রথমেই স্থানীয় সরকারে নজর দেন। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।’
বিজ্ঞাপন
সংবিধান–বহির্ভূত বা অনির্বাচিত সরকারগুলো বৈধতার সংকটে ভুগলেই স্থানীয় সরকার পরিষদ নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড করে। ইসিও এবারে তেমন একটা কাণ্ড করেছে। এবার বরং আমরা দেখব যে শুধু অনির্বাচিতরাই করেন না, নির্বাচিতরাই অনির্বাচিতদের হার মানান।
নামবদলের ধারণার সঙ্গে মানুষের জন্য প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধা বা সেবার মান বাড়ানোর কোনো বিষয় নেই। জনগণের ক্ষমতায়নের তো কোনো প্রশ্নই নেই। মূল ইস্যু থেকে চোখ সরানো। তাই নতুন একটা কিছু চালু করা। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সেই দিকে সরিয়ে নেওয়া। এটাই তাদের লক্ষ্য। বেসিক ডোমোক্রেসিস অর্ডার ১৯৫৯–এর মূল কথা ছিল মৌলিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের ‘মেধাবী জনগোষ্ঠীর’ জন্য প্রস্তুত করা। আমাদের কমিশন দাবি করতে পারে যে তারাও যেসব নির্বাচন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে করেছে, তাতে তারা আইয়ুব খান থেকে ‘অন্য রকম মেধাবীদের’ উত্থান ঘটিয়েছে।
তবে কথা হলো, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছেন, আইয়ুব খান নামগুলো খামোখাই বদলে দিয়েছিলেন। যেমন নাম ছিল ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড, তিনি করেছেন ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল। নাম ছিল ইউনিয়ন বোর্ড, তিনি করেছিলেন ইউনিয়ন কাউন্সিল। ১৮৮৫ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড এবং ইউনিয়ন বোর্ড—এই নামেই সংস্থা দুটি চলেছে, কোনো অসুবিধা হয়নি। মানুষ এর নাম বদলানোর দাবি তোলেনি। কিন্তু আইয়ুব খান ভেবেছেন যে নাম বদল করা দরকার। আমাদের দেশেও পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন—এসব নিয়ে কখনোই মানুষ প্রশ্ন তোলেনি। এখন আচমকা বিষয়টি সামনে এনেছে নির্বাচন কমিশন।
১৯৭২ সালের ৭ নম্বর প্রেসিডেনশিয়াল অর্ডারের মাধ্যমে প্রথম লোকাল কাউন্সিল অ্যান্ড মিউনিসিপ্যাল কমিটি ডিসিউলিশন অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অর্ডার জারি হয়েছিল। এর মাধ্যমে পাকিস্তান আমলের বিদ্যমান স্থানীয় সরকারের সংস্থাগুলোর বিলোপ করা হয়। এর পেছনের কারণ হিসেবে আইনটিতে বলা হয়েছিল, ‘তারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না, আর জনগণ অব্যাহতভাবে এসব সংস্থার বিলুপ্তি দাবি করে এসেছে।’ বর্তমান ইসি নামকরণ বদলের পেছনে এ রকম যুক্তি দিতে পারবে না।
বিজ্ঞাপন
ইসি স্পষ্টতই নাম বদলের প্রস্তাব দিয়ে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে অগণতান্ত্রিক ও প্রশ্নবিদ্ধ শাসনামলের উত্তরাধিকার বহনের সংকল্পই ব্যক্ত করেছে। তাদের সুপারিশ বাস্তবে রূপ পাক বা না পাক, এই খারাপ বার্তা খুবই পরিষ্কার।
বাহাত্তরে সংস্থাগুলো বিলোপ করে দিয়ে অবশ্য সব স্তরে অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তবে সেই সময় কিন্তু নাম পরিবর্তন করা হয়েছিল। ইউনিয়ন কাউন্সিলের নামকরণ করা হয়েছিল ইউনিয়ন পঞ্চায়েত। ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল হয়েছিল জেলা বোর্ড। ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে ১৭ নম্বর প্রেসিডেনশিয়াল অর্ডারের মাধ্যমে আরেকটি পরিবর্তন আনা হয়। এবারে বিলুপ্ত থানা কাউন্সিলকে তার নামে ফিরিয়ে আনা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা তখন কিছু কম হয়নি। আবার ছয় মাসের ব্যবধানে আরেকটি নতুন আইন করা হয়। এবারেও নামে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। সব শেষ ১৯৭৩ সালের ২২ মার্চ ২২ নম্বর প্রেসিডেনশিয়াল আদেশ জারি করা হয়েছিল। এর নাম ছিল বাংলাদেশ লোকাল গভর্নমেন্ট (ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভা) আদেশ। ঢাকা পৌরসভাকে আপডেট করে করপোরেশনে রূপান্তর করা হয়।
খন্দকার মোশতাক-জিয়ার সামরিক শাসনামলে দুটি সামরিক ফরমান জারি করা হয়েছিল স্থানীয় সরকার নিয়ে। ১৯৭৬ সালের ৩২ নম্বর অধ্যাদেশে থানা পরিষদ এবং ১৯৭৬ সালে ৯০ নম্বর অধ্যাদেশে আসে স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ। আগে যা ছিল থানা উন্নয়ন কমিটি, সেটা করা হয় থানা পরিষদ। তবে নামকরণ বদল প্রসঙ্গে আরেকটি ভয়ের কথা জনান্তিকে বলি। এসব পরিবর্তনের সঙ্গে আরেকটি অনুষঙ্গ আছে। এরা যমজ ভাই। একটিকে দেখছি, অর্থাৎ নামের বদলটা দেখি। অন্যটিকে দেখি না, সেটা হলো—পরিবর্তিত নামের প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি কর্মকর্তা ও মনোনীত ব্যক্তিদের রাখা। সেটা হলে বর্তমানের ‘নির্বাচিতদের’ সামনে একই ধারায় ‘নির্বাচিত’ করাটা সহজ না–ও হতে পারে। তখন এগুলোকে সচল রাখতে মনোনীত ও সরকারি কর্মকর্তাদের প্রাধান্য তৈরি করা হতে পারে।
জিয়াউর রহমান জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয় করেছিলেন। সাবডিভিশনাল অফিসারদের রাখা হয়েছিল চেয়ারম্যান করে। স্থানীয় সরকারের সব সংস্থাকে ‘পুনর্গঠিত, পুনঃসংগঠিত এবং পুনঃ নামকরণ’ করা হয়েছিল। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট আক্ষেপ করে বলেছেন, এসব পরিবর্তন আনা হলেও আসলে মৌলিকভাবে এসব সংস্থার কাঠামো, গঠন এবং কার্যক্রম আগের মতোই অভিন্ন থেকে যায়। জিয়ার আনা পরিবর্তনগুলো ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে সামরিক আইন প্রত্যাহারের পরেও টিকে যায়।
বিজ্ঞাপন
এরপর বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার সামরিক শাসন জারি করেন জেনারেল এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক শাসন চলে। আইয়ুব এবং জিয়াউর রহমানের ধারাবাহিকতায় জেনারেল এরশাদ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে পুনরায় স্থানীয় সরকারের সব সংস্থার নাম বদল ও পুনর্গঠনে মনোযোগী হন। অবশ্য স্থানীয় শাসন–সংক্রান্ত সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ প্রায় দেড় যুগ (১৯৭৫-১৯৯১) বিলুপ্তও ছিল।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, ‘আমরা লক্ষ করি যে “থানা” এবং “থানা পরিষদ”, এই শব্দ বদলে দিয়ে “উপজেলা” এবং “উপজেলা পরিষদ” করা হয়। কিন্তু শব্দের প্রতিস্থাপন করা ছাড়া সব কাজ আগের মতোই অভিন্ন থাকে।’ অবশ্য রায়ে উল্লেখ করা হয়, ১৯৮২ থেকে হাজার ১৯৯১ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অধিকতর উন্নয়ন ঘটেছিল। এ প্রসঙ্গে আমরা বলব যে এই ‘অধিকতর উন্নয়ন’ নামের কারণে আটকে থাকত না।
‘ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলকে’ বদলে ‘ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড’ করার ফলে আইয়ুবের উন্নয়নে জোয়ারের ঢেউয়ের ছলাৎ শব্দ বেশি জোরে শোনা গেছে, এমনটি নয়। ইসি স্পষ্টতই নাম বদলের প্রস্তাব দিয়ে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে অগণতান্ত্রিক ও প্রশ্নবিদ্ধ শাসনামলের উত্তরাধিকার বহনের সংকল্পই ব্যক্ত করেছে। তাদের সুপারিশ বাস্তবে রূপ পাক বা না পাক, এই খারাপ বার্তা খুবই পরিষ্কার।
সব শেষে বলব, প্রস্তাবিত সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে সবচেয়ে বিড়ম্বনায় পড়বে গুগলের ট্রান্সলেশন বিভাগ। গুগল ট্রান্সলেশনে গিয়ে দেখলাম, ইসির নব্য পরিভাষাগুলো গুগলেরও অচেনা। মিউনিসিপ্যাল শব্দের অর্থ পুরসভা নয়, পৌরসভাই করছে গুগল। অর্থাৎ, বাংলা তরজমায় গুগলের কৃত্রিম মস্তিষ্কে স্বাধীন বাংলাদেশের পরিভাষা রীতিই আসছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পরিভাষা আসছে না। ইসির প্রস্তাব আইনে পরিণত হলে গুগলও একটা জটিলতায় পড়তে পারে।
ইসির প্রস্তাব অপ্রয়োজনীয় ও অগ্রহণযোগ্য, যেমনটা আমরা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দেখতে পাই।
মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন