খাদিজা এক দরিদ্র গৃহপরিচারিকার নাম। খাদিজাকে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল। কিন্তু মিরপুর থানা মামলা নিতে চায়নি। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এর দায়সারা তদন্ত করেছিল। সাত বছর পর করোনাকালে আমরা হাইকোর্ট বিভাগ থেকে একটি মাইলফলক রায় পেলাম। এই রায় বলেছে, মানবাধিকার কমিশন দোষী চিহ্নিত ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করেছে। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি।
চিলড্রেনস চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন বনাম মানবাধিকার কমিশন মামলার রায় হয়েছিল ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে। এখন আমরা তার পূর্ণাঙ্গ রায় পেলাম। বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের এই রায় সম্ভবত মানবাধিকার কমিশন বিষয়ে প্রথম নির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ রায়। খাদিজার নির্যাতনের বিষয়ে রিট দায়ের করা হয়েছিল ২০১৩ সালে। এই রায়ের বৈশিষ্ট্য হলো এটা পরিষ্কার করা যে কমিশনের যে ক্ষমতা আছে, সেটা তারা ঠিকঠাক ব্যবহার করছে কি না। কমিশনের আইনে কিছু সংশোধনী আনার প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু সেটা না আসা পর্যন্ত কমিশন উঠতে–বসতে যেভাবে আইনের ওপর দায় চাপায়, হাইকোর্ট বিভাগ সেটা যথার্থ নাকচ করেছেন। হাইকোর্ট বলেছেন, খাদিজা নির্যাতন মামলাটিই এটা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট যে কমিশন কী করে দায় এড়িয়ে চলে। আদালত এ ঘটনায় কমিশনের ‘গাফিলতি, নিষ্ক্রিয়তা এবং দায়িত্বহীনতার’ প্রমাণ পেয়েছেন।
দেশে করোনাকালে ৬৭টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি-মে) আড়াই হাজারের বেশি শিশু নির্যাতন, প্রায় আড়াই শ ধর্ষণ এবং প্রায় ৭৫টি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এই সময়ে শতাধিক অপহরণ ঘটেছে। এটা নিশ্চিত করছে যে করোনাকালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তীব্রতা কমেনি। হাইকোর্টের রায়টি পড়ার পর করোনাকালে কেমন চলেছে মানবাধিকার কমিশন, সেই খোঁজখবর করা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
মানবাধিকার কমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলি। এমনিতে তাঁরা তাঁদের কর্মকাণ্ডের সবটাই তঁাদের ওয়েবসাইটে দিয়ে রেখেছেন। ২৪ মার্চ থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত তাঁরা কী করেছেন, তার একটা ফিরিস্তি সেখানে আছে। তা দেখে মনে হলো কমিশন কী করছে আর সেটা কতটা করুণ, তার আংশিক প্রতিফলনও হয়তো আদালতের রায়ে নেই। না থাকারই কথা। কারণ, আদালতের সামনে প্রতিপাদ্য ছিল কেবলই খাদিজা নামের গৃহপরিচারিকার মামলাটি।
প্রতিটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন থাকে। যে দেশ তার কমিশনকে যত বেশি স্বাধীনভাবে চলতে দেয়, সেই দেশ বিশ্বদরবারে তত বেশি শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে মানবাধিকার কমিশনের জন্ম এক-এগারোতে। প্রয়াত বিচারপতি আমিরুল কবীর চৌধুরী এটিকে কার্যকর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমলাতন্ত্র তাঁকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করেছে। আওয়ামী লীগ এসে তার দল ও রাজনীতির ছায়ায় সব কমিশন ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আনতে চেয়েছে। এতে তারা সফল হয়েছে এবং এ কারণে সব কমিশনই এখন কমবেশি বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে ভুগছে। দন্ত আছে, নাকি দন্তহীন, আইন ক্ষমতা দিয়েছে কি দেয়নি, সেটাই থেকে থেকে সামনে আসে।
এ ধরনের প্রতিটি সংস্থাই ধীরে ধীরে এই ‘অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ’ আমলাদের কবলে চলে গেছে। মানবাধিকার কমিশনও এ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এ কারণে খাদিজা নির্যাতন মামলায় রিট আবেদনকারী বলেন, কমিশনটি রিটায়ার্ড বুরোক্র্যাটদের ক্লাবে পরিণত হয়েছে। আদালত কোনো মন্তব্য না করলেও এই মূল্যায়নের প্রতি তাঁর একধরনের নৈতিক সমর্থনের প্রতিফলন ঘটেছে। ব্যতিক্রম বাদে উচ্চপদস্থ আমলাদের অনেকে অবসর নেওয়ার আগেই কতগুলো পদের দিকে নজর রাখেন। আলোচ্য পদটিও তার অন্যতম।
প্রথমেই ধাক্কা খেলাম, মানবাধিকার কমিশনের ওয়েবসাইটের ২৪ মার্চের এন্ট্রি দেখে। করোনাকালে তারা সিটি করপোরেশনকে মশকনিধনের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। একই দিনে তারা বলেছে, আইইডিসিআরকে তার হটলাইন চালু রাখতে হবে। পরে তারা জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে, মাস্ক পরতে বলেছে। এ রকম আরও বহু বিষয় আছে, যা নিয়ে তারা নির্দিষ্টভাবে দিকনির্দেশনা জারি করেছে। এসব নিশ্চয় জনগুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো এসব কাজ করার জন্য জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলা আরও অনেক উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কাজে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন মাথা ঘামালে তাহলে তথাকথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের আড়ালের মিথ্যাচার চ্যালেঞ্জ করবে কে?
এপ্রিল মাসে তারা চিকিৎসাসেবা পাওয়া মানুষের অধিকার, থানা হেফাজতে একটি হত্যার ঘটনায় অনলাইনে মামলা রুজু করতে দেওয়ার জন্য পুলিশের প্রশংসা বা ত্রাণের নামে ধর্ষণের ঘটনায় দোষীর শাস্তি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। তাদের এসব কর্মকাণ্ডের অর্থ আমাদের বোধগম্য নয়।
এই মাসে কমিশনের সনদের সঙ্গে যায়, এ রকম একটি কাজ হলো করোনায় বন্দিমুক্তি ও কারাবন্দীদের সুরক্ষা বিষয়ে সরকারকে চিঠি দেওয়া। কিন্তু ত্রাণ আত্মসাৎকারী জনপ্রতিনিধিদের ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’ চাওয়া কিংবা জেনেভা ক্যাম্পে আইসোলেশন ক্যাম্প করতে চিঠি দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক।
২৩ মে কমিশন করোনাকালে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে অনলাইন সভা করেছে। তারা সরকারকে বলেছে, যারা নারী ও শিশুর মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী, যারা নির্যাতনকারী তাদের ত্রাণ বা অর্থসুবিধা না দিতে। এ মনোভাবের সঙ্গে অনেকেই একাত্ম হবেন। কিন্তু এটা তো কমিশনের কাজ হতে পারে না।
জানুয়ারি থেকে মে মাসে যখন ২৩০টি শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে (যার মধ্যে এক–চতুর্থাংশের বয়স ৬ মাসের নিচে), ৪২৭ নারী ধর্ষণের শিকার, ২৪ জন ধর্ষণজনিত হত্যার শিকার, ধর্ষণচেষ্টার শিকার ৭৯ জন, ধর্ষণের পর ৬ জনের আত্মহত্যা, ৬২ নারী যৌন হয়রানির শিকার এবং ৮৬ নারী স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন, তখন কমিশন এসব কী সুপারিশ রাখছে!
কমিশনের প্যাডের নিচে লেখা আছে, ইহা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সংস্থা। এটা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। করোনাকালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। কমিশন মানুষকে এমন একটি তথ্য দেয়নি, যাতে আমরা বুঝতে পারি তার স্বাধীন সত্তা আছে।
করোনাকালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার সুবিদিত। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫ মাসে ১২৭ সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। ১৪ জনকে সরাসরি ক্ষমতাসীন দল হুমকি দিয়েছে। ২০ জন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কমিশন এসব বিষয়ে নীরব থাকছে।
আইন মানবাধিকার কমিশনকে সিভিল কোর্টের ক্ষমতা দিয়েছে। সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে সে কেন সাক্ষ্যপ্রমাণ তলব করছে না? হাইকোর্ট রায়ের ৫ নম্বর দফায় আইনের ১৬ এবং ১৮ ধারা অনুসরণ করে অনুসন্ধান বা প্রয়োজনমতো তদন্ত করে যথাযথ সুপারিশ করার ক্ষমতা প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় লোকলস্কর তা অগ্রাহ্য করলে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হওয়ারও নির্দেশনা দিয়েছেন।
করোনাকালে করোনা–সংশ্লিষ্ট বহু মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে। অথচ তারা একটি ক্ষেত্রেও সরেজমিনে কোনো তদন্তে যায়নি বলে দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। কমিশনের লোকবল ৪৮ জন। আরও ৪০ জন নেওয়ার কথা। গত অর্থবছরে বাজেট ছিল প্রায় ৭ কোটি টাকা। এবার ১০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতি মাসে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়কালে কমিশনের প্রকৃত কাজ বলতে যদি কিছু বোঝায় তা হচ্ছে পুলিশের এসআই পর্যায়ের (চট্টগ্রামে দোকানদার হত্যা, গোপালগঞ্জে কৃষক হত্যা ও যশোরে কলেজছাত্রের কিডনি নষ্টের ঘটনা) তিনজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। এটা যদি ৯০ দিনের কাজ হয়, তবে এর আর্থিক মূল্য ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
এই কষ্টের অর্থনীতিতে মানুষ কেন এই বোঝা বইবে? হাইকোর্ট বলেছেন, মানবাধিকার কমিশন ‘জেগে জেগে ঘুমায়।’ তাকে তো জাগানো দরকার।
মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন