শুধু স্বাস্থ্য বাজেটই ১ লাখ কোটি টাকা দরকার
12 May 2020, Tuesday
আগে ছিল মেগা প্রজেক্ট এবং মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার খবর। গণতন্ত্র না উন্নয়নের তর্ক। কোভিড-১৯ অন্তত এই তর্কের একটা নিরাময় দিয়েছে। কিন্তু যে দুর্বলতা ৫০ বছর ধরে চেপে রাখা গিয়েছিল, এখন সেটা বেরিয়ে গেছে।
এই অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ব্যয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে। মালদ্বীপ খরচ করে জিডিপির ১৩.৭ ভাগ, নেপাল ৬ ভাগ, ভারত ৪.২ ভাগ, শ্রীলঙ্কা ৪.১ ভাগ, আর বাংলাদেশ খরচ করে মাত্র ৩.৪ ভাগ। অবশ্য বাংলাদেশের ৩.৪ ভাগের মধ্যে সরকারি খরচ ১ শতাংশের কম। স্বাস্থ্য খাতে খরচের মাত্র ২৬ ভাগ দেয় সরকার আর ব্যক্তি খরচ করে প্রায় ৬৪ ভাগ। ৭২ বছরের গড় আয়ু নিয়ে সরকার গর্ব করতে পারে, কিন্তু সেখানে তাদের কৃতিত্ব মাত্র ২৬ ভাগ।
আওয়ামী লীগের আমলেরই দুটো সরকারি দলিলের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে সরকারের যে আত্মতৃপ্তি, তার সঙ্গে আমরা তাদেরই তৈরি দলিলগুলোর তুলনা চাই। ২০১১ সালের স্বাস্থ্যনীতিতে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য বাজেট হবে জিডিপির ৪ শতাংশ। ২০১২ সালে স্বাস্থ্য অর্থায়ন কৌশলপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে স্বাস্থ্য ব্যয় ২০৩২ সালের মধ্যে জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলা আছে। এমনকি ২০১৬ সালের মধ্যে ১০ ভাগ এবং ২০২১ সালে তা ১২ ভাগে উন্নীত করার লক্ষ্য স্থির করা হয়। অথচ বাস্তবে যা ঘটে চলছে, তা অবিশ্বাস্য। উন্নতির পরিবর্তে অবনতি ঘটছে।
২০০৫-০৬ সালে স্বাস্থ্য বাজেট ছিল ৬ দশমিক ৬ ভাগ। ২০০৬-০৭ সালে ছিল ৬.৮ ভাগ। পরের টানা ১৩ বছরে আগের ওই হারকে আর কখনো ছাড়িয়ে যায়নি। ২০০৮-০৯ সালে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা ও ২০১৯-২০ সালে বরাদ্দ করা হয়েছে ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা (যা মূল বাজেটের ৫ ভাগের কম)। এমনকি ২০১২ সালে যখন লক্ষ্য ঠিক করা হয়, সেই বছরটিতেও স্বাস্থ্য খাতের বাজেট ৫ শতাংশের বেশি ছিল। তাহলে স্বাস্থ্য বাজেট কারা খেয়ে ফেলছে? এই টাকা কোথায় সরানো হয়েছে? অবশ্য কেউ বলবেন, জাতীয় বাজেটের তুলনায় কমলেও টাকার অঙ্কে তো বহুগুণ বেড়েছে। এর উত্তর হলো গোটা বিশ্বে মোট বাজেটের তুলনায় কত শতাংশ বরাদ্দ সেটাই বিবেচ্য।
বাংলাদেশিরা জমিজিরাত বিক্রি বা বন্ধক দিয়ে যে স্বাস্থ্য ব্যয় মেটায়, সেটা রীতিমতো জিডিপির ২.২ ভাগ। বিআইডিএস ২০০১ সালে বলেছিল, গ্রামের চরম দরিদ্রদের মোট আয়ের ১০ ভাগের ১ ভাগই স্বাস্থ্য ব্যয়ে খরচ হয়। স্বাস্থ্য ব্যয়ে পথের ভিখিরি হওয়ার হারও বাংলাদেশেই বেশি। ২০১২ সালে স্বাস্থ্য অর্থায়ন কৌশলপত্রে গ্রিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও’ডোনেলের বরাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি গরিবেরা কম খরচ করে, তাই কম চিকিৎসা পায়। কিন্তু ১৫ ভাগ পরিবার চিকিৎসা খরচ মিটিয়ে নিঃস্ব হয়। সারা জীবনে তারা রাষ্ট্রকে যা দেয়, দুর্নীতি ও অপব্যবহারের কারণে তা দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনব্যবস্থার জ্বালানিতে পরিণত হয়। স্বাস্থ্যবিমা বলে যেহেতু কিছু নেই, তাই গরিব মানুষ যখন জটিল কোনো অসুখের বিপদে পড়ে, তখন নিজের সব অর্থসম্পদ খুইয়ে ফেলে। ২০১২ সালের কৌশলপত্র দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা ৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। সেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা এই মানুষগুলোসহ অনানুষ্ঠানিক খাতের আরও ৯ কোটি মানুষের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি ছিল। বলা হয়েছিল, তাদের ‘সোশ্যাল হেলথ প্রোটেকশন স্কিমের’ আওতায় আনা হবে। কোথায় গেল সে কথা?
আমরা চাই, করোনোকালে এই সত্যের ওপর আলো পড়ুক। করোনা মোকাবিলায় হাসপাতালগুলোতে সর্বত্র নেই নেই। সরকারি রিপোর্টগুলোর আগের পূর্বাভাস তো সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে। এমনটাই তো হওয়ার কথা। প্রতি ১০ হাজার বাংলাদেশির জন্য মাত্র সাড়ে ৬ জনের কম চিকিৎসক। আবার সরকারি চিকিৎসক ১০ হাজারে দেড় জনের কম। তথাকথিত আইনি জটিলতায় এক যুগ ধরে মেডিকেল টেকনিশিয়ানের নিয়োগ বন্ধ। এটা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। যাঁদের মাথাব্যথা হওয়ার কথা, তাঁরা এসব নিয়ে ভাবতে চান না। কারণ, তাঁদের যাবতীয় টেস্ট বিদেশেই চলে। তাই এই মুহূর্তে প্রতি ১০ হাজারে টেকনিশিয়ান দশমিক ৩২। তার মানে, করোনা সংক্রমণের এই আতঙ্কের সময় প্রতি ৩০ হাজার নাগরিককে সেবা দিতে ১ জন আছেন। পিসিআর দিয়ে প্রতিদিন ১ লাখ মানুষের টেস্ট করাতে চাইলেই কি পারবে বাংলাদেশ? দক্ষ টেকনিশিয়ান তো ছাপানো যাবে না। নয়টি বিভাগে শুধুই ১৩০ টেকনোলজিস্ট কর্মরত।
আজ তাই কথাটা সোজাসাপ্টা বলার সময় এসেছে। সেটা হলো, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছে মানুষের স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্ব বা প্রাধান্য পায়নি। এর খেসারত এখন দিচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ। সংক্রমণের ব্যাপকতাকে যথাসময়ে পাত্তা না দেওয়ার মাশুল দিচ্ছে উন্নত দেশগুলো। কিন্তু তারা নিশ্চয় তাদের উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা থাকার মাশুল দিচ্ছে না। স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ১০ শতাংশ খরচ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। তাদের তুলনায় হয়তো আমাদের এখানে করোনা সংক্রমণ কম হবে, আমাদের বিপদ তাদের তুলনায় কম হবে। কিন্তু তাই বলে যারা জিডিপির ১ শতাংশের কম খরচ করে, আমরা উন্নত দেশকে উপহাস করব? নিজেদের দুর্বলতা স্বীকার পর্যন্ত করব না। বলব, সব ঠিক আছে। সব পারি। সব বুঝি। অনেকে আবার তুলনা করে বলেন, অমুক দেশের চেয়ে আমরা ভালো আছি। মনে হয় তাঁরা দাবি করছেন, আমাদের ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা ওই সব দেশের চেয়ে কত উৎকৃষ্ট!
আরেকটি দরকারি কথা। স্বাস্থ্যসেবায় রাষ্ট্রীয় ঔদাসীন্যের বীজ বাংলাদেশের সংবিধানেই আছে। উন্নত বিশ্বের স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে বিতর্ক হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওবামাকেয়ারের মতো স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বিতর্ক কস্মিনকালেও বাংলাদেশ রাজনীতি দেখেনি। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌল নীতিতে চিকিৎসার উল্লেখ আছে, কিন্তু সব নাগরিকের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে বাধ্য করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ বিরল সংবিধানের একটি, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা সরাসরি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত নয়। জীবনের অধিকারের কথা বলা আছে। আর রাষ্ট্র পরিচালনার মৌল নীতি ভাগে যেখানে চিকিৎসার সুযোগের কথা বলা আছে, তা আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়। স্বাস্থ্যসেবা বা জনস্বাস্থ্যের কোনো উল্লেখ পর্যন্ত সংবিধানের মৌলিক অধিকার পরিচ্ছেদে কেন নেই, তা নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল প্রশ্ন তোলেনি।
৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের গরিব মানুষদের অনেকে ডাক্তার-নার্সদের কাছ থেকে চিকিৎসা নেয়নি। তাবিজ-কবচ, ভেষজ ছাড়াও তারা পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে কাজ সেরেছে। হাসপাতালে ভিড় জমায়নি। তো এবারে করোনা-সাম্যবাদে সবারই একধরনের হাসপাতাল লাগছে। ভিআইপি ও গরিব একই বেডে শুবেন, এটা হয় নাকি? গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের জনগণকে তার চিকিৎসার ৬৪ ভাগ খরচ নিজের পকেট থেকে (আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার) করতে হয়। আর এই খরচের দুই-তৃতীয়াংশই তারা খরচ করে পাড়া-গাঁয়ের ফার্মেসির মাধ্যমে। করোনো এসেছে বলে ওই চিত্র রাতারাতি বদলাবে না। ফার্মেসির লোকেরা অ্যাজিথ্রোমাইসিন চেনেন। রেমডেসিভিরও চিনবেন। জনস্বাস্থ্য ও মানুষের মৃত্যুর বিষয়টি গুরুত্ব না পেলে যা হওয়ার তা–ই হবে। অনেকে বলছেনও, সড়ক দুর্ঘটনায় কত মরে!
আমাদের পর্যবেক্ষণ ভুল প্রমাণ করতে পারলে খুশি হব। কেউ বলুক, চিকিৎসায় বৈষম্য গত এক দশকে কতটা দূর হলো। শেষে ২০১২ সালের স্বাস্থ্য অর্থায়ন কৌশলপত্রের কথাই আবার বলতে চাই। সেখানে বলা আছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় উপজেলা ও ইউনিয়ন হবে লক্ষ্য। মোট সম্পদের ৬০-৬৫ শতাংশ এই দুটি স্তরেই যাবে। কিন্তু বাস্তবে উপজেলা ও নিচের দিকের মোট ব্যয় বরং আগের থেকে কমেছে। ২০০১-০২ সালেও যা ছিল ৬৫ শতাংশ। সেটা ২০১৭ সালে ৫২ শতাংশে নেমেছে।
ইতিমধ্যে আমরা নানা প্রণোদনা ও নানা খাতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার ঘোষণা জানি। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতেই ১ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দের একটা ঘোষণা প্রাপ্য। একজন বিদেশি বিশেষজ্ঞ বললেন, ‘সরকার এখন লড়াই (ব্যাটল) জিততে চাইছে। কিন্তু এটা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ। তাই যুদ্ধজয়ের পরিকল্পনা তার লাগবে।’ আমরা মনে করি, যুদ্ধটা দীর্ঘমেয়াদি হবে। এ জন্যই ২০৩২ সালের (মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ) লক্ষ্যমাত্রাটা এগিয়ে আনার দাবি রাখে।
মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন