যে দিকগুলোতে এখন নজর দেওয়া জরুরি
11 April 2020, Saturday
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এখন ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা হলেন সারা দেশের স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাঁরা যথেষ্ট বীরত্বের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের সেবা–শুশ্রূষায় ইতিমধ্যে ৩৩ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, বেশি পরীক্ষার কারণেই প্রথমবারের মতো এক দিনে শতাধিক আক্রান্ত ব্যক্তির খোঁজ মিলেছে। দেশ ব্যাপকভাবে সংক্রমণের মুখোমুখি, তাই একে রুখে দিতে সব ক্ষেত্রে ‘যার যা কিছু আছে’ তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো বিকল্প নেই।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, তাতে এর আরও সংক্রমণ ঠেকাতে এখন কী করণীয়, কী অগ্রাধিকার, সে বিষয়ে আমরা গত কয়েক দিনে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি। নিচের পুরো আলোচনা প্রধানত তাঁদেরই মতামতের ভিত্তিতে।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ নিশ্চিত করেছেন যে মহামারিতে টেস্টের বিষয়টি খুব জরুরি নয়, লক্ষণ দেখে চিকিৎসকেরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন—সেটাই পথ। আর পরীক্ষায় নেগেটিভ মানেই শতভাগ ক্ষেত্রে নেগেটিভ নয়। পজিটিভ মানেও পজিটিভ নয়। যিনি আজ নেগেটিভ, তিনি কাল পজিটিভ হতে পারেন। তবে এমন ঘটনা অল্পই ঘটবে। এই ভয়াবহ ছোঁয়াচে রোগটি মানুষকে ভোগাবে যত বেশি, প্রাণ কাড়বে সেই তুলনায় অনেক কম মানুষের। ১০০ জন মানুষ আক্রান্ত হলে ৮০ জনেরই হয়তো কোনো ওষুধ লাগবে না। দিন কয়েক সর্দি, কাশি, জ্বর ইত্যাদিতে ভুগে সেরে উঠবেন। চিন্তা হলো বাকি ২০ ভাগ নিয়ে। বিশ্বব্যাপী করোনায় গড় মৃত্যুর হার এখনো পাঁচজনের নিচে।
২.
হাসপাতাল বা যেখানেই করোনার সেবা মিলবে, সেটা যেখানেই হোক, চিকিৎসক থাকলেই হলো। সেখানে আক্রান্ত মানুষ ছুটবে। সেই কারণে দেশের ফ্রন্টলাইন স্বাস্থ্যকর্মী কারা, তার একটা তালিকা করা এখন জরুরি। দেশের আনাচকানাচে যত ওষুধের দোকান, প্যাথলজিক্যাল টেস্ট, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ এককথায়, যত ধরনের চিকিৎসা–সংশ্লিষ্ট জায়গা আছে, তার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সবার একটা প্রশিক্ষণ লাগবে। প্রত্যেককে পিপিই ও মাস্ক দিতে হবে। কারণ, আক্রান্ত মানুষ প্রথমেই এসব স্থাপনায় ছুটবে, সুতরাং এসব জায়গার কর্মীদের বড় ভূমিকা থাকবে।
সরাসরি চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক, নার্স ও আয়াদের (অ্যাটেনডেন্ট) মানসম্পন্ন পিপিই ও মাস্ক (এন-৯৫ বা সমতুল্য) লাগবে। কিন্তু বাদবাকি যাঁরা আছেন, তাঁদের সাধারণ সুরক্ষাসামগ্রী হলেই চলবে। তাঁরা দরকার হলে কাপড়ের তৈরি পিপিই ও মাস্ক পরবেন। প্রশিক্ষিত পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রতিদিন এটা ধুয়ে দেবেন। যাতে এটা তাঁরা বারবার ব্যবহার করতে পারেন।
৩.
যদি পিসিআর (বর্তমানে সরকারিভাবে চলমান ব্যবস্থা) দিয়ে আইইডিসিআরের মতামত সাপেক্ষে টেস্ট করানোর পরিস্থিতি না থাকে, সে ক্ষেত্রে দেশের অন্যান্য স্থানে নতুন খোলা সরকারি ল্যাবগুলোর পক্ষেও পেরে ওঠা কঠিন হবে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দাবি যথার্থ হলে রোগী শনাক্তে একটা বড় অগ্রগতি হবে। কিন্তু পিসিআরের মতো এই র্যাপিড টেস্টব্লটের সীমাবদ্ধতা থাকবে। বরং ফলস নেগেটিভের হার সরকারি টেস্টের চেয়ে এখানে আরও বেশি হতে পারে। আবার করোনা সংক্রমণের অন্তত শুরুর তিন দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দেহে কিট কাজই করবে না। এরপরও কম খরচে ও দ্রুততম সময়ে ফল জানার কারণে যে উপকার পাওয়া যাবে, সেটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে লক্ষণ বা উপসর্গ দেখেই অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা যা বোঝার বুঝে যাবেন। উন্নত বিশ্বের কিট পিসিআর কিংবা গণস্বাস্থ্যের ডটব্লট যদি নেগেটিভও বলে লক্ষণ থাকে, তবে চিকিৎসককে করোনার ব্যবস্থাপত্রই দিতে হবে।
করোনা সংক্রমণের চিকিৎসা যেখানেই থাকবে, সেখানে সেবাপ্রার্থীর লাইন লম্বা হবে। সেখানকার পিপিই পরা গেটকিপারকে সিরিয়াল রক্ষায় ঘাম ঝরাতে হবে। সাধারণ নিয়মে চিকিৎসকেরা প্রথম দর্শনে লক্ষণ শোনেন, এরপর টেস্ট দেন। রোগী বা তাঁর আত্মীয়, এরপর ল্যাবে ছোটেন। পরে আরেক তারিখে টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে আসেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি ও বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই চিকিৎসা ও পরীক্ষার ক্ষেত্রে একটা সৃজনশীল ফিল্টারিং করার উদ্যোগ নিতে হবে এবং এটা সম্ভব। এতে ফ্রন্টলাইনে থাকা চিকিৎসকদের ওপর চাপ অনেকটাই কমবে।
দিন তিনেকের জ্বর ও কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট থাকা (কিছু ক্ষেত্রে ডায়রিয়া) হলো করোনার মূল উপসর্গ। এখন এমন লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিরা চিন্তিত হবেন। অন্য সময় হলে এসব অনেকেই উপেক্ষা করেন। অন্যান্য অসুস্থতার কারণেও উল্লিখিত লক্ষণ দেখা দিতে পারে। ফলে সাধারণ কিছু টেস্টের মাধ্যমেও চিকিৎসকেরা ক্ষেত্রবিশেষে সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন। এসবের মধ্যে রয়েছে টোটাল ব্লাড কাউন্ট অ্যান্ড লিম্ফোসাইট লেভেল, লিভারের কার্যকারিতা, সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন (শরীরে জ্বলুনি বেশি হলে রক্তে প্রোটিনের মাত্রাও বেশি হবে), ফেরেটিং (আয়রন জটিলতা অনুধাবন) এবং ডি-ডাইমার (বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্টের কারণ নির্ণয়) করাবেন। চিকিৎসক যদি প্রথম চারটি উচ্চ মাত্রার পান, তাহলে তাকে বেশি সন্দেহ করবেন। এর সঙ্গে রোগী যদি বুকের এক্স-রে ও সিটি স্ক্যান রিপোর্ট নিয়ে আসতে পারেন, তাহলে প্রায় ১৬ আনাই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে পারেন।
উল্লিখিত টেস্টগুলোর প্রায় সবটাই (সিটি বাদে) প্রতিটি উপজেলায় আছে। জেলাগুলোতে এর সবটাই ভালোভাবে আছে। সুতরাং সরকার ল্যাবের মালিকদের সঙ্গে বসে এ–সংক্রান্ত টেস্টের ফি কমিয়ে দিতে পারে। চিকিৎসকের সহকারীরা আগে রিপোর্ট দেখবেন এবং সেই অনুযায়ী তাঁরা সিরিয়ালের সমন্বয় করবেন। অবশ্য সম্ভব ক্ষেত্রে চিকিৎসক দেখিয়ে টেস্ট করানোই শ্রেয়।
৯ এপ্রিল ডব্লিউএইচও–সমর্থিত নতুন সরকারি নির্দেশনায় উল্লিখিত টেস্টগুলোরও উল্লেখ রয়েছে। ডিজিএইচএসডটগভডটবিডিতে ঢুকে ‘করোনা’তে ক্লিক করলে আপনি ৩৫ পৃষ্ঠার গাইডলাইন পাবেন। এতে প্রথমবারের মতো নির্দিষ্টভাবে করোনার ওষুধ হিসেবে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ও অ্যাজিথ্রোমাইসিনের নাম উল্লেখ করা আছে। এর সীমাবদ্ধতার কথাও অবশ্য বলা আছে। তবে দায়িত্বশীল একজন বললেন টেস্ট ও ওষুধ চিকিৎসকদের বিষয়। তাই তাঁরা ব্রিফ করেননি। এটা ভুল নীতি। পরিষ্কার বাংলায় কোথায় কত টাকায় টেস্ট ও ওষুধ মিলবে, তা মানুষকে ব্যাপকভাবে জানানো দরকার।
৪.
আগেই বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তিদের মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশের হাসপাতালে চিকিৎসা লাগে। কিছু ক্ষেত্রে রোগীকে আইসিইউতে রাখতে হয়। এই ব্যবস্থা বাংলাদেশে কতজন রোগীর জন্য করা যাবে, সেটা এক বড় প্রশ্ন। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেলে এ ক্ষেত্রে আমাদের যা সামর্থ্য, তা চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য হিসেবে বিবেচিত হবে। সাধারণভাবে ভেন্টিলেটর ও আইসিইউর সুবিধা আমাদের দেশে ব্যয়বহুল এবং সচ্ছলেরাই এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন। বর্তমান বাস্তবতায় আক্রান্তের সংখ্যা যেহেতু বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাই সেই বিবেচনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে জরুরি ভিত্তিতে কম খরচে নেগেটিভ ফ্লো রুম (যেখানে শুধু এক্সজস্ট ফ্যান দিয়ে দূষিত বাতাস বাইরে যাবে) তৈরি করা প্রয়োজন। আর লাগবে প্রচুর অক্সিজেন। হাসপাতালে আসা করোনা সংক্রমিত রোগীদের ৫ ভাগের আইসিইউ লাগবে। কিন্তু বাকি ১০ ভাগের দরকার পড়বে সিলিন্ডারে অক্সিজেন। সিলিন্ডারে আইসিইউ চলে না। সেন্ট্রাল এসি সিস্টেম লাগে। সুতরাং দেশের সর্বত্র অক্সিজেন পৌঁছাতে হবে। নেগেটিভ ফ্লো রুম এবং অক্সিজেন ছাড়া করোনা রোগীর সুচিকিৎসা অসম্ভব।
৫.
মরদেহ দাফন ও সৎকারের বিষয়ে সারা দেশে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশের সমন্বয়ে প্রশিক্ষিত কর্মী দরকার। নারায়ণগঞ্জে একজন বেহালাবাদকের লাশ প্রায় ৯ ঘণ্টা রাস্তায় পড়ে থাকা, নরসিংদীতে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে দাফনে বাধাদানের ঘটনা সতর্ক হওয়ার জন্য যথেষ্ট। ইউএনডিপি ও আইসিআরসি শুধু ঢাকার জন্য আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের অনধিক ১০০ কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেবে। সারা দেশে মসজিদভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন করে তাঁদের প্রশিক্ষণ ও পিপিই দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
সর্বশেষে বলব, চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল আরও দৃঢ় করার উদ্যোগ নিতে হবে। বিমার মতো প্রণোদনা ছাড়াই একাত্তরে জাতি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। তবে করোনায় ত্রাণ দিতে গিয়ে আহত একজন সহকারী কমিশনারকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনা হয়েছে। সিলেট থেকে করোনায় আক্রান্ত একজন স্বনামধন্য চিকিৎসককে (সহকারী অধ্যাপক) আনা হয়েছে অ্যাম্বুলেন্সে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই বলছেন, তিনি কমিটির সভাপতি। অথচ তাঁকে না জানিয়েই সিদ্ধান্ত হয়। এসবই গভীর সমন্বয় ও প্রস্তুতিহীনতার নির্দেশ করে। সরকারকে অবশ্যই এমন অবস্থা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে হবে এবং তা দ্রুতই করতে হবে।
মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন