মঙ্গলবারের দুপুর। সাংবাদিকদের মধ্যে যাঁরা নির্বাচন কমিশন কভার করেন, তাঁদের একটা অনানুষ্ঠানিক সমাবেশে কিছুক্ষণ বসেছিলাম। তাঁরা নানা প্রশ্ন তুলছিলেন। কিন্তু তার উত্তর দিতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে সবাই একমত হলেন যে অনেক জল্পনাকল্পনার পরে ২৬ নভেম্বরে যে পরিপত্র জারি করা হলো, তা অস্পষ্ট এবং অসম্পূর্ণ। আসলে এটা কোনো অর্থ বহন করে না।
রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক সভায় অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন। প্রশ্নগুলো পুরোনো। অনেকটা বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান শুরুর মতোই পুরোনো। কিন্তু তবু ইসির কোনো হোমওয়ার্ক ছিল না। উত্তর যা দিয়েছে, তার বেশির ভাগ অস্পষ্ট। অনির্দিষ্ট।
মূল প্রশ্নগুলো এ রকম: দণ্ডিত ব্যক্তির মনোনয়নপত্র কি টিকে থাকবে? ঋণখেলাপি কীভাবে সংজ্ঞায়িত হবেন? স্থানীয় সরকারে যাঁরা নির্বাচিত, তাঁদের কি পদত্যাগ করতে হবে? এর মধ্যেও আবার সম্পূরক প্রশ্ন আছে। মেয়র হলে কী হবে? উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হলে কী হবে? টেলিফোন বিল বকেয়া থাকলে কী হবে? ব্যাংকের পরিচালকেরা টিকবেন তো? এসব প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর যাতে তৈরি হয়, সে বিষয়ে ইসি সব সময় উদাসীন থেকেছে। বিষয়টি ইসি তার একটি অভ্যাসগত সংস্কৃতিতে পরিণত করেছে।
২৬ নভেম্বরের পরিপত্র পড়ে মনে হয়েছে, তারা দুভাবে এড়িয়ে যাওয়ার পথ রেখেছে: প্রথমত রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ধাঁধায় রেখেছে। তাঁরা যা খুশি সিদ্ধান্ত নেবেন। দ্বিতীয়ত, আপিলে তাঁরা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবেন। এর পরিণতি হলো একই আইনি প্রশ্নে বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত হবে। অতীতেও তা-ই ঘটেছে। ইসি দায়িত্ব নিতে চায় না। দোষ যাতে অন্যের কাঁধে চাপানো যায়, তেমন ব্যবস্থার প্রতিই যেন তাদের আস্থা বেশি। ১১টি নির্বাচনে ১১টি উত্তর পাকা করা যেত, কেউ করেনি। অবশ্য ইসিকে এককভাবে দোষ দেওয়ারও কিছু নেই।
সব রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং আঞ্চলিক নির্বাচনী কর্মকর্তাদের কাছে তারা পরিপত্র জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, ‘গত ১৩ নভেম্বরের সভায় কয়েকজন রিটার্নিং অফিসার ইউপি, উপজেলা ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র এবং বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা প্রদানের অনুরোধের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের ৪০ নম্বর সভায় আলোচনা করে মাননীয় নির্বাচন কমিশন নিচের সিদ্ধান্ত প্রদান করেন, সংবিধান এবং দণ্ডবিধির ২১ ধারাসহ আইনের অন্যান্য ধারা পরীক্ষা করে রিটার্নিং অফিসারগণ সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন।’
এ রকম একটি পরিপত্র জারি করা দায়িত্বের চরম গাফিলতির নামান্তর। এ রকম একটি শক্ত কথা বলার কারণটি পরিষ্কার করা দরকার। আমাদের ডেপুটি কমিশনাররা আশা করছি এতে ক্ষুণ্ন হবেন না। নিশ্চয় ডেপুটি কমিশনারদের মধ্যে অনেকে আইন-আদালত ও ইসির সবটা বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। কিন্তু একই সঙ্গে অনেকেই থাকতে পারেন, যাঁদের পক্ষে সিদ্ধান্ত দেওয়া কঠিন। আবার এই পরিপত্র জারির পর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই তাঁদের কাছে ছুটে আসবেন। জানতে চাইবেন, পরিপত্র পড়ে তিনি কী বুঝেছেন। অবশ্য তাঁরা পত্রিকার ক্লিপিং দেখিয়ে বলতে পারবেন; দেখুন সোমবার ইসির সচিব কী বলেছেন। সচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, পদত্যাগ না করে তাঁরা কেউ প্রার্থী হতে পারবেন না।
এখন প্রশ্ন হলো বিষয়টি যদি এতটাই সহজ হবে, তাহলে সেটা পরিপত্রে না বলে সাংবাদিকদের মাধ্যমে বলা হলো কেন। অবশ্য মনে হচ্ছে, ইসি সংবাদকর্মীদের নির্বাচন পরিচালনার অংশ ভাবতে শুরু করেছে। যাক, মূল কথাটা হলো পরিপত্রে পরিষ্কার না বলে ইসি যা বলতে চেয়েছে, সেটা যাঁদের যা বোঝার দরকার সেটা তাঁরা বুঝবেন।
দণ্ডবিধির ২১ ধারায় সরকারি কর্মচারীর সংজ্ঞা আছে। আর কিছু নেই। অথচ ইসির উচিত ছিল সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ বলা। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১২ ধারা বলা। কারণ, লাভজনক পদ কী, সে বিষয়ে সেখানে বিস্তর বলা আছে। কিন্তু এই ধারাটিও তারা নির্দেশ করেনি। মঙ্গলবার ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন এল, রূপালী ব্যাংক পরিচালকের কী হবে? সচিবের অস্পষ্ট ইতিবাচক উত্তর: এটা নিয়মিত চাকরি নয়। অথচ এটা ভুল উত্তর, কারণ আইন বলেছে, লাভজনক পদ হলো প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে ফুলটাইম কেউ, অথবা বিধিবদ্ধ সংস্থা বা কোম্পানিতে (৫০ ভাগের বেশি শেয়ার সরকারের) কর্মরত কেউ। রূপালী ব্যাংক শতভাগ রাষ্ট্রমালিকানাধীন। ফুলটাইমের সংজ্ঞা নেই। তাই কারও কারও মতে, ইউপি চেয়ারম্যান বা মেয়র, তাঁরা তো ফুলটাইম চাকরিজীবী নন।
সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করিতেছে না, এমন পদ (মন্ত্রিত্ব) ব্যতীত তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন।’ যদি অতীতের উদাহরণ বিবেচনায় নিই তাহলে দেখি, লাভজনক পদ কী, সেটা বিবেচনায় কারও যোগ্য বা অযোগ্য হওয়া, তার কখনো কোনো মাথামুণ্ডু ছিল না। ২০০৮ সালে সাদেক হোসেন খোকা মেয়র থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। ইসি তাঁরটা বাতিল করলে হাইকোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে তিনি প্রার্থী হন। কিন্তু হেরে যান। এর কিছু পরে উচ্চ আদালত রায়ে বলেছেন, মেয়ররা পারবেন না। উচিত ছিল, সেটাই চূড়ান্ত এবং আইনটি সবার জন্য প্রযোজ্য হওয়া। ইসি তার পরিপত্রে এই রায়টির বরাত দিতে পারত। কিন্তু তা তারা করেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩০ থেকে ৩৫ জন উপজেলা চেয়ারম্যান পদত্যাগ করে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। কিন্তু সেই নির্বাচনেই অনেক উপজেলা চেয়ারম্যান সাংসদ হয়েছিলেন, যাঁরা পদত্যাগ করেননি।
এখানে বলা ভালো, আমরা অনেক আগে থেকে বলেছি, লাভজনক পদ কী কী, সেটা ইংল্যান্ডসহ অনেক গণতান্ত্রিক দেশ আলাদা করে আইন করে নির্দিষ্ট করেছে। এবং সেসবের তালিকা সময়ে সময়ে হালনাগাদ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সংসদ সেটা করবে না। কারণ, তারা ধোঁয়া ধোঁয়া রাখতে চায়। তাতে কার কী সুবিধা, সেটার আর ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। কেউ বলেন, আকলমন্দ কি ইশারাই কাফি।
নৈতিক স্খলন এ রকমই একটি বিষয়। সংসদ পণ করেছে, এর ব্যাখ্যা তারা করবে না। প্রথম আলোতে বড় করে ছাপা হয়েছিল, দণ্ডিতের সাজা আপিলে স্থগিত না হলে প্রার্থিতা বাতিল। একজন কমিশনারকে বললাম, এটা কি আপনার একার নাকি ইসির মত? বললেন, ইসি এ নিয়ে কোনো সভা করেনি। অর্থ কী আশ্চর্য, পদে থেকে মনোনয়ন পেতে উদ্গ্রীব ইতিহাসের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল যেখানে জানেন, খালেদা জিয়ার রায় (জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট) লেখা বাকি, সেখানে তিনি রায় দিয়েছেন, তিনি মুক্তি পেলেও অযোগ্য হবেন।
লাভজনক পদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ইসি সভা করে এবং সে বিষয়ে তারা পরিপত্র জারি করতে পারে। কিন্তু দণ্ড বিষয়ে সেটা তারা করেনি। এই সামর্থ্য তারা রাখে না। বরং আমাকে বলা হলো, কমিশনার সেদিন দণ্ড প্রশ্নে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের আরও বলেছিলেন, প্রার্থীকে স্থগিতাদেশসহ জামিনও পেতে হবে। আগে কখনো শুনিনি যে জামিনও লাগবে!
ঋণখেলাপির কারণে যোগ্যতা-অযোগ্যতা প্রশ্নেও ফাঁক আছে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিনেই তাঁরা পাঠাবেন বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুলিশের কাছে, যা বুঝলাম ঋণখেলাপি কে আর কে নয়, এটা ব্যাংক ঠিক করে। ইসি শুধু পোস্টবক্স। কিন্তু সেটা তো হওয়া উচিত নয়। ঋণখেলাপি কোম্পানির পরিচালক হলে তিনি ২৮ নভেম্বর সকালে টাকা শোধ করেই বিকেলে জমা দিতে পারবেন। এই বিধান সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ দিয়ে বদলেছেন। অন্যদের আগের মতো সাত দিন আগেই শোধ করতে হবে।
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার ব্যক্তি-প্রার্থী করলে হবে না, দলকে করতে হবে। আইনের ১৬ ধারা তা-ই বলছে। ২০১৪ সালে এরশাদ সভাপতি হিসেবে দলের সবার মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছিলেন। কিন্তু ইসি এরশাদকে পাত্তা দেয়নি। এবার কী ঘটবে, কারও জানা নেই।
সংরক্ষিত মহিলা আসনে লাখ টাকার টেলিফোন বিলখেলাপি হিসেবে প্রয়াত সাংসদ সুধাংশু শেখর হালদারের স্ত্রীর মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিল ইসি। গ্যাস, পানি বা অন্য বিলখেলাপিরা এবার ধরা পড়তে পারেন। নির্বাচন ভবনটির বিভিন্ন তলায় বেশ একটা দৌড়ঝাঁপ করলাম। কিন্তু এ বিষয়ে ইসি এবার কী করবে, তা স্পষ্টীকরণে অনেকেই অপারগ থাকলেন। আসলে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের অলিখিতভাবে বলা আছে, যে যাঁর বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেবেন, অতঃপর আপিলে দেখা হবে, ১২ তলাবিশিষ্ট নির্বাচন ভবনে।
মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন