নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি মুখোমুখি। বিএনপির নেতারা বলেছেন, তাঁরা অক্টোবরের মধ্যে একটি ‘এসপার-ওসপার’ করে ফেলবেন। অর্থাৎ সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করবেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতাদের ভাষ্য, বিএনপিকে রাজপথ দখল করতে দেওয়া হবে না। তাঁরা সরকারকে পাহারা দেবেন।
আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী, দেশে জনগণের নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আছে। এই সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ‘ষড়যন্ত্র’, ‘চক্রান্ত’ সফল হতে দেওয়া হবে না। সরকার যদি জনগণেরই হয়, জনগণই সেই ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত প্রতিহত করবে। এককভাবে আওয়ামী লীগকে কেন সেই দায়িত্ব নিতে হবে।
কিন্তু সমস্যা হলো আওয়ামী লীগ যখন রাজপথে সরকারকে পাহারা দিতে চাইছে, তখন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদার (যশোর-৬) পাহারা দেওয়ার নতুন ফর্মুলা ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যাঁরা বিএনপির নেতাদের কথা শুনে ঢাকার সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন, পদযাত্রা-রোডমার্চে অংশ নেবেন, তাঁদের আর যশোরে ফিরতে দেওয়া হবে না।’
গত মঙ্গলবার খুলনায় বিএনপির রোডমার্চে যশোর থেকেও অনেক নেতা-কর্মী যোগ দেন। তাঁদের উদ্দেশেই এই আইনপ্রণেতা নতুন ফরমান জারি করেছেন। ভিসা নীতির আগে আওয়ামী লীগের নেতারা এ ধরনের ঘোষণা হরদম দিতেন। তারা মনে করতেন, রাজপথে বিরোধী দলকে ঠেকাতে পারলেই তাদের জনপ্রিয়তা শিখরে পৌঁছে যাবে। কিন্তু কি তা হওয়ার কথা?
আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, বিএনপি নির্বাচন বানচাল করলে কিংবা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করলে তাদের ওপরই ভিসা নীতি প্রয়োগ হবে। খুবই হক কথা। কিন্তু সেই নির্বাচনটি কী সবার অংশগ্রহণে হবে না একতরফা। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, ভিসা নীতি কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়। যারাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করবে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হবে। এর মধ্যে সরকারি দলের নেতারা আছেন, বিরোধী দলের নেতারা আছেন, সাবেক ও বর্তমান আমলারা আছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আছেন।
এই প্রেক্ষাপটে যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারের বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি যে হুমকি দিয়েছেন, তা কীভাবে মূল্যায়িত হবে? তিনি কি সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পক্ষে না বিপক্ষে যাবে, তা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব ব্যাখ্যা দিলে ভালো হতো। একজন আইনপ্রণেতা কি আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন? তিনি বলেছেন, যশোরে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়ির আশপাশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও থাকেন। এটা রীতিমতো হুমকি।
নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে এসেছে, সরকারি দলের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে অস্থিরতাও বাড়ছে। তাঁরা কখনো বলেন, মার্কিন ভিসা নীতিতে কিছুই যায়-আসে না। এটা তাঁরা পরোয়া করেন না। আবার বলেন, ভিসা নীতি দিয়ে ভালো করেছে। বিএনপি আর রাজপথে সন্ত্রাস করতে পারবে না। তাদের ভাষ্য হলো, একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তারাই এখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
আওয়ামী লীগের সমর্থক একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘ক্ষমতা ছেড়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করলে নির্ঘাত হেরে যাবে। সেই বোকামি তারা করবে কেন?’ তাঁকে যদি পাল্টা প্রশ্ন করি, ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন করলেই আওয়ামী লীগ হারবে কেন? হারবে এ কারণে নয় যে তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। আওয়ামী লীগের নেতারা ভেবে দেখতে পারেন, ২০০৮ সালে তাঁদের জনপ্রিয়তা কোথায় ছিল, আজ কোথায় এসে ঠেকেছে?
কোনো কোনো নেতা একাত্তরে বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর পাঠানোর উদাহরণও টেনেছেন। কিন্তু একাত্তরের ঘটনা দিয়ে যে আজকের ভূ-রাজনীতি ব্যাখ্যা করা যাবে না, সেটাও নিশ্চয়ই তারা বুঝতে পেরেছেন। একাত্তরে চীনও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। অথচ আজ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নীতি একেবারেই বিপরীত। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া সবাই নিজেদের স্বার্থ বোঝে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্ভবত সেটি বুঝতে অপারগ অথবা বুঝেও তা বিবেচনায় নিতে চান না। তারা দেশের চেয়ে দলকে বড় মনে করেন। দলের চেয়ে নেতাকে।
কথা হলো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে অন্যকে হস্তক্ষেপ কিংবা নাক গলানোর সুযোগ আমরা কেন দিচ্ছি? নির্বাচন নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা দিলে রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই সেটি সমাধান করতে হবে এবং আলোচনার মাধ্যমে। সরকার সেই পথে যাচ্ছে না কেন?
আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি, গত ১৫ বছরে দেশের প্রচুর উন্নতি হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ বড় বড় প্রকল্প তারা বাস্তবায়ন করেছে। মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে। তাহলে আওয়ামী লীগের সরকারকে পাহারা দিতে হবে কেন? পাহারা দিতে হবে এই কারণে যে জনগণ গত ১৫ বছরে যেমন উন্নতি দেখেছে, তেমনি শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসও দেখেছে। দেশ থেকে হাজার কোটি টাকা পাচার হতে দেখেছে। কিছু লোক আঙুল ফুলে বট গাছ হয়েছে। সাধারণ মানুষ সেই বটগাছের নিচে চাপা পড়ে আহাজারি করছে। ভোট দেওয়ার সময় এটাও নিশ্চয়ই তারা মনে রাখবেন।
আওয়ামী লীগের সমর্থক একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘ক্ষমতা ছেড়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করলে নির্ঘাত হেরে যাবে। সেই বোকামি তারা করবে কেন?’ তাঁকে যদি পাল্টা প্রশ্ন করি, ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন করলেই আওয়ামী লীগ হারবে কেন? হারবে এ কারণে নয় যে তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। আওয়ামী লীগের নেতারা ভেবে দেখতে পারেন, ২০০৮ সালে তাঁদের জনপ্রিয়তা কোথায় ছিল, আজ কোথায় এসে ঠেকেছে?
সুষ্ঠু নির্বাচন করে পরাজিত হওয়ার মধ্যে লজ্জা নেই। পরের বার জয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে। কিন্তু কারচুপি ও জবরদস্তির নির্বাচন করে জয়লাভের মধ্যে লজ্জা আছে। জনগণ নির্বাচনে কোনো দলকে জয়ী করতে পারে, আবার পরাজিতও পারে—এই সত্যটি ক্ষমতাসীনেরা স্বীকার করতে চান না। অতীতে যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁরাও বোঝেননি। এটাই বাংলাদের গণতন্ত্রের প্রধান সমস্যা। যদি কেউ ধরেই নেন যে নির্বাচনে তাঁরাই জয়ী হবেন, তাহলে তো নির্বাচনের প্রয়োজন হয় না। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করবে, আর ভোটের দিন ফল ঘোষণা করে বলে দেবে, অমুক জয়ী, অমুক পরাজিত।
আওয়ামী লীগ একটানা ১৫ বছর ক্ষমতায় আছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রের সূচকগুলো কেন নিম্নগামী হলো? এর আগে কোনো নির্বাচনের আগে এই প্রশ্ন ওঠেনি যে অমুক দল ক্ষমতায় না আসতে পারলে ডিসি, এসপি, এমনকি থানার ওসি-কনস্টেবলদেরও চাকরি থাকবে না। তাঁরা কি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে কাজ করছেন, না আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক হিসেবে। তাঁরা যদি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে কাজ করে থাকেন, তাহলে কোনো দলের নয়, জনগণকেই তাঁদের পাহারা দেওয়ার কথা।
আওয়ামী লীগ সরকারকে পাহারা দেবে। কিন্তু জনগণকে কে পাহারা দেবে। তাদের ভোটের অধিকার কে নিশ্চিত করবে?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক
উৎসঃ প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন