ছাত্রলীগের হল রাতের আঁধারে কেন ছাত্রলীগকেই দখল করতে হয়
07 August 2023, Monday
যেকোনো সংগঠন চলে নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে। কিন্তু সংগঠনের সেই নীতি ও আদর্শটাই যদি না থাকে, সেটি হয়ে পড়ে লক্ষ্যচ্যুত একটি প্রতিষ্ঠানে। ছাত্রলীগের নেতারা নিজেদের বঙ্গবন্ধুর সৈনিক বলে দাবি করলেও এই শোকের মাসে তাঁরা হামলা ও সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন।
সাড়ে ১৪ বছর আওয়ামী লীগ একটানা ক্ষমতায় থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনের তৎপরতা নেই বললেই চলে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার প্রথম প্রহরেই ছাত্রদল প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। এরপর বাম ছাত্রসংগঠনগুলো কোথাও কোথাও মৃদু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলেও সফল হয়নি। কখনো কখনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও ছাত্রলীগের হয়ে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ফলে অবাধে চলছে ছাত্রলীগের হল দখল ও ক্যাম্পাস দখলের প্রতিযোগিতা।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। যখন তারা মারামারির জন্য আর প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনকে হাতের কাছে পাচ্ছে না, তখন নিজেরাই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। কেবল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই তাদের ১২টি উপদল আছে। এই উপদলগুলো সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ও বর্তমান শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।
এর অর্থ ছাত্রলীগের এই সংঘাত-সংঘর্ষের পেছনে অভিভাবক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের একটা বড় ভূমিকা আছে। কেবল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রলীগ চলে তাদের অভিভাবকদের নির্দেশ ও আশীর্বাদে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-নেতা ও মেয়ররা নিজেদের ক্ষমতাবলয় প্রসারিত করতে ছাত্রলীগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই ধরা যাক। সেখানে ছাত্রলীগের কমিটি নেই। ছাত্রলীগের নেতারা দুই ভাগে বিভক্ত অনেক দিন থেকেই। এক ভাগ চলছে বরিশালের মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর (নুতন নির্বাচন হলেও নতুন মেয়র এখনো দায়িত্ব পাননি)। আরেক ভাগ পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সমর্থন পেত। প্রতিমন্ত্রীর গ্রুপই নির্বাচনে আবুল খায়েরকে সমর্থন দিয়েছে, যিনি বর্তমান মেয়রের ভাতিজা। বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এখন চাচা-ভাতিজা মুখোমুখি। নির্বাচনের আগে ও পরে কয়েক দফা সংঘাতে লিপ্ত হয়েছেন তাদের অনুসারীরা।
কুরিয়ারকর্মী নাহিদকে কোপানো এই হেলমেটধারী ছাত্রলীগের একজন কর্মী বলে জানা যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও হল এত দিন সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারীদের দখলে ছিল। কিন্তু গত ১২ জুন বরিশাল সিটি নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরিচিত আবুল খায়ের আবদুল্লাহ জয়ী হলে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। বরিশাল আওয়ামী লীগের মতো ছাত্রলীগেও প্রতিমন্ত্রীর গ্রুপ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও কোণঠাসা হতে হয়ে পড়ে সাদিক আবদুল্লাহর গ্রুপ। কিন্তু এই অপমান গত সিটি নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়া সাদিক আবদুল্লাহের অনুসারীরা মানতে পারেননি।
এত দিন যেটি চাপান-উতোর ছিল, শনিবার রাতের আঁধারে রূপ নিল প্রকাশ্য সংঘর্ষে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি আবাসিক হলে ধারালো অস্ত্র, লাঠিসোঁটা, মাস্ক ও হেলমেট নিয়ে ছাত্রলীগের এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের ওপর হামলা চালিয়ে ১০ জনকে আহত করে। আবার পরদিন সকালে তারাই ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে।
সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, শনিবার রাতে যে পক্ষ হামলা চালাতে হলে ঢুকেছিল, তারা বরিশাল সিটির মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘ সময় তারাই ক্যাম্পাসের হলগুলোর নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে বরিশাল সিটি নির্বাচনে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ জিতে যাওয়ায় তারা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ সময় হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয় পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সমর্থক হিসেবে পরিচিত পক্ষটি। নির্বাচনের দেড় মাসের মধ্যেই রাতে মাস্ক-হেলমেট পরে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আবার হল পুনরুদ্ধারে আসে সাদিকপন্থীরা।
এদিকে দুটি হলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখে রোববার ক্যাম্পাসে জাহিদ ফারুকের অনুসারী পক্ষটির বিচার ও গ্রেপ্তার দাবি করে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে। এ সময় হামলার বিচার ও ব্যবস্থা নেওয়া না হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রত্যেকের অফিসকক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ববি) ছাত্রলীগের হল দখলের ঘটনায় প্রশাসনকে দায়ী করছে সংগঠনটির একাংশ। ফারুকপন্থী রক্তিম-বাকী গ্রুপের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের’ অভিযোগ এনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে সাদিকপন্থী রাফি-শরীফ গ্রুপ।
৫ আগস্ট বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে এ মানববন্ধন করেন রাফি-শরীফ গ্রুপের অনুসারীরা। মানববন্ধন শেষে বিভিন্ন সন্ত্রাসবিরোধী স্লোগান দিয়ে ক্যাম্পাসের চারদিক প্রদক্ষিণ করে বিক্ষোভ করেন তাঁরা।
রাফি-শরীফ গ্রুপের কর্মী মাহামুদুল হাসান তমাল বলেন, ‘বাকী ও রক্তিম বহিরাগত। তাঁরা ক্যাম্পাসে অরাজকতা সৃষ্টি করছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ আমরা মুজিব আদর্শের সৈনিক কখনো মেনে নিতে পারি না। তাঁদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।’
যাঁরা নিজেদের মুজিব আদর্শের সৈনিক বলে দাবি করেন, তাঁরা কীভাবে হেলমেট ও ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বহিরাগত থাকলে সেটি দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের। মুজিব আদর্শের সাচ্চা সৈনিকেরা প্রশাসনকে বিষয়টি জানাতে পারতেন, তারা ব্যবস্থা না নিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিতে পারতেন। কিন্তু সেসব না করে তাঁরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলে পড়েছেন। এটা মুজিব আদর্শ না হলেও সাদিক আদর্শের প্রকৃষ্ট উদাহরণ বটে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ সাদিক গ্রুপের কর্মকাণ্ড দেখে ১৯৭৪ সালে মহসিন হলের ঘটনার কথা মনে পড়ে। ছাত্রলীগের উপদলীয় কোন্দলের জেরে মহসিন হলে সাত খুনের ঘটনা ঘটে। যাঁরা খুনের ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, তাঁরা পরদিন লাশ সামনে রেখে বিক্ষোভ করেছেন আর স্লোগান দিয়েছেন—খুনি তোমার রক্ষা নেই। অবশ্য সেই খুনের ঘটনায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানসহ খুনিদের শাস্তি হয়েছিল। যদিও শফিউল আলম পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমানের অনুকম্পায় জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমৃত্যু আওয়ামীবিরোধী রাজনীতিই করেছেন।
বর্তমান ছাত্রলীগেও যে শফিউল আলম প্রধানের উত্তরসূরি কেউ নেই, তা কি আওয়ামী লীগ নেতারা জোর দিয়ে বলতে পারেন? না হলে শোকের মাসে কী করে ছাত্রলীগের এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি
উৎসঃ প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন