আগামী ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক মর্যাদা নিয়ে যে আন্দোলন চলছিল সেই আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বটি তৈরি হবে। এরই মধ্য থেকে শিক্ষকরা অবিচ্ছিন্ন ধর্মঘটের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং আজকের পর থেকে হাতে আছে আর মাত্র ৩ দিন সময়। এর মধ্যে উভয়ের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানোটাই সকলের কাম্য। কিন্তু ইতোমধ্যে বুড়িগঙ্গার অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে। দু’পক্ষ থেকেই নানা তিক্ত বাক্যবাণে পরস্পরকে বিদ্ধ করা হয়েছে। তবে শিক্ষক সমাজের মূল নেতৃত্ব এখন পর্যন্ত সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করেনি, যদিও তিনি তা করেছেন। শিক্ষক নেতৃত্ব যদিও নানা জায়গায় আকারে-ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করেছেন যে, শিক্ষকদের অবদানের এবং সুনির্দিষ্ট দাবির প্রশ্নেও প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝানো হয়েছে। অন্তত একজন সরকার সহানুভূতিশীল শিক্ষক নেতা দুঃখ করে লিখেছেন: “প্রধানমন্ত্রী, আমরা মর্মাহত।” প্রশ্ন হচ্ছে-আন্দোলনটি আসলে কি নিয়ে এবং কোথায় ভুল বুঝার অবকাশ রয়েছে, তা এখন পর্যন্ত অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। এক্ষেত্রে কিছু স্পষ্টতা আনয়নের জন্যই এ লেখার অবতারণা। যেহেতু আমি নিজে শিক্ষক, চেষ্টা করবো আমার স্বাভাবিক পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে একটা ন্যায্য বক্তব্য তৈরি করতে।
আমার মূল প্রশ্নটি হচ্ছে—শিক্ষকদের মধ্যে এমন কোনো অপরাধ হয়েছে কিনা যার জন্য তাদের শাস্তি হওয়া উচিত এবং অষ্টম বেতন স্কেলে তাদেরকে সপ্তম বেতন স্কেলের নিচে নামিয়ে দিতে হবে। আমার স্পষ্ট উত্তর হচ্ছে—‘না’। কিন্তু যারা প্রধানমন্ত্রীকে উল্টো বুঝিয়েছেন অর্থাত্ তার চারপাশের উচ্চপদের আমলারা, তাদের সম্ভাব্য বক্তব্যগুলো কী হতে পারে? প্রথমত, তারা নিশ্চয় বলবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন অর্থাত্ আমাদের চেয়ে অনেক কম কাজ করছেন, কিন্তু বাড়তি রোজগার করছেন। সাধারণভাবে এরকম অভিযোগ করা হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমলাদের তুলনায় বেশি বয়স পর্যন্ত চাকরি বজায় রাখতে পারেন। এটি এক ধরনের বৈষম্য তৈরি করছে। দ্বিতীয় অভিযোগটি হচ্ছে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজের লোড এতোই কম যে, তারা বাইরে একাধিক কাজ করতে পারেন এবং বাড়তি আয় করতে পারেন। তৃতীয় অভিযোগ হচ্ছে— বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ইদানীং কন্সালটেন্সি এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এতো বেশি ব্যস্ত থাকেন যে, তাদের পক্ষে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সময়মতো ক্লাস নেয়া, পরীক্ষা নেয়া, খাতা দেখা সম্ভব হয় না। চতুর্থ অভিযোগ হচ্ছে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জ্ঞানচর্চার চেয়ে রাজনৈতিক চর্চাই বেশি করছেন। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে দাবি করা হয় যে, আমলাদের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদমর্যাদা বা বেতন স্কেল আগের মতো রাখলে চলবে না। তাদেরকে কয়েক ধাপ নিচে নামিয়ে দিতে হবে। বর্তমান প্রস্তাবিত বেতন স্কেলের আগে অর্থাত্ সপ্তম বেতন স্কেলে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ২৯০০০ টাকা স্কেল থেকে শুরু করতেন এবং ৫-৬ বছর পর তার বেতনের সঙ্গে ইনক্রিমেন্ট যোগ হয়ে তা ৩৩৫০০ টাকায় পরিণত হতো এবং চাকরির বয়স অন্তত ২০ বছর হলে ও ৫ বছর পর্যন্ত অধ্যাপক থাকলে তিনি সর্বোচ্চ গ্রেডের একধাপ নিচে ৩৯৫০০-তে পৌঁছাতেন। এরপর কেউ কেউ এখান থেকেই বিদায় নিয়ে রিটায়ার্ড জীবনযাপন করতেন। আর সর্বোচ্চ জ্যেষ্ঠ শতকরা ২৫ ভাগ অধ্যাপক সিলেকশন গ্রেড পেয়ে সর্বোচ্চ ৪০০০০ টাকার গ্রেডে যেতে পারতেন। এই সৌভাগ্য সব অধ্যাপকের হতো না। এই বিষয়টি জটিল তাই এখানে ঠিক কী ব্যত্যয় হলো তা বোঝার জন্য একটু ধৈর্যের প্রয়োজন। কারণ একদিক থেকে ধরলে প্রফেসরের যাত্রা শুরু হয়েছে ৩ নম্বর গ্রেড থেকে। যদিও পুরনো এই পদ্ধতিতে তার সুযোগ রয়েছে ১ নম্বর গ্রেডে যাওয়ার এবং ঐ গ্রেডের সমপরিমাণ বেতন পাওয়ার। এখানে বেতনের একটি প্রশ্ন, আরেকটি বড় প্রশ্ন হচ্ছে প্রথম ধাপে যাওয়ার সুযোগের প্রশ্ন। অষ্টম বেতন স্কেলের সর্বশেষ প্রস্তাব অনুযায়ী সুপারিশ করা হচ্ছে অধ্যাপকরা এখন তিন নম্বর গ্রেডেই চিরকালের জন্য আটকে থাকবেন। অথচ পদায়িত সচিবরা একনম্বর গ্রেডে অবস্থান করবেন এবং সিনিয়র সচিবরা এর চেয়েও উপরে সুপার গ্রেডে চলে যাবেন। লক্ষ্য করুন সপ্তম বেতন স্কেলে প্রফেসরের সুযোগ ছিল পদায়িত সচিবদের সমান হওয়ার। এবং সিলেকশন গ্রেডের প্রফেসররা জ্যেষ্ঠ সচিবদের সমান মর্যাদার ন্যায়সংগত অধিকারী ছিলেন। তাহলে শিক্ষকদের বর্তমান আন্দোলনের প্রধান ইস্যু হচ্ছে যত না বেতনের তার চেয়ে অনেক বেশি পদমর্যাদার ধাপ বা সেখানে ওঠার ক্ষেত্রে যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে সেটি।
এবার আমি অন্যান্য অভিযোগ নিয়ে কয়েকটি কথা বলবো—প্রথমত. আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ দিয়ে বলছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯০টি বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হয়। এর মধ্যে অনেকগুলো বিভাগের বাজার চাহিদা খুবই কম। সে সব বিভাগের শিক্ষকদের বাইরে শিক্ষকতা পেশার কোনো সুযোগ নেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়তি টাকা কামানোর অভিযোগ যে তোলা হচ্ছে, তা সত্য হতে পারে মাত্র ৮টি বিভাগের জন্য। এগুলো হচ্ছে: ম্যানেজমেন্ট, মার্কেটিং, একাউন্টিং, ল’, ফার্মেসি, কম্পিউটার সায়েন্স, ইংলিশ ও ইকোনোমিক্স। হয়তো আরও দু’একটি বিভাগ থাকতে পারে। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১শ’ শিক্ষকের মধ্যে খুব কম শিক্ষকেরই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এক সাম্প্রতিক হিসাবে জানা যায় এই সংখ্যাটি হচ্ছে মাত্র ৩ শতাংশ। অর্থাত্ ৬৪ জন। অতএব এই সমস্ত বিভাগের খুব অল্প সংখ্যক শিক্ষকই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে থাকেন। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে হলে প্রতিদিন প্রায় ২-৩ ঘণ্টা যানজট ও যাতায়াতে থাকতে হয়, যা অনেকেরই পছন্দ নয়। অনেকে আদর্শগত কারণে সুযোগ থাকলেও সেখানে পড়ান না যদিও সে সংখ্যাটি বেশি হবে না। নিয়ম অনুযায়ী একজন শিক্ষক সর্বোচ্চ সপ্তাহে চার ঘণ্টা বাইরে পড়াতে পারেন। তার ফলে সর্বোচ্চ উচ্চ ডিগ্রীসম্পন্ন একজন শিক্ষকের পক্ষে বছরে একটি সেমিস্টারে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান করে ৩ থেকে ৪ মাসে গড়ে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার বেশি উপার্জন করা সম্ভব নয়। তার মানে তার মাসিক পরিপূরক মোট আয় দাঁড়াচ্ছে মাসে গড়ে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু নিট আয় তার চেয়েও কম হবে। কারণ উেস ৬ শতাংশ কর কর্তন, বিশ্ববিদ্যালয়কে শেয়ার প্রদান (যারা দেন!) এবং যাতায়াত খরচ বাদ দিলে এই নিট আয় ২০ হাজার টাকার বেশি হবে না। এখন যদি প্রধানমন্ত্রীকে বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অধ্যাপকই দশ-বারোটা করে চাকরি করেন, এবং লাখ লাখ টাকা উপার্জন করেন তাহলে তা কী অতিশয়োক্তি হবে না? মাত্র তিন শতাংশ অধ্যাপক বাইরে কাজ করছেন এবং তাদের গড় আয়ের পরিমাণ মাসে ২০ হাজার টাকার বেশি নয়। এই অবস্থার সঙ্গে আমরা যদি সেক্রেটারিদের তুলনা করে বলি যে, প্রতি মাসে অন্যান্য সব সুবিধা বাদ দিয়ে শুধু গাড়ির জন্য প্রদত্ত ভাতার সুবিধাটুকু কত, এই প্রশ্ন তুলি, তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে। তদুপরি আমি এরকম সংবাদ পেয়েছি যে, অনেক উচ্চপদস্থ আমলাও গোপনে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করে বাড়তি রোজগার করেন! শিক্ষকদের জন্য তো এটা অনুমোদিত, তাদের জন্য তো এটা বেআইনি! প্রধানমন্ত্রী কি এসব তথ্য ও যুক্তির কথা বিবেচনা করে দেখেছেন? শিক্ষকরা রাজনীতি করেন, পড়াশুনায় মনোযোগ দেন না, টক-শো করে অবিরাম সরকারের নিন্দা করেন—একথা কি ঢালাওভাবে সত্য? অনেক শিক্ষক সরকারের অতিরিক্ত প্রশংসাও করেন। অনেক শিক্ষক প্রধানমন্ত্রী অন্যায্য কথা বললেও শুধু “মর্মাহত” হন, বিক্ষুব্ধ হন না। আর কিছু শিক্ষকতো নিশ্চয়ই আছেন যারা কোদালকে শুধু কোদাল বলতেই অভ্যস্ত। তারা শত অসুবিধা সত্ত্বেও সত্য বলবেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন কারাবন্দী হয়েছিলেন তখন সেই শিক্ষকরাই তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এখন প্রধানমন্ত্রী যদি তোষামোদকারীদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে ফিল্টার্ড ইনফরমেশনের (Filtered Information) ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তা হলে তিনি অচিরেই বিপদে পড়বেন। এমনকি আমলাদের মধ্যেও আজ মারাত্মক বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ প্রশাসনিক ক্যাডার ছাড়া বাকি ২৬ ক্যাডার অষ্টম বেতন স্কেলে সিলেকশন গ্রেডের ও অন্য কিছু কিছু সুযোগ-সুবিধা বাতিল করার মাধ্যমে স্থায়ীভাবে পদের অবনমনের শিকার হয়েছেন। সুতরাং তারাও এখন এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কর প্রশাসন, কাস্টম, কৃষি, শিক্ষক সকলকে অবহেলা করে শুধু সাধারণ প্রশাসনিক ক্যাডারের ওপর নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রী দেশ চালাতে পারবেন না। এই ভুল পরামর্শ যারা তাকে দিয়েছিল এবং যেসব ভুল তথ্য তারা তাকে শুনিয়েছিল তা তাঁর অবিলম্বে পরীক্ষা করে দেখা উচিত। এবং প্রয়োজন হলে ঐসব বুদ্ধি ও তথ্যদাতাদের শাস্তি দেয়া উচিত। না হলে বাংলাদেশ একটি তীব্র সংঘাতের মধ্যে পতিত হবে।
এছাড়া অন্য অভিযোগগুলোও তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে, এগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শিক্ষকদের সব দেশেই মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়। তাঁদের যোগ্যতা বয়স দিয়ে মাপা হয় না। তারা সাধারণত শুরু থেকেই হন সর্বোচ্চ মেধা ও মর্যাদার অধিকারী। হতে পারে সবাই সমান আদর্শবান হয়ে উঠতে পারেননি, কিন্তু সেটা প্রায়োগিক সমস্যা, নীতিগত সমস্যা নয়। তাই আবার বলবো, শিক্ষকদের নিয়োগবিধি ও অন্যান্য ব্যাপারে জবাবদিহিতা দরকার হলে আরো বাড়িয়ে দিন, কিন্তু তাদের মর্যাদা হানি করবেন না। তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে মারাত্মক ক্ষতি হবে। মেধাবীরা না উচ্চ সুবিধা, না মর্যাদা, কিছুই না পেয়ে শেষাবধি শিক্ষকতার পেশা থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিবেন। সমগ্র জাতি তখন বিপদগ্রস্ত হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন