করোনাভাইরাস ডিজিজ বা কোভিড-১৯ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের ১৮ মার্চের সংবাদভাষ্যটি আমি পুরোটা শুনেছি। ১৯ মার্চ প্রথম আলোয় এ-সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন, মূল কাজ হলো বিচ্ছিন্ন করা, পরীক্ষা করা, শনাক্ত করা। তাঁর বক্তব্য এখানে শোনা যাবে:
বিশ্বের বহু শহরে কারফিউতুল্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কুয়েতে বলা হচ্ছে, মসজিদে না গিয়ে বাসায় নামাজ পড়ুন। নিউইয়র্কে রেস্তোরাঁয় বসা বারণ। এসব করে কী লাভ? ধরা যাক, বাংলাদেশে ১০০ জন করোনাভাইরাসবাহী আছেন। এক মাস দেশের সব মানুষকে ঘরে আটকে রাখলাম। ৩০তম দিনে এই ১০০ জনের একজন তাঁর ঘরের আরেকজন মানুষের সংক্রমণের কারণ হলেন। সেই মানুষটা যেদিন বের হবেন, তিনি অন্যদের সংক্রমিত করতে শুরু করবেন। জ্যামিতিক চক্রবৃদ্ধি এক মাস পর আবার ঘটতে শুরু করবে। তাহলে এই কারফিউতুল্য অবস্থা জারি করে কী লাভ?
এই প্রশ্নের উত্তরটা পেলাম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসুসের প্রেস ব্রিফিং থেকে। তিনি বলেছেন, উই আর বায়িং টাইম। একটা মাসও যদি সংক্রমণ পিছিয়ে দেওয়া যায়, তা আমাদের সুযোগ দেবে সক্ষমতা তৈরির। হাসপাতালগুলো প্রস্তুত হবে। ভ্যাকসিন আসার সময়টাও কাছে চলে আসবে। সংক্রমণের দাবানল এক মাস পিছিয়ে দিতে পারলেও তা বহু জীবন বাঁচবে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসবাহী মানুষ সরকারি হিসাবের বাইরেও নিশ্চয়ই আছে। এটা বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর অন্যতম। আমরা একটা বাড়িতে অনেক কজন থাকি। এক ঘরে ১০ জনও ঘুমাই। ছাত্রাবাসের গণরুমে ১০০ জনও ঘুমাতে বাধ্য হয়। বাসে-ট্রেনে গাদাগাদি। হাটবাজারে একজনের ঘাড়ে আরেকজন শ্বাস ফেলে। এই দেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধ করব কীভাবে?
আমার প্রথম কথা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতা থেকে: ‘নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে/ ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।’ নিজেকে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচান। করোনাভাইরাস ছড়ানোর হার ২.২। মানে ১০ জন আরও ২২ জনের মধ্যে ছড়ায়। আপনি যদি ভাইরাসমুক্ত থাকতে পারেন, অন্তত দুজনকে আপনি রক্ষা করলেন। সে ক্ষেত্রে যা করণীয়, বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সাইট (যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) থেকে আমি যা জেনেছি:
১. বারবার করে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া। সংস্থাটির নির্দেশনা: কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুতে হবে। ২. নাক, চোখ, মুখে হাত না দেওয়া। ৩. পারতপক্ষে ঘরের বাইরে না যাওয়া। ভিড় এড়িয়ে চলা। অন্য মানুষের থেকে কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখা। ৪. হাঁচি-কাশির সময় নিজের কনুইয়ের ভাঁজ দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে ফেলা। ৫. থুতু না ফেলা। ৬. মাছ, মাংস, দুধ, ডিম কাঁচা না খাওয়া। কাঁচা ফল, সবজি খুব ভালো করে ধুয়ে নেওয়া। ৭. আপাতত বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ রাখা। বিদেশ থেকে এলে নিজের ঘরে একলা থাকা। অন্য কাউকে তিন ফুটের মধ্যে আসতে না দেওয়া।
আমরা কি এগুলো মেনে চলব? আমরা তো দল বেঁধে ছুটে গিয়েছিলাম সমুদ্রসৈকতে। সরকার সেগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। আমি হাটবাজারগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি, আগের মতোই লোকের গায়ে লোক, স্বাভাবিক গতিতে কাজকর্ম চলছে।
আমাদের হাসপাতালগুলোতে এত সুযোগ-সুবিধা নেই। আমরা প্রস্তুতও নই। ডাক্তার, নার্স, ব্রাদার, কর্মচারীরা কি জানেন, তাঁরা করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আসলে কী করবেন? কোনো নির্দেশিকা আছে, কোনো প্রশিক্ষণ আছে? নিজেদের তাঁরা যে রক্ষা করবেন, সেই যন্ত্রপাতি, রসদ আছে? আইসিইউ, ভেন্টিলেটর তো অনেক পরের প্রশ্ন।
কাজেই আবারও বলি, নিজেকে নিজেই বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। নিজে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক বলেছেন, কোনো দেশ যদি ভাবে আমাদের দেশে করোনা আসবে না, তা হবে ভুল। কেউ যদি ভেবে থাকেন, আমাকে করোনাভাইরাস ধরবে না, ভুল হবে। আমাকেও ধরবে—এই ভেবে প্রস্তুতি নিতে হবে।
প্রশ্ন ১. প্রিয় বাংলাদেশ, তুমি কি প্রস্তুত? প্রশ্ন ২. প্রিয় পাঠক, আপনি কি প্রস্তুত?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আমি কেউ নই। আমার ধারণা, এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমরা কাউকেই পাব না। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে আপনাকে, আমাকে। আমি কী করছি?
আবারও বলি, নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে/ ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।
এর মধ্যে আসছে ডেঙ্গু। মশার প্রকোপ বেড়ে গেছে। হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের ভেতর থেকেই আমরা মশা তাড়াতে ব্যর্থ হয়েছি। এ বছর এরই মধ্যে ডেঙ্গু রোগী গতবারের এই সময়ের তুলনায় বেশি। সিটি করপোরেশনগুলো ডেঙ্গু মোকাবিলায় কী করছে, আমরা জানি না।
অর্থনৈতিক মন্দার জন্য সরকার কি প্রস্তুত?
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটো খাত জনশক্তি আর তৈরি পোশাক। দুটো খাতেই ধস নামবে, এ আশঙ্কা বাস্তব। বিদেশে লোক যাওয়া বন্ধ। বিমান বন্ধ। রাস্তাঘাট অবরুদ্ধ। তৈরি পোশাকে সমস্যা ছিল কাঁচামাল আমদানি। চীনের করোনা আমাদের বহু শিল্পকে স্থবির করে দিচ্ছিল। এখন সমস্যা হবে, পশ্চিমা দেশগুলোয় দোকানপাট বন্ধ থাকায় তারা অর্ডার বন্ধ করে দেবে। আমাদের পোশাকশিল্প কঠিন সমস্যায় পড়বে।
আর যদি এই দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তো কারখানাও বন্ধ করে দিতে হবে। একটা বড় অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে সারাটা পৃথিবী পড়বে। বাংলাদেশ হবে তার বড় ভুক্তভোগী। আমাদের সরকার কি এই মন্দা মোকাবিলায় প্রস্তুত? এখনই দেশের অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে করণীয় স্থির করা উচিত। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়ে রাখা উচিত।
করোনাভাইরাসে যত না ক্ষতি করবে, আশঙ্কা যে এর অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে তার চেয়ে অনকে বেশি শোচনীয়।
তবে আশা আছে
বাংলাদেশের মানুষের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা পৃথিবীর অন্য দেশের চেয়ে বেশি। চীন পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া সামাল দিতে পারছে। চীনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ৯০ ভাগ শুরু হয়ে গেছে। চীন চালু হলে তা আমাদের জন্য সুখবর।
ভ্যাকসিন মানবদেহে পরীক্ষা করা শুরু হয়েছে। চিকিৎসকেরাও নিরাময়ের সফল হওয়ার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। এই রোগে আক্রান্তদের ৮৩ ভাগকে হাসপাতালে চিকিৎসা না নিয়েই সারানো গেছে, ১৭ ভাগের মতো গুরুতর অসুস্থ হয়েছেন, মৃত্যুর হার কমবেশি ২.৩ ভাগ। আমাদের কর্তব্য বাংলাদেশে এর বিস্তার ঠেকিয়ে রাখা, যথাসম্ভব বিলম্বিত করা। টেড্রোস আধানমের ভাষায়, বায়িং টাইম। আরও দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগতে হবে।
আরেকটা কথা বলতে চাই। প্রথম দিকে এইডস বা এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তিদের দেখে মানুষ বাঘ দেখার মতো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করত। করোনার বেলায় আমরা যেন তা না করি। আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিচ্ছিন্ন রাখব, চিকিৎসা দেব, কিন্তু তাঁকে ঘৃণা করব না, অপদস্থ করব না, তাঁকে দেখামাত্র বাঘ দেখার মতো করে পালিয়ে যাব না।
আমি বিশেষজ্ঞ নই। বিশেষজ্ঞ নন, এমন মানুষের পরামর্শ গ্রহণ করারও দরকার নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ভুল খবর, ভুয়া পরামর্শে ফেসবুক টুইটার ভরে যাচ্ছে। রসুন খেয়ে করোনা প্রতিরোধ করা যাবে না, বারবার পানি খেয়েও নয়। গরম পানিতে গোসল করলে করোনা যাবে না।
আমি আবারও দুটো আহ্বান জানাব। এক নম্বরটা আপনাকে, যিনি এই লেখা পড়ছেন। আপনি নিজে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। দ্বিতীয়টা সরকারকে। করোনা মোকাবিলায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করুন। তা হতে হবে সমন্বিত। দরকার করোনার বিস্তার রোধ, শনাক্তকরণের ব্যবস্থা, চিকিৎসা, বিচ্ছিন্ন করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি ও কর্মসূচি। এবং অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকা। অপ্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় ও অপচয় একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া। সামনে কঠিন সময় আসছে, উটপাখির মতো বালুতে মুখ রাখা হবে খুবই বিপজ্জনক।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন