পেঁয়াজ কি আজও এক নম্বর আলোচ্য? যে পেঁয়াজ বাঙালি নারীদের চিরকাল কাঁদিয়েছে বঁটির পিঁড়িতে, সেই পেঁয়াজ এবার পুরুষদেরও বেশ নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছাড়ল বটে! সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তার অনেকগুলো প্রশাসনিক, কতগুলো পুলিশি। তাতে সুফল হয়নি। কারণ, সেই পুরোনো কথা, অর্থনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান নেই, প্রশাসনিক সমাধান নেই, পুলিশি সমাধানও নেই।
আকবর আলি খান পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে লিখেছিলেন, এই অংশ আমি আগেও আমার কলামে বার দুয়েক উদ্ধৃত করেছি, বাস্তবতার প্রয়োজনে আবারও উদ্ধৃত করলাম, ‘১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে যখন সামরিক শাসন জারি হয়, তখন সামরিক শাসকেরা শহরাঞ্চলের নাগরিকদের খুশি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ওই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের শহরগুলিতে একটি বড় সমস্যা ছিল খাঁটি দুধের অভাব। দুধে পানি মেশানো হতো। অর্থনৈতিক দিক থেকে দুধে পানি মেশানোর কারণ হলো এই যে, খাঁটি দুধের দাম দেওয়ার মুরোদ বেশির ভাগ ক্রেতারই নেই। ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার অভাবে দুধের উৎপাদন ছিল সীমিত। দুধের সরবরাহ না বাড়লে দুধের দাম বা দুধে ভেজাল কোনটিই কমবে না, কাজেই এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমাধান হলো দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি। এ ধরনের সমাধানে সময় লাগবে, আরও লাগবে অর্থ। সামরিক শাসকেরা তাই অর্থনৈতিক সমাধান উপেক্ষা করে এর রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করে। সামরিক শাসনের আগে দুধে ভেজাল দিলে বিচারক তার ইচ্ছেমতো নগণ্য জরিমানা করত। সামরিক শাসকেরা মনে করল জরিমানা বাড়ালেই ভেজাল দেওয়া কমে যাবে। তাই ১৯৫৯ সালে খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার সর্বনিম্ন জরিমানা ১৫০ টাকাতে নির্ধারণ করা হয়। ১৯৫৯ সালে ১৫০ টাকা আজকের কয়েক হাজার টাকার সমান। ষাটের দশকে এই আইন প্রয়োগ করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। এ আইনের অধীনে একটি মফস্বল শহরে প্রায় শ খানেক আসামিকে আমি দেড় শ টাকা হারে জরিমানা করি। এরপর আমি আশা করেছিলাম যে, দুধে পানি মেশানো কমে যাবে। বাজার থেকে খবর নিয়ে জানা গেল, এসব শাস্তির পর দুধে পানি মেশানো বেড়ে গেছে। এর কারণ হলো, আদালত কর্তৃক ভেজালের জন্য উঁচু হারে জরিমানা আরোপের ফলে বাজারে স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। তারা দুধ ব্যবসায়ীদের হুমকি দিতে থাকে যে তাদের ঘুষ না দিলে তারা আদালতে মামলা ঠুকে দেবে এবং আদালতে গেলেই নতুন হাকিম দুধওয়ালাদের জরিমানা করবে। স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের ঘুষ দেওয়ার ক্ষতি পোষানোর জন্য দুধে পানি মেশানো আরও বেড়ে গেল। বিচারক হিসাবে আমি স্বচক্ষে দেখতে পেলাম যে সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে সমস্যাটিকে আরও প্রকট করে তুলেছি।’
দেশে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছিল চাহিদার তুলনায় কম। এই ঘাটতি পূরণ হতো ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে। এবার ভারতের নিজেদেরই পেঁয়াজসংকট। তারা ঘোষণা করল, পেঁয়াজ রপ্তানি করা যাবে না। আর সেই খবরের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বাজারে আগুন লেগে গেল।
এই সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান হাতে ছিল না। যদি আগে থেকে সরকারের কাছে পরিসংখ্যান থাকত যে দেশে কত পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে, আর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেবে, তখন বিকল্প খোঁজার সময় পাওয়া যেত। তা না হওয়ায় ব্যাপারটা বেশ জটিল হয়ে পড়ে। মিয়ানমার থেকে, চীন থেকে, তুরস্ক থেকে, পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানির নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর অনেকগুলোই ছিল সরকারের দিক থেকে।
বাংলাদেশের মতো দেশে বাজারকে পুরোপুরি স্বাধীন বা মুক্ত হতে দেওয়া বিপজ্জনক। এই দেশে পুঁজি কেবল গড়ে উঠছে, এবং আমাদের পুঁজির চরিত্র এখনো লুটেরা পুঁজির চরিত্রই রয়ে গেছে। মুনাফা দেখলে আমরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি। সরকারের নানা প্রশাসনিক উদ্যোগ যে সুফল দেয়নি, তা–ও সত্য। বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পেঁয়াজ আনছে— সরকারের এই আশ্বাসে বাজার আশ্বস্ত হতে পারত, হয়েছে কি না জানি না, নিয়মিত ছোট আমদানিকারকেরা মাথা চুলকে বোঝার চেষ্টা করেছেন, তাঁরা আমদানি করে আবার ধরা খাবেন না তো। পেঁয়াজের দাম বেড়েই গেছে। পেঁয়াজ আনতে হয়েছে বিমানে করে। শুল্ক গোয়েন্দারা মাঠে নেমে পড়েছেন, যাঁরা যাঁরা বিনা শুল্কে পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ নিলেন, তাঁরা কি আমদানি করেছেন, নাকি মানি লন্ডারিং করেছেন, আমদানি করে থাকলে সেই পেঁয়াজ কোথায় গেল। প্রথম আলোর সর্বশেষ খবর, পেঁয়াজের অবৈধ মজুতের সন্ধান মেলেনি। তবে প্রথম আলোর স্বস্তিদায়ক খবরটা হলো, মেঘনা ও বিএসএমের প্রায় ২ হাজার টন পেঁয়াজ এসেছে বন্দরে। বিমানে আসছে, রোজ জাহাজে আসছে, আবার দুটো বড় প্রতিষ্ঠান বড় চালান এনেছে। এরই মধ্যে নভেম্বর পেরিয়ে গেল, ডিসেম্বর জাগ্রত দুয়ারে, দেশি পেঁয়াজও উঠে যাবে বাজারে। পেঁয়াজের দাম কমবে।
তবে পাশাপাশি আরেকটা কথা বলে রাখি। একবার ভারত বাংলাদেশে গরু রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। তখন বলেছিলাম, বাংলাদেশের মানুষের সৃজনশীলতা, উদ্যম, উদ্যোগের কোনো তুলনা হয় না। এক বছরের মধ্যে আমরা ঘরে ঘরে গবাদিপশুর চাষ করব, এ দেশ গরু-ছাগল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাবে। আমার সে ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছে। পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও তা হবে। এই বছর যেমন-তেমন, আগামী বছরে আমরা অবশ্যই পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হব। এটা হবে অর্থনীতির সাধারণ নিয়মে, আর বাংলাদেশের মানুষের উৎপাদন প্রতিভার অসাধারণত্বের কারণে।
তবে পেঁয়াজ আসলেই চাল, ডাল, নুনের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নয়। পেঁয়াজ ছাড়াও রান্না করা যায়, এবং সেসব রান্না সুস্বাদু হয়। আমরা যে গোপাল ভাঁড়ের কৌতুক শুনতাম, ‘ছেলে ভালো, শুধু পেঁয়াজ খায়, কী বলেন ভাই হিঁদুর ছেলে পেঁয়াজ খায়,’ তার সাংস্কৃতিক বাস্তবতা ছিল। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অনেকে পেঁয়াজ খেতেন না, এখনো বহু রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার করেন না। মুসলমানদেরও পেঁয়াজ ও রসুন খেয়ে মসজিদে যাওয়াকে নিরুৎসাহিত করা আছে। কিন্তু যখন পেঁয়াজের দাম বেশি, এবং একটু বাড়াবাড়ি রকমের বেশি, তখন এই ধরনের তথ্য কিংবা উপদেশ ভুক্তভোগীদের গা-জ্বালার সৃষ্টি করে। আমার মনে আছে, বিচারপতি সাত্তার তখন রাষ্ট্রপতি। তিনি এক সেমিনারে বললেন, আমাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। ভাতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে খাদ্যে বহুত্ব আনতে হবে, আলু হতে পারে ভালো বিকল্প। তখন দৈনিক কি সাপ্তাহিক খবর শিরোনাম করেছিল: ভাতের বদলে আলু খাও—রাষ্ট্রপতি সাত্তার।
আশার কথা, আমাদের মন্ত্রীরা ইদানীং কথা কম বলছেন। সেই যে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের এক কবিয়ালের গান—ও মানুষ, চোখ তো দুইটা, কান দুইটা, মুখ তো একটা, কথা কম কবা; সেটা কিন্তু খুবই উপকারী উপদেশ। নেতারা, মন্ত্রীরা কথা যত কম বলবেন, তত ভুল কম হবে। টক শো কিংবা ফেসবুকে তাহলে ধোলাই পর্বও কম হবে। মধ্যখানে বোধ হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেব সৌদি আরব থেকে লাশ হয়ে আসা নারী শ্রমিকদের সংখ্যা নিয়ে অসংবেদনশীল একটা উক্তি করে ফেলেছেন।
যাই হোক, আজকের লেখাটার প্রতিপাদ্য গুছিয়ে আনি। এক. অর্থনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান নেই, প্রশাসনিক সমাধান নেই, পুলিশি সমাধান নেই। একই সূত্রে বলি, রাজনৈতিক সমস্যারও পুলিশি সমাধান নেই, প্রশাসনিক সমাধান নেই, সামরিক সমাধান নেই।
ছোটবেলায় ছেলে ভোলানো লোকগল্পে পড়েছিলাম, ইয়েস, নো, ভেরি গুড। একজন ইংরেজি জানে না। তাকে তিনটা ইংরেজি শব্দ শিখিয়ে বিচারকের জেরার সামনে পাঠানো হলো—ইয়েস, নো, ভেরি গুড। পুলিশ বলল, তুমি কি চুরি করেছ? ইয়েস। তোমার কি কোনো বক্তব্য আছে? নো। তোমাকে ছয় মাসের জেল দেওয়া হলো। ভেরি গুড।
আমরা যদি সব সমস্যার সমাধানে একই রকমের পুলিশি সমাধানের দাওয়াই প্রয়োগ করি, তা ফল দেবে না। রাজনীতির সমস্যা রাজনীতি দিয়ে, অর্থনীতির সমস্যা অর্থনীতি দিয়ে, কূটনীতির সমস্যা কূটনীতি দিয়েই সমাধান করতে হবে।
দুই. পেঁয়াজের দাম অচিরেই কমে যাবে এবং আগামী বছর বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে রেকর্ড করবে।
তিন. কথা কম বলাই ভালো।
এবার নিজের উপদেশ নিজে শুনি। এই লেখা এখানেই শেষ।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন