বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনের ওপর যেসব দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তা হলো, (ক) রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠান; (খ) সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান; (গ) সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ এবং (ঘ) রাষ্ট্রপতির পদের এবং সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ। উল্লিখিত সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ব্যতীত সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে সংবিধান বা অন্য কোনো আইনের অধীন নির্বাচন কমিশনকে অপর কোনো দায়িত্ব দেয়া হলে নির্বাচন কমিশন সে দায়িত্বও পালন করবে। যেমন- সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ প্রভৃতির নির্বাচন কমিশন নিজ নিজ আইনের অধীন প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পরিচালনা করে থাকে।
সংবিধান প্রণয়ন-পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে উল্লেখ ছিল, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্ধারিত সংখ্যক কমিশনার সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। পরে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন আইন দ্বারা নির্বাচন কমিশনারের সংখ্যা অনধিক চারজন নির্ধারণ করা হয়। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পরবর্তী ২০১২ সালে একাদশ নির্বাচন কমিশন এবং ২০১৭ সালে দ্বাদশ নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। উভয় নির্বাচন কমিশন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সংবিধানে নির্ধারিত সংখ্যক চারজন কমিশনার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল।
সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে, নির্বাচন কমিশন বিষয়ে প্রণীত আইনের বিধানাবলিসাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ করবেন। বাংলাদেশ বর্তমানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বে সংবিধান অনুযায়ী সরকারের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হয়। এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির পদটি আলঙ্কারিক। আমাদের এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে অন্য সবার ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করলেও সংবিধান ও আইনের দ্বারা প্রদত্ত ক্ষমতা ব্যতিরেকে তার পক্ষে অপর কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ নেই। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগ বা দায়িত্ব পালন বিষয়ে সংবিধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা যে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার অপর সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। উল্লিখিত দু’টি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতির পক্ষে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ নেই। রাষ্ট্রপতি তাকেই প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিতে পারেন যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ-সদস্যের আস্থাভাজন। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে একক সিদ্ধান্তে নিয়োগ প্রদান করেছেন এমনটি এ যাবৎকাল পর্যন্ত প্রত্যক্ষের নজির সৃষ্টি হয়নি, যদিও এ ক্ষমতাটি প্রয়োগ করতে গিয়ে একজন রাষ্ট্রপতিকে নির্ধারিত মেয়াদ পূর্তির আগে প্রায় আট মাসকাল দায়িত্ব পালনের পর ২০০২ সালে অসম্মানজনক বিদায়ে বাধ্য করা হয়েছিল।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনের অনুপস্থিতিতে একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচন কমিশন গঠনকালে নির্বাহী আদেশ দ্বারা রাষ্ট্রপতিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ-পরবর্তী সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে প্রতিটি পদের বিপরীতে দু’টি করে নামের সুপারিশ গ্রহণের দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রথম সার্চ কমিটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান- এ চারজন সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয় সার্চ কমিটিতে উপরিউক্ত চারজনের অতিরিক্ত আরো দু’জন সদস্য ছিল। তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অপরজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
আমাদের সংবিধান প্রণয়নকালীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠাবিষয়ক অনুচ্ছেদ ১১৮-এ সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ করা হয়েছে, এতদবিষয়ে প্রণীত আইনের বিধানাবলিসাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপরাপর নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দান করবেন। দীর্ঘদিন যাবৎ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এতদবিষয়ে আইন প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে এলেও তা উপেক্ষিত হয়েছে। আশার কথা, গত ২৯ জানুয়ারি ২০২২ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনটির গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এ আইনটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, এটি ইতঃপূর্বে একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রাক্কালে যে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল অনেকটা উভয়ের অনুরূপ। প্রণীত আইনের সার্চ কমিটির সাথে প্রথমোক্ত সার্চ কমিটির একমাত্র পার্থক্য হলো- এটিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত দু’জন বিশিষ্ট নাগরিক, যাদের একজন নারী অন্তর্ভুক্তির বিধান করা হয়েছে। দ্বিতীয় সার্চ কমিটি প্রণীত আইনের সার্চ কমিটির মতো সমসংখ্যক ছয় সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হলেও এটির অতিরিক্ত দু’জন সদস্যের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং অপরজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় সার্চ কমিটিতে যে চারজন সাংবিধানিক পদধারীর সন্নিবেশন ঘটেছিল প্রণীত আইনটিতেও সমরূপ সাংবিধানিক পদধারী অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
প্রত্যেক সাংবিধানিক পদধারীর নির্ধারিত দায়িত্ব রয়েছে এবং তিনি সংবিধান নির্দেশিত নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই তার সততা, আন্তরিকতা, স্বাতন্ত্র্য, সকীয়তা, নিরপেক্ষতা ও শপথের বাধ্যবাধকতা প্রতিপালন করেন। সার্চ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক বিষয়ে সংবিধানের যে বিধান তা হলো, তারা কেবল নিজ নিজ বিভাগে আসন গ্রহণ করবেন। একজন বিচারক কেবল বিচারকার্য পরিচালনার জন্যই আসন গ্রহণ করতে পারেন। সুতরাং সার্চ কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সাংবিধানিক পদধারী একজন কর্মরত বিচারককে বিচারকার্য বহির্ভূত কোনো দায়িত্ব দেয়া হলে তা সংবিধানসম্মত কি না এমন প্রশ্নের উদয় হয়। তা ছাড়া নিয়োগ বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট মামলা দায়ের হলে ভ্রাতৃপ্রতিম সহকর্মীদের সিদ্ধান্ত ভ্রাতৃপ্রতিম বিচারক বিচারকার্য পরিচালনাকালীন কোনোরূপ বিব্রতবোধ ব্যতিরেকেই দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট এমন নিশ্চয়তা আছে কী। অপর বিষয়টি হলো, সুপ্রিম কোর্টের যে উপদেষ্টামূলক এখতিয়ার রয়েছে এতদবিষয়ে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আপিল বিভাগের মতামত চাওয়া হলে সে ক্ষেত্রেও তা সহকর্মী ভ্রাতৃপ্রতিম বিচারক বা প্রধান বিচারপতির জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে যদিও রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ব্যতিরেকে এরূপ মতামত যাচনার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত নন।
সার্চ কমিটির সদস্য হিসেবে মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করলে তা যে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্বের বিশুদ্ধতার হানি ঘটিয়ে স্বীয় সাংবিধানিক দায়িত্বকে দোলাচলে নিপতিত করবে এমন ধারণাপোষণ অমূলক নয়।
ইতঃপূর্বেকার সার্চ কমিটি প্রতিটি পদের বিপরীতে দু’টি নাম সুপারিশ করতে পারত। প্রণীত আইনটির ক্ষেত্রেও দেখা যায় সার্চ কমিটি প্রতিটি পদের বিপরীতে দু’টি নাম সুপারিশের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। সার্চ কমিটি তার দায়িত্ব পালন সম্পন্ন-পরবর্তী সুপারিশসমূহ রাষ্ট্রপতির বরাবর প্রেরণের যে বিধান প্রণীত আইনে রয়েছে পূর্বেকার সার্চ কমিটির ক্ষেত্রেও অনুরূপ বিধান ছিল। এখানে যে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন তা হলো সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে তার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট দু’টি দায়িত্ব যথা প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতীত অপর দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ব্যতিরেকে কার্য সম্পন্নের কোনো ক্ষমতা দিয়েছে কি না। এক কথায় এর সহজসরল উত্তর- সংবিধান রাষ্ট্রপতি কর্তৃক এককভাবে এরূপ ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়ে নিশ্চুপ। উপরিউক্ত আলোচনা হতে ধারণা পাওয়া যায়, পূর্বেকার সার্চ কমিটি কর্তৃক সুপারিশ-পরবর্তী নিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অত্যাবশ্যক ছিল প্রণীত আইনেও এর ব্যত্যয় রাখা হয়নি।
দেশ ও জাতি ইতোমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছে, সার্চ কমিটির সুপারিশে গঠিত একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচন কমিশন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২ এর বিধান অনুযায়ী গঠিত ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচনের আয়োজন করে চরমভাবে বিতর্কিত হয়েছে। প্রণীত আইনের সার্চ কমিটি বাস্তবতার নিরিখে পূর্বেকার সার্চ কমিটির চেয়ে অধিকতর গ্রহণযোগ্য সুপারিশ প্রদানে সক্ষম যে নয় এটি কমিশন গঠনবিষয়ক সামগ্রিক কার্যাবলি অবলোকনে স্পষ্টত প্রতিভাত।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, রাষ্ট্রপতিকে যেকোনো আইনে ক্ষমতা অর্পণ করা হলেও তার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রমের কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং বাস্তবতা হলো, সুপারিশ-পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষাতেই একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচন কমিশনের মতো ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল।
প্রণীত আইনটিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতার যেসব বর্ণনা রয়েছে তাতে সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা-সরকারি, বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় অন্যূন ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে। আইনটিতে পেশার পরিধি বিস্তৃত করায় বেসরকারি যেকোনো পেশায় অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তি প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা কমিশনার হিসেবে নিয়োগের যোগ্যতা রাখেন। সংখ্যা বিবেচনায় বেসরকারি পেশাজীবীদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক খাতের (ফরমাল সেক্টর) মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যকের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় তৈরী পোশাক শিল্প খাতে। প্রণীত আইনটির সহনীয় বিধান বিবেচনায় ভোটারের সংখ্যাধিক্যের কারণে এ খাত থেকে কমিশনে নিয়োগের দাবি উত্থাপিত হলে সার্চ কমিটির কাছে তা সুপারিশে অন্তর্ভুক্তির অগ্রাহ্যের যুক্তি কী? অনুরূপ দাবি অনানুষ্ঠানিক খাত (ইনফরমাল সেক্টর) কৃষক সংশ্লিষ্ট কৃষি খাত এবং শ্রমসংশ্লিষ্ট রিকশা শ্রমিকদের পক্ষ থেকেও উত্থাপিত হলে তার যৌক্তিক নিরসন প্রত্যাশিত নয় কী। বিশেষায়িত পেশাজীবী যেমন- প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আইনজীবী, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক প্রভৃতির পক্ষ থেকেও উত্থাপিত হলে এটিরও যৌক্তিক সুরাহা প্রয়োজন।
নির্বাচন কমিশনার নিয়োগবিষয়ক প্রণীত আইনটির সার্চ কমিটির সাথে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর বাছাই কমিটি এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ এর বাছাই কমিটির তুলনা করলে দেখা যায়, প্রথমোক্তটিতে প্রণীত আইনের সার্চ কমিটির সাংবিধানিক পদধারী চারজনের অতিরিক্ত অবসরপ্রাপ্ত বা কর্মরত মন্ত্রিপরিষদ সচিব অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অপর দিকে শেষোক্তটির বাছাই কমিটি সম্পূর্ণ ভিন্নতর। এটির সভাপতি ও সদস্য হিসেবে যারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন তারা হলেন- জাতীয় সংসদের স্পিকার; আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী; চেয়ারম্যান, আইন কমিশন; মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার কর্তৃক মনোনীত সরকারি দল ও বিরোধী দলের দু’জন সংসদ সদস্য।
প্রণীত আইনটিতে নিয়োগের নিমিত্ত সুপারিশ প্রদানের জন্য অনুসন্ধান কমিটির কথা বলা হয়েছে। অপর দিকে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনে একই উদ্দেশ্যে বাছাই কমিটির কথা বলা হয়েছে। আইনত্রয়ের অনুসন্ধান ও বাছাই কমিটির কাজের পরিধি এক ও অভিন্ন হলেও অনুসন্ধান ও বাছাইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যরা নিজস্ব বিবেক বুদ্ধি ও চিন্তার প্রয়োগে অনুসন্ধানের মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে বের করার চেষ্টায় রত থাকেন। পক্ষান্তরে বাছাই কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন বা ব্যক্তি থেকে প্রাপ্ত নাম বাছাই করে সুপারিশ প্রণয়ন করেন। শেষোক্ত ক্ষেত্রে বিবেক, বুদ্ধি ও চিন্তার প্রয়োগের সুযোগ অবারিত নয়।
নিয়োগবিষয়ক উপরিউক্ত তিনটি বাছাই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত পদধারীদের অবস্থান ও দায়িত্ব বিবেচনায় নেয়া হলে প্রতীয়মান হয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ এর বাছাই কমিটিতে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের অন্তর্ভুক্তি ব্যতিরেকে অপর দু’টি সার্চ বা বাছাই কমিটি হতে ভিন্নতায় জনপ্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত বিধায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ এর বাছাই কমিটিটি গণতান্ত্রিক ও অধিক গ্রহণযোগ্য।
অনেকেই মনে করেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকা সত্তে¡ও সংবিধান প্রণয়নের প্রায় ৫৩ বছর পর এতদবিষয়ে আইনটি প্রণীত হওয়ায় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পূরণ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আইনটিতে প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষার বাইরে নিয়োগ দেয়ার সুযোগ বারিত থাকায় এ ধরনের আইনের মাধ্যমে কখনো কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, এ যাবৎকাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে দলীয় সরকারের অধীন আটটি সংসদ নির্বাচনের প্রতিটিতেই ক্ষমতাসীন দল বিজয়ী হয়েছিল। অপর দিকে, দলীয় সরকারবহিভর্‚ত সরকারের অধীন চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতিটিতে নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে যে দল রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল সে দল পরাভূত হয়েছিল। সুতরাং অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে আগাম অনুধাবন সম্ভব দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচনে কোন দল বিজয়ী হবে। স্মর্তব্য যে, দলীয় সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগের অধীন প্রথম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ এ চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) অধীন দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ এ দু’টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জাতীয় পার্টির অধীন তৃতীয় ও চতুর্থ এ দু’টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অপর দিকে, কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের অধীন পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সংবিধানের বিধানাবলির আলোকে গঠিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করায় চতুর্দশ নির্বাচন কমিশন গঠনের আবশ্যকতা দেখা দিলেও সম্ভাব্য কখন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা নিশ্চিত না হওয়ায় জরুরিভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের যেমন আবশ্যকতা নেই, অনুরূপ একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পদধারীবিহীন থাকবে এটিও প্রত্যাশিত নয়। অতীতে দেখা গেছে, নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের পদত্যাগের ঘটনার অব্যবহিত পরই নতুন কমিশন গঠিত হয়েছিল, যদিও ক্ষেত্রবিশেষে নির্বাচন অনুষ্ঠান বিলম্বিত হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যতীত স্থানীয় সরকারসংক্রান্ত নির্বাচনগুলো পরিচালনা করতে হয় বিধায় কমিশনে পদধারীরা আসীন না হলে এর কার্যকলাপ যে বিঘ্নিত হবে সে প্রশ্নে দ্বিমত থাকার অবকাশ ক্ষীণ।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন কমিশনের সংস্কার বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য যে কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছে দেশবাসী এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। দেশবাসীর প্রত্যাশা কমিশন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সবার সাথে ফলপ্রসূ মতবিনিময়ের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের গঠন ও কার্যকলাপের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো চিহ্নিত করে কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য সুপারিশ প্রণয়নে সক্ষম হবে।
সার্বিক বিবেচনায় আশার কথা হলো, দলীয় সরকারবহির্ভূত সরকার কর্তৃক সৎ, দক্ষ, যোগ্য, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে দেশ ও জাতি কাঙ্ক্ষিত মানের সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনে গণতান্ত্রিক সরকারের আগমন প্রত্যক্ষ করবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন