সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয় এবং তদাধীনস্থ বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থার বরাবর প্রতি বছর নিজ ব্যয়ভার মেটাতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। এ অর্থ বরাদ্দ মঞ্জুরের দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ওপর ন্যস্ত। আমাদের দেশে অর্থবছর পয়লা জুলাই শুরু হয়ে ৩০ জুন শেষ হয়। যদিও পৃথিবীর অনেক দেশে অর্থবছর পয়লা মার্চ থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ দিন পর্যন্ত হয়। আবার কিছু দেশে অর্থবছর ও ইংরেজি বছর একই হয়ে থাকে। প্রতি বছর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ বাজেট প্রস্তুতের আগে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তদাধীনস্থ বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থা থেকে আসন্ন অর্থবছরে ব্যয় বিষয়ে চাহিদাপত্র দিতে বলা হয়। বাজেট প্রস্তুতকালীন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সাথে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও তদাধীনস্থ বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থার চাহিদাপত্র বিষয়ে পৃথক বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও তদাধীনস্থ বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থা পাঠানো চাহিদাপত্রের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করে মন্ত্রণালয় ও তদাধীনস্থ বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থার বাজেট বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়। সচরাচর দেখা যায়, চাহিদাপত্রে মন্ত্রণালয় ও তদাধীনস্থ বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থার পক্ষ থেকে যেভাবে বরাদ্দ চাওয়া হয়; তাতে এতদবিষয়ে মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন করা হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ বাজেট প্রস্তুত করলেও প্রতি বছর সংসদ অধিবেশনে অর্থবিল আকারে এটি সংসদে উত্থাপনের আগে রাষ্ট্রপতির সুপারিশ নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংসদে বিস্তারিত আলোচনার পর প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে বাজেট পাস হয়। পরে এটি কার্যকর করতে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে তার সম্মতি নিতে হয়।
প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও তদাধীনস্থ বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থার প্রধানরা নিজ কার্যালয়ের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা। যেকোনো অর্থ ব্যয় বিষয়ে আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তার অনুমোদন লাগে। প্রতি অর্থবছরে বরাদ্দ করা খাতভিত্তিক অর্থ অর্থবছর শেষের আগে ব্যয় করে এর বিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষকের কার্যালয়ে সর্বশেষ ১৮ জুনের মধ্যে দাখিলের বিধান। ক্ষেত্রবিশেষে ৩০ জুন পর্যন্ত দাখিল করা যায়।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং তদাধীনস্থ বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থা এর বরাবর প্রতি অর্থবছরে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে আসে। এ নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যয়ের বিধান থাকলেও অনেকের ক্ষেত্রে প্রায়ই তা উপেক্ষিত হতে দেখা যায়। আবার অনেক আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তার মধ্যে এ বিশ্বাস কাজ করে, একটি অর্থবছরে বরাদ্দকৃত সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয় না করা গেলে তা অদক্ষতা হিসেবে বিবেচিত। এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে অনেক কর্মকর্তা নিজের দক্ষতা প্রমাণে ব্যয়ের যৌক্তিকতা থাকুক বা না থাকুক তা বিবেচনায় না নিয়ে যেনতেনভাবে বরাদ্দকৃত সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয়ের প্রয়াস চালান। অনেক ক্ষেত্রে ব্যয় না করে যোগসাজশীভাবে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে ভুয়া বিল দাখিলপূর্বক অগ্রিম অর্থ উত্তোলনের ব্যবস্থা করেন। এভাবে অগ্রিম উত্তোলন করা অর্থ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আত্মসাৎ হয়।
প্রতিটি অর্থবছরে দেখা যায়, পরবর্তী অর্থবছরে সংসদে বাজেট উত্থাপনের সময় চলতি বছরের ব্যয়ের সংযোজন-বিয়োজনসহ অতিরিক্ত ও অপ্রত্যাশিত ব্যয় সমন্বয়ে সম্পূরক বাজেট পেশের আবশ্যকতা দেখা দেয়। সম্পূরক বাজেটের মাধ্যমে চলতি বছরের বাজেটের সংযোজন-বিয়োজনসহ অপ্রত্যাশিত ও অতিরিক্ত ব্যয়ের অনুমোদন দেয়া হয়। এ ধরনের অনুমোদন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যয়-পরবর্তী হয় বিধায় খরচের যৌক্তিকতা বিষয়ে কোনো ধরনের বিতর্ক অনেকটা অর্থহীন। প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে মানুষ ও গবাদিপশুর জীবনহানি, ফসলহানি, সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা ও যোগাযোগ অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতিতে যে অপ্রত্যাশিত ও অতিরিক্ত ব্যয় অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে পরিস্থিতির আকস্মিকতায় মূল বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে যে ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়; এ ক্ষেত্রে সচরাচর তা সম্ভব হয় না। এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ও অতিরিক্ত ব্যয় দ্রুত জনমানুষের দুঃখদুর্দশা লাঘবে করা হয়। তবে একশ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী নীতি-নৈতিকতা ও মানবিকতার অবজ্ঞা ও উপেক্ষায় এতদসংক্রান্ত ব্যয় থেকেও ফায়দা হাসিলে কুণ্ঠাবোধ করেন না।
নদীভাঙন তীব্র হলে দ্রুত বালির বস্তা, বড় পাথর ও সিমেন্টের ব্লক পানিতে ফেলে রোধের চেষ্টা করা হয়। এগুলো পানিতে ফেলা পরবর্তী দৃশ্যমান হয় না বিধায় কি পরিমাণ ফেলা হয়েছে তা নিয়ে অস্পষ্টতা থাকে। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে দ্বিধা করেন না ঠিকাদারদের সাথে যোগসাজশে একশ্রেণীর দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ বিষয়ে অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত, পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে সমুদ্রের লবণাক্ততা প্রতিরোধে এবং নদীতীর রক্ষায় যে বাঁধ দেয়া হয়; তা নির্মাণকালীন প্রয়োজনীয় নজরদারি না থাকায় কাজের মান নিম্ন হয়ে থাকে। তা ছাড়া এ ধরনের কাজ থেকে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রাপ্তি যোগ বেশি থাকায় এগুলোর মান কখনো সন্তোষজনক হয় না। এগুলোর প্রতিরোধ সক্ষমতা দুর্বল বিধায় এর ফলে অতিবৃষ্টি, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতিতে আসন্ন ক্ষতি মাত্রাতিরিক্ত হয়। এ ধরনের ক্ষতি দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য শাপেবর।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং তদাধীনস্থ কার্যালয় বরাবর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতাবহির্ভূত বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত, আসবাবপত্র ক্রয় ও মেরামত, সভা, সেমিনার, কর্মশালা, প্রশিক্ষণ প্রভৃতি সংশ্লেষে ব্যয়, দেশ-বিদেশে ভ্রমণসংক্রান্ত ব্যয়, এয়ারকুলার, কম্পিউটার, ফটোকপি মেশিন, টেলিফোন, মোবাইল প্রভৃতি সংক্রান্ত ব্যয় এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় কিভাবে নির্বাহ করা হবে, সে বিষয়ে নির্ধারিত বিধানাবলি রয়েছে। সরকারের যেকোনো কার্যালয় বিধানাবলি অনুসরণপূর্বক ব্যয় নির্বাহ করলে ব্যয় সংশ্লেষে কোনো অনিয়ম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বেশির ভাগ কার্যালয়ের বেলায় পরিকল্পনা ও নিয়মমাফিক ব্যয় নির্বাহ না করার কারণে অর্থবছর সমাপ্ত হওয়ার পূর্বক্ষণে দেখা যায়, ব্যয় নির্বাহ ছাড়াই অগ্রিম বিল দাখিলের হিড়িক। এ ধরনের অগ্রিম অনেক বিল যোগসাজশী ও ভুয়া।
সরকারের একটি কার্যালয়ের নিজ নিজ নিরীক্ষা বিভাগে বিল দাখিল-পরবর্তী তা অনুমোদনের দায়িত্ব ওই বিভাগের ওপর ন্যস্ত। এ বিভাগটির বিষয়ে জনমনে এমন বিশ্বাস বিরাজমান, বেতন-ভাতাবহির্ভূত যেকোনো বিলে তাদের প্রত্যাশামাফিক নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ না দিলে অযথা সে বিল পাসে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। যে মুহূর্তে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ দেয়া হয়, তাৎক্ষণিক প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যায়।
সরকারের বিভিন্ন কার্যালয়ের ব্যক্তিদের অভিমত, নিরীক্ষকের কার্যালয়ে বিল পাস বিষয়ে প্রাপ্তি যোগ না থাকলে অযথা যে হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়; তা দূর করা গেলে ব্যয় নির্বাহে নিরীক্ষকের কার্যালয় তা পাস সংশ্লেষে দুর্নীতি লাঘব বহুলাংশে সম্ভব। এ কথাও ঠিক, ব্যয়ের যৌক্তিকতার ভিত্তিতে নিরীক্ষকরা বিল পাস করলে সরকারের যেকোনো কার্যালয়ের অযৌক্তিক ব্যয় নির্বাহের অবকাশ ক্ষীণ।
আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে আমার চাকরিজীবনে প্রবেশকালীন নিজ বিভাগের বিভিন্ন আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তার অধীন কাজের সময় সরকারি অর্থব্যয় বিষয়ে তাদের মধ্যে যে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ প্রত্যক্ষ করেছি; বর্তমানে যারা সমদায়িত্বে রয়েছেন তা তাদের মধ্যে হারানোর পথে। অতীতে আমার নিজ বিভাগের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তাদের মধ্যে বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ যৌক্তিকভাবে ব্যয় নির্বাহ-পরবর্তী অব্যয়িত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকার বরাবর ফেরত দেয়ার প্রচলন বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল। আজ যেমন বরাদ্দকৃত সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয় করে অনেকে দক্ষতা প্রমাণে সচেষ্ট, সে সময় বরাদ্দকৃত অর্থের বিশেষত আনুষঙ্গিক খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে কে কত বেশি বাঁচিয়ে সরকারের কোষাগারে তা ফেরত দিতে পেরেছেন এই প্রতিযোগিতায় অনেকে সচেষ্ট ছিলেন।
সরকারের এমন অনেক কার্যালয় রয়েছে যেগুলোতে সভা, সেমিনার, কর্মশালা, প্রশিক্ষণ প্রভৃতি সংশ্লেষে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় তা সংখ্যানুপাতে না হওয়ায় ব্যয় সাশ্রয় হয়। অতীতে এ ধরনের সাশ্রয়কৃত অর্থ ফেরত দেয়ার প্রবণতা ছিল। বর্তমানে দেখা যায়, ফেরত না দিয়ে খাত বদলে যথেচ্ছ ব্যয় করে দক্ষতা প্রমাণের প্রয়াস নেয়া হয়।
অতীতে সরকারের একটি কার্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন যে আসবাবপত্র ক্রয় করা হতো প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে তা দিয়ে কয়েক যুগ পার করে দেয়া হতো। কিন্তু এখনকার কর্মকর্তাদের মধ্যে এই মানসিকতা অনুপস্থিত। এখনকার অনেক কর্মকর্তা রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের ধার ধারেন না। তাদের মানসিকতা এমন প্রতি বছর প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক কার্যালয়ের জন্য নিত্যনতুন ও চাকচিক্যে ভরপুর আসবাবপত্র চাই।
সরকারের বিভিন্ন কার্যালয়ের যেসব কর্মকর্তা যৌক্তিকতা ছাড়া ব্যয় নির্বাহে অপারগ তারা প্রকৃত অর্থে সততা ও ন্যায়পরায়ণতার আদর্শে বলীয়ান দক্ষ কর্মকর্তা। তাদের সংখ্যা বর্তমানে কম হলেও তারা স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল। তাদের ওপর যারা অদক্ষতার কালিমা লেপনে যৌক্তিকতার বালাই না করে বাজেটে বরাদ্দকৃত সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয়ের প্রয়াস নেন; এরা স্ববিবেচনায় দক্ষ হলেও দেশের জনমানুষের বিবেচনায় অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে সরকারের বিভিন্ন কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের মানসিকতার পরিবর্তন একান্তভাবে জরুরি। যতক্ষণ পর্যন্ত এ মানসিকতার বদল না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত দেশের সাধারণ মানুষের করে প্রদত্ত অর্থের অপব্যয় চলতে থাকবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
উৎসঃ নয়া দিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন