|
ইকতেদার আহমেদ
|
|
শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্যের অবসান কতদূর?
27 February 2024, Tuesday
জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার সনদ বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের কাছাকাছি সময়ে প্রণীত মানবজাতির জন্য পৃথিবীর বুকে সুখী, সমৃদ্ধশালী ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের একটি অনুপম আদর্শ দলিল। এ দলিলে অন্যান্য অধিকারের পাশাপাশি শিক্ষার অধিকারের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার সনদের ২৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘প্রত্যেকের শিক্ষার অধিকার থাকবে। অন্তত প্রাথমিক এবং মৌলিক স্তরে শিক্ষা হবে অবৈতনিক। প্রাথমিক শিক্ষা হবে বাধ্যতামূলক। কারিগরি ও পেশাভিত্তিক শিক্ষা সাধারণভাবে পর্যাপ্ত করতে হবে এবং উচ্চশিক্ষা মেধার ভিত্তিতে সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। শিক্ষার লক্ষ্য হবে মানুষের ব্যক্তিত্বের সম্পূর্ণ বিকাশ এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি সম্মান বর্ধিতকরণ। ইহা সকল জাতি, গোষ্ঠী অথবা ধর্মীয় দলের মধ্যে জ্ঞান, পরমতসহিষ্ণুতা এবং বন্ধুত্বের উন্নয়ন ঘটাবে এবং শান্তি রক্ষার জন্য জাতিসঙ্ঘের কার্যাবলির আরো উন্নয়ন ঘটাবে। অভিভাবকগণের তাদের সন্তানদের শিক্ষার ধরন পছন্দের বিষয়ে পূর্ব অধিকার থাকবে।’
জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার সনদে যেসব অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রসমূহের সংবিধানে ওইসব অধিকার মৌলিক অধিকার হিসবে স্বীকৃত হয়েছে।
আমাদের সংবিধানে শিক্ষার অধিকার রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে স্থান পেয়েছে। সংবিধানের ১৬নং অনুচ্ছেদে শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতকরণ রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। অধিকন্তু ১৭নং অনুচ্ছেদে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাবিষয়ে বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য; সমাজের প্রয়োজনের সাথে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য এবং সে প্রয়োজন সিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য; আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
আমাদের সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থাকে মূলত ছয় ধাপে ভাগ করা যায় যথা- প্রাথমিক, নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর।
প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা সরকারি ও বেসরকারি উভয়ভাবে পরিচালিত হয়ে এলেও একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে ছাত্রছাত্রীদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। যদিও এ শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় প্রতিটি শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে কিন্তু এখনো দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার আওতার বাইরে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান ও শিক্ষকদের যোগ্যতা বিষয়ে দেশের সচেতন জনসমাজ সন্তুষ্ট নয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে যোগ্যতাসম্পন্নরা নিয়োগবঞ্চিত হচ্ছে। শুদ্ধভাবে বাংলা বলনে ও লিখনে পারঙ্গম এ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষকের জুড়ি মেলা ভার। এ বাস্তবতায় ইংরেজির অবস্থা কী হতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর তুলনায় আসবাবপত্র অপ্রতুল এবং বিদ্যালয় ভবনও জরাজীর্ণ। এসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের নিকট থেকে বিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন যে শিক্ষা পেয়ে থাকে তা তাদের পরবর্তী ধাপের শিক্ষার জন্য যথেষ্ট নয় বিধায় একটু সচ্ছল অভিভাবকরা ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করে থাকেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য প্রতিটি থানায় থানা শিক্ষা অফিসার পদবির একজন কর্মকর্তা থাকলেও এ ধরনের অধিকাংশ কর্মকর্তা তদারকির পরিবর্তে শিক্ষকদের অনুপস্থিতি ও ত্রুটিবিচ্যুতি উপেক্ষা করেন। এর বিনিময়ে মাস-অন্তে তাদের পকেটে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থের প্রবেশ ঘটে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষাব্যবস্থার এ বেহাল অবস্থার কারণে বর্তমানে দেশের প্রায় সব এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাসম্পন্ন বাংলা মাধ্যমের কিন্ডারগার্টেন স্কুল গড়ে উঠেছে। এসব স্কুলের শিক্ষার মান তুলনামূলকভাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে শ্রেয়তর। তাই সচ্ছল অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে পরিহার করেছিলেন। এসব স্কুলের ক্ষেত্রেও দেখা যায় স্কুলের শিক্ষা পরিপূর্ণ নয়। অতএব বাধ্য হয়েই স্কুলের শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত কোচিং অথবা গৃহশিক্ষকের ওপর নির্ভর করতে হয়। ইংরেজি মাধ্যমের কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা সম্প্রতি চাহিদার আধিক্যের কারণে বিভাগীয়, জেলা ও থানা শহর ছাড়িয়ে অন্যান্য স্থানেও ছড়িয়ে পড়ছে। এসব স্কুলেও শিক্ষক ও শিক্ষার মান কাক্সিক্ষত নয়।
নারীদের শিক্ষায় উৎসাহিত ও নারীশিক্ষাকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সরকারি জুনিয়র হাইস্কুলে ছাত্রীদের শিক্ষা অবৈতনিক করার পর বর্তমানে যদিও সরকারিভাবে ছাত্রীদের স্নাতক পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার ঘোষণা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দেয়া হয়েছে কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় তিপ্পান্ন বছর ব্যাপ্তিকালের মধ্যে সাতটি শিক্ষা কমিশন, তিনটি জাতীয় শিক্ষানীতি ও দুটি শিক্ষা কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে চলমান জাতীয় শিক্ষানীতিটি ২০২২ সালে প্রণয়ন করা হয়। এ শিক্ষানীতির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে শুক্র ও শনিবার দুদিন, বাতিল হচ্ছে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি, তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকছে না, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা থাকছে না, প্রাথমিক শ্রেণীতে সবার জন্য ৮টি বই এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ১০টি বই পড়তে হবে, শুধু এসএসসিতে গিয়ে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা হবে, এসএসসি পর্যায়ে কোনো বিভাগ থাকবে না এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর দু’টি পাবলিক পরীক্ষার সমন্বয়ে ফলাফল নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে।
আগেকার শিক্ষানীতির সৃজনশীল পদ্ধতির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রছাত্রীদের কোচিংনির্ভরতার অবসান ও বাজারে বিক্রীত নোট বই, সাজেশন, টেস্ট পেপার প্রভৃতি পড়া থেকে বিরত রাখা।
আগেকার শিক্ষানীতি কার্যকর হওয়ার পর সৃজনশীল পদ্ধতির আওতায় সমাপনী পরীক্ষা ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট এবং বিষয়ভিত্তিক মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এ ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল তা অর্জিত হয়েছে কি?
অভিভাবকদের অনুযোগ সৃজনশীল পদ্ধতির প্রবর্তনের পূর্বে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রয়োজন ছিল। সে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল কি? আর প্রশিক্ষণ দেয়া না হলে সাফল্য কিভাবে আসবে? এ পদ্ধতি প্রবর্তনের পর স্কুল কলেজের বই এর দোকান ঘুরে দেখা গেল নোট বই, সাজেশন ও টেস্ট পেপারের ব্যবহার পূর্বের মতোই বহাল আছে। কোচিং এর কথা বলতে গেলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় পূর্বের তুলনায় কোচিং নির্ভরতা আরো বেড়ে গিয়েছিল। তাছাড়া পরীক্ষায় উত্তরদান পদ্ধতি সৃজনশীলে ভিন্নতর হওয়ায় প্রতিটি পরীক্ষার পূর্বে ন্যূনপক্ষে ছাত্রছাত্রীদের তিনটি মডেল টেস্ট দিতে হয়েছিল। এতে করে অভিভাবকদের বিষয়প্রতি ১৫০০-৩০০০ টাকা অতিরিক্ত গুনতে হয়েছিল।
স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো শ্রেণীতে ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা ২৫-৩০ এর মধ্যে হলে একজন শিক্ষকের পক্ষে সঠিকভাবে পাঠদান সম্ভব। কিন্তু বিশেষ করে অধিকাংশ স্কুল বা কলেজ এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শ্রেণিকক্ষে নির্ধারিত সংখ্যার ৩-৪ গুণ অধিক ছাত্রছাত্রী পড়ালেখা করছে। এ অবস্থায় কী করে একজন শিক্ষকের পক্ষে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর পড়ালেখার প্রতি মনোনিবেশ সম্ভব?
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রতি শ্রেণীতে ২৫-৩০ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য একজন শিক্ষককে একজন শিক্ষা সহকারী সহায়তা করে থাকেন। শিক্ষা সহকারীর মূল কাজ ছাত্রছাত্রীদের টিউটোরিয়াল ও ক্লাস টেস্ট গ্রহণে শিক্ষককে সহায়তা এবং ক্ষেত্র বিশেষে বুঝার অপর্যাপ্ততায় ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা। আমাদের দেশে দু’একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত এ ব্যবস্থাটি এখনো অপর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কার্যকর হতে দেখা যায়নি।
এ কথাটি নির্দ্বিধায় বলা যায় আমাদের সরকারি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শ্রমের তুলনায় বেতন স্বল্প। এমন অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন যাদের প্রতিদিন ৪০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা ব্যাপ্তির ৫-৬টি ক্লাস নিতে হয়। একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা এটা কয়দিন অব্যাহত রাখতে পারবেন। দীর্ঘদিন অব্যাহত রাখলে তিনি যে অসুস্থ হয়ে পড়বেন এটা নিশ্চিত জেনেও কর্তৃপক্ষ সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রেখেছেন।
আমাদের দেশের স্কুলসমূহে একদিনে যে পাঠ দেয়া হয় বিদেশে এক সপ্তাহে সে পাঠ দেয়া হয়। এরপর বলতে হয় প্রতিদিন যে কয়টি বিষয় পড়ানো হয় এ বিষয়সমূহের বইয়ের ভার বইতে ছাত্রছাত্রীরা অনেকটা অক্ষম। নামকরা ও ভালো স্কুলগুলোর ক্ষেত্রেও দেখা যায় স্কুলের পড়ালেখার বাইরে প্রতিটি ছাত্রছাত্রী স্কুল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দ্বারা পরিচালিত কোচিংয়ে অংশগ্রহণ করছে। আবার দু’একটি বিষয়ের জন্য বাসায় গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। এতে করে একজন ছাত্রছাত্রী স্কুলে, কোচিংয়ে এবং গৃহশিক্ষকের নিকট অধ্যয়নে ১০-১২ ঘণ্টা ব্যয় করলে সে বিশ্রামইবা নিবে কখন আর নিজের পাঠ প্রস্তুত করবে কখন? এ কথা অনস্বীকার্য যে, কোচিং না করলে পরীক্ষায় কাক্সিক্ষত ফল আসে না। এরই সুযোগে এমন অনেক শিক্ষক আছেন যারা কোচিং-এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বিবেচনায় ক্লাসে সঠিকভাবে পাঠদান করেন না।
ইদানীং অধিকাংশ বেসরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে দেখা যায় বিষয়বিহর্ভূত শিক্ষক দিয়ে একাধিক বিষয় পড়ানোর কারণে ছাত্রছাত্রীরা সঠিক পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সমাজ বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে বাংলা, ধর্ম ও অর্থনীতি বিষয়সমূহ পড়ানো হচ্ছে। কিছু কিছু সরকারি স্কুলের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বর্তমানে যেসব স্কুল একটু ভালোমানের এসব স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা দুই থেকে পাঁচ কোটি টাকা খরচ করতে দ্বিধা করেন না। এ বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয়ের পিছনে যে অসৎ উদ্দেশ্য নিহিত তা হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ ও ছাত্রছাত্রী ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে নির্বাচনে ব্যয়িত অর্থের ৩-৪ গুণ অধিক অর্থ উপার্জন। বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায় অধিকাংশ নির্বাচিত অভিভাবক প্রতিনিধি তাদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থে সমর্থ হন। সম্প্রতি ভর্তিবাণিজ্য নিরোধকল্পে কিছু কিছু স্কুলে লটারির মাধ্যমে ছাত্রছাত্রী ভর্তি প্রথা প্রচলন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে একদিকে ভালো স্কুলগুলো কাক্সিক্ষতমানের ছাত্রছাত্রী প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হচ্ছে অপর দিকে লটারির নামে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ভর্তি বাণিজ্য করে স্কুল পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট একশ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট স্কুলসমূহ এসব প্রক্রিয়ায় নিজ নিজ মান রক্ষার ক্ষেত্রে কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নিরূপণ করতে আমাদেরকে হয়তো আগামী দু’চার বছর অপেক্ষা করতে হবে।
মেধাবী ও কৃতী ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দিতে অতীতে যারা ভালো ফলাফল করত তাদেরকে ফলাফলের মানক্রম অনুযায়ী বৃত্তি প্রদান করা হতো। সম্প্রতি বৃত্তি প্রদানের ক্ষেত্রে লটারিপ্রথা প্রবর্তনের কারণে ফলাফলের এ মানক্রম রক্ষিত হচ্ছে না। এর ফলে দেখা যায় সব বিষয়ে এ প্লাস পাওয়ার পরও লটারিতে নাম না ওঠার কারণে বৃত্তি প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হচ্ছে অপরদিকে শুধু পাঁচ বিষয়ে এ প্লাস পেয়ে লটারিতে নাম উঠায় অনেকটা ভাগ্যগুণে বৃত্তি পাচ্ছে। এতে করে মেধাবী ও ভালো ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।
বর্তমানে স্কুলের মানভেদে একজন অভিভাবককে স্কুলের বেতনের বাইরে কোচিং ও গৃহশিক্ষক সংশ্লেষে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে তার পরিমাণ স্কুলের বেতনের চেয়ে ১০-১৫ গুণ বেশি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে একজন অভিভাবক বেতনের বাইরে এ অর্থ ব্যয় করতে পারলে কেন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বেতন বৃদ্ধি করে আকর্ষণীয় বেতনে সুশিক্ষায় শিক্ষিত ও মেধাবীদের শিক্ষকতার পেশায় আকৃষ্ট করে, ছাত্রছাত্রী অনুপাতে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ এবং ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষাসহকারী নিয়োগের মাধ্যমে স্কুলে অবস্থানকালীন পরিপূর্ণ শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না? আর যদি কোচিং এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় সেটা স্কুলের উদ্যোগে হবে এবং স্কুল প্রাঙ্গণে স্কুলের নির্ধারিত সময়ের পর এর ব্যাপ্তি এক ঘণ্টার অধিক হওয়া কাম্য নয়।
বিগত বেশ কয়েক বছর যাবৎ মাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমের সব ছাত্রছাত্রীদেরকে বোর্ডের বইসমূহ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ব্যবস্থাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সরকারি জুনিয়র হাইস্কুলের মধ্যে সীমিত রাখলে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় হতো এবং এ অর্থ সঠিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্যয় করা যেত। শহর অঞ্চলের একজন অভিভাবক তার সন্তানের শিক্ষার পিছনে মাসে গড়ে ৪-৫ হাজার টাকা ব্যয় করতে পারলে তার পক্ষে সরকার প্রদত্ত শ্রেণীভেদে ২০০-১০০০ টাকা বার্ষিক পুস্তক ক্রয়ের জন্য ব্যয় করা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়।
বোর্ডের বই বিতরণে বর্তমান বছর কর্তৃপক্ষ সাফল্য দেখাতে পারলেও নিকট অতীতে প্রতি বছর দেখা গেছে শিক্ষা বছরের প্রথম ৩-৪ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও বই বিতরণের কাজ শেষ হয়নি। বোর্ডের বিতরণকৃত বইয়ের মধ্যে বানান ভুল, ছাপা অক্ষরের অস্পষ্টতা ও পর্যায়ক্রমিকভাবে পৃষ্ঠা নং সক্রান্ত সমস্যাগুলো উত্তরণে এখনো বোর্ড কর্তৃপক্ষ সফলতা দেখাতে পারেনি।
বেসরকারি জুনিয়র হাইস্কুল ও মাধ্যমিক স্কুলের যেসব শিক্ষক-শিক্ষিকা এমপিওর আওতাভুক্ত তারা তাদের মূল বেতনের বেশির ভাগ সরকার থেকে অনুদান হিসেবে পেয়ে থাকেন। অন্যান্য ভাতাদি স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রদান করে থাকে। শিক্ষকদের এমপিওর আওতাভুক্তি ও উচ্চতর বেতন স্কেল এবং উচ্চতর টাইম স্কেল প্রাপ্তিতে কী পরিমাণ ভোগান্তির শিকার হতে হয় তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই অনুধাবন করেন। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ জেনেও না জানার ভান করে থাকেন। বেসরকারি কলেজের ক্ষেত্রেও চিত্রটি ভিন্নতর নয়।
বিভিন্ন বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গৃহীত পরীক্ষাসমূহ যথা- সমাপনী, জেএসসি, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক, স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর এর চূড়ান্ত ফলাফলের ক্ষেত্রে দেখা যায় যথাসময়ে ফলাফল প্রকাশের ব্যর্থতা অনেকাংশে ঘুচাতে পারলেও ফলাফলে অনিয়ম ও ভুলের বিষয়গুলো পরিহার এখনো সম্ভব হয়নি। ফলাফল প্রকাশে অনিয়ম ও ভুলের কারণে অযথা ছাত্রছাত্রীদের বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে।
বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে কিছু কিছু বিষয়ে প্রথম শ্রেণী প্রাপ্তির ব্যাপকতা এত বেশি যে তা অনেক সময় সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থীকে হতবাক করছে। পূর্বে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ইংরেজি সাহিত্যে দু’চার বছর অন্তর স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় দু’একজনের প্রথম শ্রেণী প্রাপ্তির সৌভাগ্য হতো। কিন্তু এখন ইংরেজিসহ অনেক বিষয়েই সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরীক্ষার্থী স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি/এ প্লাস প্রাপ্ত সৌভাগ্যবানের খাতায় নিজেদের নাম লিখাচ্ছেন। ১ম শ্রেণী/এ প্লাস প্রদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের স্বজনপ্রীতির বিষয়টি এখন আর গোপন কিছু নয়।
এলএলবি (অনার্স) ও এলএলএম কোর্স চালু আছে এমন দু’চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় আইন বিভাগের ডিন, চেয়ারম্যান ও শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এমন সব ব্যক্তি যারা সাধারণ কলেজ থেকে আইনের ডিগ্রিধারী। এর বাইরে তাদের অতিরিক্ত যোগ্যতা হচ্ছে বিচার বিভাগে চাকরি করার অভিজ্ঞতা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সাধারণ কলেজ থেকে আইনের ডিগ্রিধারী কী করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন, চেয়ারম্যান ও শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন? পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সাধারণ স্নাতক ডিগ্রিধারী স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষকতা করছেন এমন নজির আছে কেউ কি দেখাতে পারবেন? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় ভর্তি ফি ও কোর্স ফি বাবদ যে অর্থ নিচ্ছেন তা অঙ্কের হিসেবে ৫০-১০০ গুণ বেশি। এ বর্ধিত ফি নেয়ার পরও কী করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিম্নমানের শিক্ষক দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতির সম্মুখীন করছেন তা জানার অধিকার কি ছাত্রছাত্রীদের নেই?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যায় সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ সুবিধার মধ্যে বিরাট ফারাক। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ যে মানের ছাত্রছাত্রী প্রাপ্ত হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর মান তার চেয়ে কম হলেও অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাঠক্রম সমাপ্ত করে ছাত্রছাত্রীদের স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদানে সমর্থ হচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাঠক্রম সমাপনান্তে পরীক্ষা গ্রহণ ও ডিগ্রি প্রদানে তেমন একটা সফলতা দেখাতে সক্ষম হচ্ছে না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিষয়ে অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পিছনে সময় ব্যয় না করে বিভিন্ন দাতা সংস্থার পরামর্শক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় সময় ব্যয় করছেন। এতে করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষার মান দিন দিন নিম্নমুখী হচ্ছে।
প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা থেকে উত্তরণ সম্ভব না হলে দেশে যতই শিক্ষা কমিশন গঠন ও শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হোক না কেন কোনো শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষানীতিই কার্যকর ফল দেবে না। তাই শিক্ষা কমিশন গঠন ও শিক্ষানীতি প্রণয়নের পূর্বে নীতিনির্ধারকদের অনুধাবন করতে হবে শিক্ষা ক্ষেত্রে মূল সমস্যাসমূহ কী কী এবং এ সমস্যাসমূহের সমাধান কোথায়? আর তাতেই শিক্ষা কমিশন গঠন ও শিক্ষানীতি প্রণয়ন সার্থক হবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন