ড. মুহাম্মদ ইউনূস
17 March 2024, Sunday
তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। যদিও আমার বিভাগ ইংরেজি, তার পরও অন্যান্য বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকদের সাথে সম্পর্ক ছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সেই সূত্রে যোগাযোগ। তাকে দেখতাম, একটি ছোট্ট সাদা প্রাইভেট কারে করে যাচ্ছেন। সালাম দিলে তিনি চলন্ত গাড়ি থেকে সালামের জবাব দিতেন। এ গুণটি বাংলার অধ্যাপক মরহুম কবি আবু হেনা মোস্তফা কামালেরও ছিল। শুনতাম ড. ইউনূস তার রাশিয়ান স্ত্রী ভেরা ইউনূসকে নিয়ে পাশের গ্রামে ঘুরে বেড়ান। এক দিন শহর থেকে ক্যাম্পাসে ফিরছি। পথে জোবরা গ্রামের বাজারে ইউনূস সাহেবকে দেখতে পাই। সাথে বোধহয় তার স্ত্রীও ছিলেন। এই বাজারে নবযুগ তেভাগা খামারের অফিস। ইউনূস সাহেবের প্রতিষ্ঠিত এই খামার তখন প্রেসিডেন্ট পদক পায়। ইউনূস সাহেব সম্ভবত খামারের কোনো মিটিংয়ে এসেছিলেন। সকাল থেকে মিটিং করে তিনি ফিরছিলেন ক্যাম্পাসে। এলাকার লোকজন ও ছাত্ররাও তার ভক্ত ছিল। আমাদের দু’জন পরিচিত ছাত্র তার খামারে কাজ করতেন। তারা পরে গ্রামীণ ব্যাংকে বরিশালে কাজ করেন। ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংককে প্রথমে একটি প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করেন। ওই প্রকল্পের পরিচালক ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে প্রকল্প থেকে একটি পৃথক ব্যাংক হয়। ড. ইউনূস ছাত্রজীবন থেকে মেধাবী ছিলেন এবং তার হাসি ছিল বড় সুন্দর। তিনি ১৯৬১-৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। তিনি চীনের সংস্কার নীতির একজন বড় সমর্থক ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অর্থনীতি বিভাগ’ খোলেন তিনি। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক প্রথিতযশা শিক্ষককে আনেন। ইদানীং তিনি বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছেন।
তার ভাইদের মধ্যে একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন এবং স্কুলশিক্ষার্থীদের জন্য বিজ্ঞানবিষয়ক একটি পত্রিকা স্বল্পমূল্যে দীর্ঘদিন বের করতেন। বোধহয় পত্রিকাটি এখনো বের হয়।
তার আরেক ভাই মরহুম মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর ঢাকার সাংবাদিক মহলে সুপরিচিত। তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রথিতযশা প্রশিক্ষক ছিলেন এবং পরে একটি এনজিও দেন। তাদের সব ভাইয়ের হাসি একই রকম। ড. ইউনূসের বাবা হাজী দুলামিয়া সওদাগর নামকরা স্বর্ণ ব্যবসায়ী ছিলেন এবং চট্টগ্রামের কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকায় তার নিজস্ব বাড়ি ছিল।
কিন্তু তিনি তার ছেলেদের পড়াশোনার ব্যাপারে খুব সজাগ ছিলেন। ইউনূস সাহেব চট্টগ্রাম শহরের একটি পুরনো এলাকায় প্রাইমারি স্কুলে জীবনের প্রথম পাঠ গ্রহণ করেন। এই স্কুলে সাধারণ ঘরের ছেলে থেকে শুরু করে অভিজাত পরিবারের সন্তানরাও পড়তেন। ইউনূস সাহেব তার আত্মজীবনীতে এই স্কুলের ছাত্রজীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমাদের দেশের একজন কৃতী সন্তান। তিনি ২০০৬ সালে কিংস পার্টির জন্য সমালোচনার পাত্র হয়েছেন। ওই সময় তিনি নোবেল পুরস্কার পান। তিনি আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছ থেকে একটি পুরস্কার নিয়েছেন। অবশ্য নোবেল পুরস্কার নিয়েছেন ইউরোপ গিয়ে। ইউনূস সাহেব বাংলাদেশের কৃতী সন্তান হলেও তাকে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছে। তিনি দেশে থাকা সত্ত্বেও প্রতিবেশী দেশের এক নাগরিককে এনে বইমেলা উদ্বোধন করা হয়। বর্তমান সরকারের সাথে তার দ্বন্দ্বের কারণ কী, তা স্পষ্ট নয়। সরকার বলছে- তার নামে মামলা করেছে একটি জাতীয় সংস্থা এবং এখানে সরকারের রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য নেই। অন্য দিকে তার পক্ষের লোকজন বলছেন, সরকারি সংস্থা তার নামে মামলা করার আগে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অনুমতি নিয়েছে এবং তাকে বৃদ্ধ বয়সে অহেতুক হয়রানি করা হচ্ছে। সরকার তা অস্বীকার করছে। ড. ইউনূস সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তার কয়েকটি সংস্থা দখল করা হয়েছে এবং তা সরকারের ইঙ্গিতেই ঘটেছে। ওই সব সংস্থা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, দিনে কাজে ব্যাঘাত না হওয়ার জন্য রাতে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়া হয়েছে। এ দিকে ইউনূস আপিল করার জন্য কোটি কোটি টাকা কোর্টের নির্দেশমতো দাখিল করেছেন। এ নিয়েও প্রচারণা চলছে। অন্য দিকে সরকার তার নিন্দামন্দ করেই চলেছে। তার চেয়েও বড় সুদখোর আছে, তার পরও তাকেই দেশে সুদি কারবারের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক মহিলাদের কর্মসংস্থান করে দিয়েছে, সে কথা বলা হচ্ছে না। শুধু সুদের জন্য তাকে দায়ী করা হচ্ছে। ইউনূস সাহেবের লোকজন সাধারণত চুপ করে থাকেন বলে সরকারি প্রচারণা হালে পানি পাচ্ছে। ইতোপূর্বে গ্রামীণফোনে তার হিস্যা নিয়ে কথা উঠেছিল; তিনি তা অস্বীকার করেছেন। জানিয়েছেন, একসময় তার সাথে ওদের সম্পর্ক ছিল, কিন্তু পরে আর নেই। এখন ইউনূসের দিন কাটে কোর্ট থেকে কোর্টে দৌড়াদৌড়ি করে।
ড. ইউনূস তো রাজনীতি করেন না, তিনি কেন কিংস পার্টি করতে গেলেন? এটি না করলে হয়তো সরকারের সাথে তার দ্বন্দ্ব হতো না, সরকারের উচ্চ মহল হয়তো মনে করছে, তিনি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। আসলে তিনি তা নন। এ বৃদ্ধ বয়সে তাকে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে অনেকেরই সহানুভূতি হবে। তিনি তো এখন গ্রামীণ ব্যাংকের কিছু নন। তাকে তার সম্মানের স্থানেই রাখা উচিত। ড. ইউনূস দেশকে অনেক দিয়েছেন; আরো দেবেন বলে আশা করি। তাকে সেই সুযোগ দেয়া উচিত। সরকার বা ক্ষমতাসীন কোনো মহল তাকে হয়রানি করা উচিত নয়। তাকে কাজে লাগাতে পারলে সরকারেরই লাভ। আন্তর্জাতিক মহলে তার যে সুনাম রয়েছে এবং পাশ্চাত্য মহলে তার যে যোগাযোগ রয়েছে, তাকে ব্যবহার করা উচিত। ড. ইউনূস অচিরেই সব মামলা থেকে অব্যাহতি পাবেন বলে আশা করি।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন