নাসিক নির্বাচন : কিছু কথা
22 January 2022, Saturday
নারায়ণগঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিটির মেয়র নির্বাচনে এবার ভোট পড়েছে কত? বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকদের মতে, মাত্র ৩১ থেকে ৩৫ শতাংশ ভোট সেখানে দেয়া হয়েছে। তবে বিভিন্ন নির্বাচন পরিচালনাকারী জাতীয় সংস্থা হিসেবে নির্বাচন কমিশন বা ইসির অভিমত, না’গঞ্জে প্রায় অর্ধেক ভোটার ভোট দিলেন এবার যা বেশ সন্তোষজনক। যেখানে রাতের ভোটে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর দেশের মানুষের আস্থা নস্যাৎ হয়ে গেছে এবং ৫-১০ শতাংশের অধিক মানুষ সাম্প্রতিককালে সন্ত্রাস দেখে ভোটকেন্দ্রে যাননি, সেখানে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ ভোটারের নির্বাচনে অংশ নেয়াকে অনেকেই ‘খুশির খবর’ মনে করছেন। অথচ ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও (অর্থাৎ প্রায় ৬ দশক আগেও) প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ ভোট দিতে গেছেন বলে অনেকেই জানান।
বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হয়ে এলো। পরের ইসি কেমন হয়, আল্লাহ তায়ালাই জানেন। তবে জনগণের আস্থা ধরে রাখাই হবে তার বড় কাজ। অন্যথায় যত উচ্চশিক্ষিতই ইসির দায়িত্ব নিন না কেন, তাতে কোনো লাভ নেই। নির্বাচন ‘গণতন্ত্রের প্রাণ’ যদিও ভোটই সব কিছু নয়। কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে গণতন্ত্র হয় কলঙ্কিত। তখন আইনের শাসন থাকে না এবং ভোটারের অধিকার হয় লঙ্ঘিত। বাংলাদেশে নিকট অতীতে এটাই বারবার দেখা গেছে। তবুও প্রশাসন দৃশ্যত বেখবর এবং আত্মতৃপ্ত। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও নির্বাচন আছে যদিও তা কারো ধারণায় ‘বিকৃত’, কারো দৃষ্টিতে ‘হাইব্রিড’। এখন আমাদের নিজ স্বার্থেই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন চালু করতে হবে। এটা দরকার জাতির কল্যাণে এবং সরকারের ইমেজ কায়েমের জন্য। তা না হলে একদিন না একদিন আমাদের ‘আটকে যেতে হবে’ যা কারো কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে ইসির ভূমিকাই সর্বাগ্রগণ্য। তাদের সৎসাহসের পরিচয় দিয়ে জনগণকে সঙ্কট থেকে উদ্ধার করতে হবে। নির্বাচন কমিশন নিজের ক্ষমতা ও অধিকার সম্পর্কে আগে সজাগ হতে হবে। ভারত ও পাকিস্তান থেকে এ ব্যাপারে আছে অনেক শিক্ষণীয়।
এবার নাসিক নির্বাচনে একটি বহুলালোচিত বিষয়ের নাম ইভিএম যার পুরো অর্থ ইলেকট্রনিং ভোটিং মেশিন। তবে লোকজন এ মেশিনকে ব্যঙ্গ করে কেউ বলেন ইভএ ভোটিং মেশিন, ইলেকট্রনিং ভেইন মেশিন, কেউ বা ইলেকট্রনিক ভ্যান্ডালাইজিং মেশিন, এমনকি কেউ কেউ ইলেকট্রনিক ভ্যানকুইশিং মেশিনও বলে থাকেন। এখানে ইভ্এ্ মানে মন্দ, ভেইন অর্থ ‘ব্যর্থ, ‘ভ্যান্ডালাইজিং মানে ভাঙচুর ও পয়মাল আর ‘ভ্যানকুইশিং’ মানে একেবারে, বরবাদ করে ফেলা। এবারে না’গঞ্জ সিটি করপোরেশন বা নাসিক নির্বাচনে নির্ধারিত সময়ের পরেও দীর্ঘ সময় ভোট নেয়ার প্রধান কারণ ইভিএম। তাই মানুষ আধুনিক এ যন্ত্রের ওপরও আস্থা রাখতে পারছেন না। বরং তারা ব্যালটেই ভোট দিতে চান। তাদের কথা, ‘ইভিএম মানে কী, তা এবার স্পষ্ট হলো।’ আর কর্তৃপক্ষের বড় কর্তাদের কথা, ‘কোথাও কোথাও ইভিএম ত্রুটিমুক্ত না থাকায় এবং মহিলা ভোটারদের এ যন্ত্রের পরিচালনা বুঝতে অসুবিধা হওয়ায় কারো কারো ভোট দিতে সময় বেশি লেগেছে।’
তবে সে সময়ের পরিমাণ ৮-১০ মিনিট বলে বাইরে লাইনে অপেক্ষমাণ ভোটারদের ক্ষোভের কারণ হয়েছে ইভিএম। এ বিলম্বের দরুন কোথাওবা নির্ধারিত সময়ের পরে সন্ধ্যা নাগাদও ভোট নিতে হলো। অত্যাধুনিক ব্যবস্থার কারণে এ নির্বাচনের ফলাফল দিতে তেমন দেরি হয়নি। কিন্তু ইভিএম ত্রুটিযুক্ত হওয়া অথবা মহিলাদের এ যন্ত্র না বুঝার পক্ষে যুক্তি দিতে পারেননি কর্তৃপক্ষ। নির্বাচন কমিশন ইভিএম নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেয় না বলে অভিযোগ উঠেছে। তারা মেয়েদের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেরা পার পেতে চান বলে অনেকের ধারণা। প্রশ্ন ওঠে, সচেতন করার কার্যক্রমে মেয়েদের পর্যাপ্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব কি নির্বাচন কমিশনের নয়? তারা তো এ দায় অন্যের ঘাড়ে দিতে পারেন না।
নারায়ণগঞ্জে বিএনপির অন্যতম কাণ্ডারি এবং স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় নানা বিচার বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। দল থেকে তার বহিষ্কার ব্যতীতও বলা হচ্ছে, তিনি কৌশলে ‘ভুল’ করেছেন। যদি তিনি জিততেন (যা অনেকের ধারণা ছিল) তাহলে এসব মহলই উল্টো বলতেন হয়তো। কথায় বলে, Success has many sons but failure has none (সাফল্যের অনেক ‘পুত্র,’- তবে ব্যর্থতার কেউ নেই) তৈমূর হয়তো সবকিছু ঠিক করেননি। তবে এটাও সত্য, তার দলের সবাই কোমর বেঁধে তার পক্ষে নামেননি। তার নির্বাচনী পরাজয় শেষেই তাকে দল থেকে বহিষ্কার করায় প্রশ্ন ওঠে, হেরে যাওয়াটাই কি তার বড় দোষ? তা না হলে তো তাকে নির্বাচনের আগেই দল থেকে বের করে দেয়া যেত। তা কেন করা হলো না? তার প্রধান সমন্বয়কারী এবং বিএনপির সুপরিচিত স্থানীয় নেতা এটিএম কামালও এখন বহিষ্কৃত। এতে দলের লাভক্ষতি পরে বোধগম্য হবে। তৈমূর আলম দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে বলেছেন, ‘আমাকে বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো- যারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা চেয়েছেন নৌকা মার্কা নির্বাচনে জিতুক। না’গঞ্জে সিটি নির্বাচনে আমার প্রতীক ‘হাতি’র পক্ষে যারা কাজ করেছেন, তাদের দল থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে। আর ক্ষমতাসীনরা পদক্ষেপ নিয়েছেন তাদের প্রতীকের পক্ষে যারা কাজ করেনি, তাদের বিরুদ্ধে।’ মোট কথা, যারা এবার তৈমূর আলমের সাথে ছিলেন, তারা ঘরও হারালেন, পরও হারালেন। তাদের হয়রানি করা হয়েছে প্রতিপক্ষ থেকে যা নির্বাচনের আগে ও প্রাক্কালে। আর বহিষ্কার করা হয়েছে স্বদল বিএনপি হতে যা ভোটাভুটির পরে। তৈমূর যদি নির্বাচনে জিততেন, তা হলে কি দল তার ও তার লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত?
নাসিক নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভী জেতার মতো স্বাভাবিক ঘটনাই ‘চমক’ হিসেবে এসেছে। তবে পরাজিতের সাথে তার ভোট ব্যবধান কমেছে। দলের একাংশের বিরোধিতায় আইভীও তা আশঙ্কা করেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর মুখ রক্ষা করেছেন তিনি জিতে। তবে তার নিজের ‘সব রক্ষা’ পায়নি বলে মানুষের মনে হচ্ছে। কারণ তিনি নিজ দলের সবার ভোট পাননি বলে ধরে নিতে হয়। তদুপরি, নিজের ঘোষণা মোতাবেক ‘লক্ষাধিক’ ভোটে জেতাও সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। জিতলেন ৬৯ হাজার ভোটের ফারাকে। আইভীর চমক লাগা বিজয় ছিল যেবার তিনি আওয়ামী লীগের দোর্দণ্ড প্রতাপের নেতা ও এমপি শামীম ওসমানকে লক্ষাধিক ভোটে হারালেন। পরেরবার তার ভোট ব্যবধান ২০ হাজার কমান বিএনপির আইনজীবী প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন। এবার তা আরো কমেছে।
প্রধানমন্ত্রী আইভীকে ‘জেতার প্রার্থী’ করে সফল হয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন, না’গঞ্জে আইভী দাঁড়ালে আওয়ামী লীগ নেতানেত্রী কেউ জিতবেন না। আইভীর পিতা মরহুম চুনকা মিয়া দীর্ঘকাল আওয়ামী লীগ করেও দলের নমিনেশন পাননি চেয়ারম্যান পদে। তেমনি আইভীও এ দলের গুডবুকে একসময় ছিলেন না। তবে এখন দল তার স্বার্থে তাকে কদর দিচ্ছে।
দেওভোগের আলী আহমদ চুনকা ডা: সেলিনা হায়াৎ আইভীর পিতা এবং নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের অন্যতম পুরোনো নেতা। ১৯৭৩ সালে তিনি না’গঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান (তখনো সিটি করপোরেশন হয়নি) নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রথমবারের মতো। ক্ষমতাসীন দলের তখন একচ্ছত্র নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যিনি একই সাথে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও সংসদীয় প্রধান। তখন চুনকার বিজয় সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিল। তিনি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের লোক হলেও কেন এটা হলো? কারণ, তিনি ‘মুজিবের প্রার্থী’ ছিলেন না। সে সময় স্থানীয় সরকারে নির্দলীয় নির্বাচন হতো এবং প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে এমন প্রতীক নিয়ে নামতেন যা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতীক হতো না। শেখ মুজিবের আশীর্বাদ পেয়েছিলেন খাজা মহিউদ্দিন। তবুও চুনকা জিতেছিলেন। এরপর তাকে স্বয়ং মুজিব বলেছেন, ‘জানতাম, তুই জিতবি।’ কথা হলো, ‘যদি জানতেনই যে, তিনি জিতবেন। তা হলে কেন তার বদলে ‘হারু পার্টি’কে সমর্থন দিলেন?’ এর জবাব নাই।
না’গঞ্জের নির্বাচন প্রসঙ্গে এলে এ শহরের কিছু স্মৃতি মনের পটে উঁকি দেয়। তদানীন্তন মহকুমা শহরটির ছিল বৃহত্তর ঢাকার অন্তর্গত এবং সুদূর নরসিংদী- রায়পুরাও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই না’গঞ্জ মহকুমাটি ছিল বেশ বড়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দিকে নারায়ণগঞ্জে ছিলাম। দুলাভাই ছিলেন শহরের কালীরবাজারে ব্যাংক ম্যানেজার। আর আমরা ক’জন ফাঁকা শহরে ঘুরতাম। শহরটার উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু সড়ক (আগে বোধ হয় ‘কায়েদে আজমের’ নামে ছিল)। আমরা ভাবতাম, নতুন রাষ্ট্রে সব কায়েদে আজম’ হবে ‘বঙ্গবন্ধু’, আর সব ‘জিন্নাহ’ হয়ে যাবে ‘মুজিব’। তা হলে মুজিবনগরের প্রধানমন্ত্রী ও নেতা তাজউদ্দীনের নামে কী হবে? ‘লিয়াকত আলীর বা ‘কায়েদে মিল্লাত’ নামে যা কিছু আছে, তা হবে তাজের নামে। তবে স্বাধীন দেশে পরে তাকে নিয়ে কী হলো, সবার জানা। যে সময়ের কথা বলছি তখনো ‘ওসমান পরিবার’ নারায়ণগঞ্জে নামকরা। বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগ। বিএনপির তখনো আবির্ভাব হয়নি। না’গঞ্জে দক্ষিণপন্থীরা তেমন জোরালো ছিল না। বরং বামপন্থী মোন্যাপ ছিল দ্বিতীয় স্থানে। আওয়ামী লীগের এমপি ছিলেন আজকের শামীম ওসমানের বাবা মরহুম একেএম শামসুজ্জোহা। তারা তখনো থাকতেন পৈতৃক বাড়ি, চাষাঢ়ার প্রসিদ্ধ বায়তুল ওসমানে। ন্যাপ নেতাদের মধ্যে অ্যাডভোকেট মঈনুদ্দিনের নাম সর্বাগ্রে। মাঝে মাঝে জোহা সাহেবের এক ছোট ভাই আমাদের সঙ্গী হতেন। জোহা সাহেবের বাবা মরহুম খান সাহেব ওসমান আলী পাটের ব্যবসায় করে নাম করেছিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি দাউদকান্দি। তিনি ছিলেন দেশের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী (মুসলিম) লীগের অন্যতম প্রাণপুরুষ। পরাজিত পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের কথাও মনে পড়ে। তাদের নিতে ভারত থেকে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, গোমতি, যমুনা, প্রভৃতি নামের জাহাজ এসেছিল। শত শত লোক ঘাটে তাদের দেখতে যেত। আমরাও না’গঞ্জের আমলাপাড়ার বাসা থেকে যেতাম। যেতে ‘পতিতা’ পল্লী পার হতে হতো। কোনো ‘পতিত’র দেখা মিলত না দিনের বেলায়। তখনো ‘পতিতা’ কী বুঝিনি। তবে ওদের সবার গায়ের এক রঙ দেখে খটকা লাগত। যা হোক, না’গঞ্জে ডানপন্থীদের মধ্যে প্রধানত মুসলিম লীগ সক্রিয়। জামায়াত ছিল না এ শহরে। একদিন না’গঞ্জ টার্মিনালে লাশ ভাসতে দেখি। মাড়োয়ারিরা যুদ্ধের সময় ছিলেন না হিন্দু বলে। তাদের একজন দুলাভাইকে তার সবকিছু দেখতে বলে ভারতে পাড়ি দেন। দুলাভাই আমানতদারি বজায় রাখেন।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন