অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্রনীতি
18 September 2024, Wednesday
পাঁচ সপ্তাহের বেশি সময় পার হওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র কৌশল বাস্তবে অবয়ব নিতে শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। সরকারের প্রথম কয়েক সপ্তাহ পার হয় দেশে কার্যকর শাসন প্রতিষ্ঠা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্বাভাবিকীকরণে।
এখন সরকারের সংস্কারকাজ শুরু করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা দুই দফা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। দুইবারই পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ে কম বেশি কথা বলেছেন। তিনি একাধিক বিদেশউ মিডিয়ার সাথে সাক্ষাৎকারেও এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তবে গত এক সপ্তাহে পররাষ্ট্র কৌশল নির্ধারণে বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে।
আমেরিকান ট্রেজারি বিভাগের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান-এর নেতৃত্বাধীন আমেরিকান প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। এই টিমে দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুও রয়েছেন। প্রতিনিধিদলটি প্রধান উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সাথে পৃথক পৃথকভাবে বৈঠক করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কামনা করেছেন। এ ব্যাপারে আমেরিকান প্রতিনিধিদল ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে।
১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যে দৈন্যদশা সৃষ্টি হয়েছে তাতে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সহায়তা ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে নতুন অভিযাত্রার ভিত্তি তৈরির লক্ষ্য অর্জন বেশ কঠিন। তবে প্রশ্ন হলো, এই অঞ্চলে নানামুখী প্রতিযোগিতা ও স্বার্থ দ্বন্দ্বের বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ভারসাম্য সরকার কিভাবে রক্ষা করবে?
নতুন গতিপথ
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ৮ আগস্ট একটি অন্তর্বর্তী সরকার নেতৃত্ব গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। এই রূপান্তরটি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করে। কারণ নতুন প্রশাসনকে দেশের বৈদেশিক নীতির দিকনির্দেশনায় পরিবর্তনের সম্ভাব্য অভিনেতা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অধ্যাপক ইউনূসের সরকার স্পষ্ট করেছে যে, তার প্রশাসন পররাষ্ট্রনীতিতে সব দেশের সাথে সমান আচরণ করবে।
জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার ওপর নির্মাণে জোর দেন। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো এই নীতিগত বক্তব্যের বাস্তব প্রয়োগটি কেমন হবে?
এর আগের হাসিনা সরকার ‘কারো সাথে বৈরিতা নয় সবার সাথে বন্ধুত্ব’ নীতির কথা বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিকে মূলত ভারত নির্দেশিত নীতিতে পরিণত করেছিল। আর শেখ হাসিনার পলায়নের পর বাংলাদেশে পরিস্থিতি অস্থির করার নানা আয়োজনে প্রতিবেশী দেশটির সক্রিয় প্রভাব লক্ষ করা গেছে। পতিত স্বৈরাচার ভারতে অবস্থান করেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে একের পর এক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। এসব বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের আগ্রাসী নীতি গ্রহণেরই সঙ্কেত।
বৈদেশিক নীতি নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস তার প্রথম নীতিগত ভাষণে, প্রশাসনের অগ্রাধিকারের রূপরেখা তুলে ধরেন। তিনি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে, বিশেষ করে পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান ধরে রাখার গুরুত্বের ওপর জোর দেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সঙ্কটের মতো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোও মোকাবেলার কথা বলেন।
তিনি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। এটি এমন একটি অবস্থান যা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রতি তার প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি জোরদার করে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্রনীতির দিকনির্দেশনা তৈরি করেছেন পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো: তৌহিদ হোসেন। বৈশ্বিক শক্তির সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে জনাব হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশকে অবশ্যই বিশেষ দেশের প্রতি পক্ষপাতিত্ব এড়িয়ে সব দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি একটি ন্যায়সঙ্গত বৈদেশিক নীতির প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের বৃহত্তর প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সমর্থন
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক পদক্ষেপে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বাংলাদেশের ইতিহাসের এই সঙ্কটময় সময়ের মধ্য দিয়ে প্রফেসর ইউনূস ও তার প্রশাসনের সাথে কাজ করার জন্য তাদের প্রস্তুতির কথা ব্যক্ত করেছেন। মিলার সহিংসতা বন্ধের জন্য প্রফেসর ইউনূসের আহ্বানকে স্বাগত জানান এবং দেশের জন্য একটি গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের গুরুত্বের ওপর জোর দেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে। ইইউর উচ্চ প্রতিনিধি ও পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেফ বোরেল বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং সাম্প্রতিক সহিংসতার জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। বাংলাদেশ থেকে বছরে ২৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানিকারী ইইউ এই ক্রান্তিকালে বাংলাদেশে সুশাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মানের উপর জোর দিয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া মিশ্র মনে হয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ইসলামাবাদ ও ঢাকার মধ্যে সহযোগিতা আরো গভীর করার আশা প্রকাশ করে অধ্যাপক ইউনূসকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এটি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের সম্ভাব্য উষ্ণতার ইঙ্গিত দেয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়ে অধ্যাপক ইউনূসকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। মোদির বার্তাটি আঞ্চলিক নিরাপত্তায় তার দেশের জন্য বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার বিশেষ তাৎপর্য তুলে ধরে।
দিল্লি কী বার্তা দিচ্ছে?
ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রধান উপদেষ্টাকে অভিনন্দন জানিয়ে যে বার্তা দিয়েছেন তাতে একধরনের শীতলতা অনুভব করা যায়। দেশটির মিডিয়া ও থিংকট্যাংকগুলো অব্যাহতভাবে বলে চলেছে ভারতের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশে ভারতবান্ধব বা অনুগত সরকার প্রয়োজন।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের জন্য জনগণ নিজেদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেবে নাকি ভারতের প্রয়োজন অনুসারে অনুগত নীতি বজায় রাখবে।
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে যোগদানের আগে, অধ্যাপক ইউনূস একটি সাক্ষাৎকারে জোর দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের উন্নয়ন ভারতীয় জনগণের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে এবং তিনি তার বিশ্বাস ব্যক্ত করেন যে বাংলাদেশ ও ভারত একসাথে কাজ করতে পারে। উপরন্তু ইউনূস এই অঞ্চলের জন্য বাংলাদেশের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, বাংলাদেশের যেকোনো অস্থিতিশীলতা পশ্চিমবঙ্গ ও সেভেন সিস্টারের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, যা আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রভাব সম্পর্কে তার সচেতনতার ইঙ্গিত দেয়।
তবে এর মধ্যে কিছু বিপত্তির লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছে। আর এ ক্ষেত্রে প্রথম বিপত্তিটি হলো, ভারত গত দেড় দশকের শাসনে যে আনুগত্য পেয়েছিল সেটি আব্যাহত থাকার প্রত্যাশা করছে। অন্তর্বর্তী সরকার সে অধীনতামূলক পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছে প্রথম দিন থেকেই। ফলে বাংলাদেশ প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর বিষয়টি দিল্লির নীতিপ্রণেতারা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেন বলে মনে হয় না।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্সের এক প্রতিবেদনে মধু শ্রী দ্বিবেদী বলেছেন, শেখ হাসিনার মেয়াদ ভারতের সাথে একটি শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তৈরি করেছিল। ভারত ছিল হাসিনার ‘সবচেয়ে বড় মিত্র’, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতাকে সমর্থন করার পাশাপাশি বিদ্রোহ দমন অভিযানেও সহায়তা করে হাসিনা সরকার। এই অংশীদারিত্ব অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং জ্বালানি সহযোগিতাকে সহজতর করেছে। উপরন্তু গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি এবং নিরাপত্তাবাহিনীকে প্রশিক্ষণসহ নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে ভারতের সমর্থন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং বিশেষ করে ভারতের সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করেছে।
এ ধারা অব্যাহত থাকার বিষয়ে সংশয়ী মধু শ্রী দ্বিবেদী মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার তার বৈদেশিক সম্পর্কের বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করতে পারে, একটি আরো ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি নিশ্চিত করতে অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তির সাথে বর্ধিত সম্পৃক্ততার জন্য বাংলাদেশ উদ্যোগী হতে পারে।
দিল্লির বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের সাথে শেখ হাসিনার সহযোগিতা এই অঞ্চলকে ভারতের চাহিদা অনুসারে স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তা সত্তে¡ও, অন্তর্বর্তী সরকার এখন বাংলাদেশে জনসাধারণের অনুভূতির পরিবর্তনের মধ্যে এই সম্পর্ককে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, যা বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরো ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতির পক্ষে।
ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে নীতি গবেষকদের বিশ্লেষণের যথেষ্ট সাযুজ্য রয়েছে। ভারতে থেকে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচার শেখ হাসিনা বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টিতে ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছেন। হাসিনা ভিডিও বার্তায় বলেছেন, তিনি আশপাশেই রয়েছেন, চট করে দেশে ঢুকে পড়বেন। বাংলাদেশকে চাপে রাখতে তাকে এসব বলার অবকাশ যে ভারতের গভীর ক্ষমতা বলয় করে দিচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই।
এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার অসচেতন বলে মনে হয় না। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ডয়েচে ভেলের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারত আমাদের প্রতিবেশী এবং আমাদের একমাত্র প্রতিবেশী বলা যায়। কারণ, চার দিক থেকেই ভারত আমাদের পাশে আছে। কাজেই তার সাথে আমাদের সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক হওয়া উচিত এবং তা হবে। এ ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই, তাদেরও গত্যন্তর নেই। দুই দেশের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক রেখে কেউ লাভবান হবে না। পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন আছে। দুই দেশের মধ্যকার চলমান বিরোধ নিরসনে দুই দেশ আন্তর্জাতিক আইন মেনে নিলেই সেটির সমাধান হবে। সার্ক একটা পরিবারের মতো ছিল। আমরা সেই কাঠামোতে ফিরে যেতে পারি কি না দেখব। শুধু ভারতের সাথে না, দক্ষিণ এশিয়ায় সব দেশ যেন পরস্পরের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজার রাখে। শান্তিপূর্ণ জোন হিসেবে আমরা একে গড়তে চাই। বাধাবিপত্তি এড়িয়ে সার্ক ও বিমসটেককে সক্রিয় করার করার চেষ্টা করব।
কিন্তু ইউনূসের এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুরূপ প্রকাশ ভারতের নীতিপ্রণেতারা করছেন না।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং দেশটির সশস্ত্রবাহিনীকে ভবিষ্যৎ যুদ্ধ মোকাবেলার জন্য তৈরি থাকতে বলেছেন। কয়েকদিন আগে উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্ণৌতে সশস্ত্রবাহিনীর কমান্ডারদের প্রথম যৌথ সম্মেলনে তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইসরাইল-হামাস সঙ্ঘাতের পাশাপাশি বাংলাদেশের পরিস্থিতির উল্লেখ করে এ যুদ্ধ প্রস্তুতির কথা বলেন। তিনি জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের এসব ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণেরও পরামর্শ দেন। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে রাজনাথ সিংয়ের এ বক্তব্য তুলে ধরা হয়। আর সেটি প্রকাশ করে ভারত সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো (পিআইবি)।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মন্তব্যে ঢাকার উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহিদুজ জামান এই হুমকি মোকাবেলায় পাকিস্তানের সাথে পরমাণুবাহী ঘোরি ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের চুক্তি করতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। এর একটি পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং আরেকটি উত্তরবঙ্গে মোতায়েনের প্রস্তাব করেছেন তিনি। একটি শীর্ষ বেসরকারি নীতি গবেষকের এই প্রস্তাবে ভারতের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এবং তাদের মধ্যে নতুন ভাবান্তরের কথা জানা যাচ্ছে। ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রী রাধা দত্ত বলেছেন, নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ দূর করার বিষয়ে গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে ভারত সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছে। এখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে থেকে নিরাপত্তার বিষয়ে ভারত সেই সহযোগিতা পেতে চায়। তবে এটা ঠিক যে নিকট প্রতিবেশী বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা ইসরাইল-হামাসকে এক করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
চীন কী করবে?
চীন বাংলাদেশের নতুন প্রশাসনকে স্বাগত জানিয়েছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। চীন দুই দেশের দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্ব আরো এগিয়ে নিতে একসাথে কাজ করার প্রস্তুতির কথা বলেছে।
চীন শেখ হাসিনার সরকারকে সর্বশেষ নির্বাচন পর্যন্ত সবধরনের সহায়তা দিয়ে গেছে; কিন্তু নির্বাচনের পর একান্তভাবে দিল্লি অনুগত মনোভাব বেইজিংকে ত্যক্ত বিরক্ত ও উদ্বিগ্ন করেছে। ফলে হাসিনা রক্ষার মিশন বেইজিং পরিত্যাগ করায় দিল্লি একা হাসিনাকে রক্ষা করতে পারেনি।
চীন অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে পরবর্তী সরকারের সাথে সম্পর্ক গড়তে চায়। পরবর্তী সরকার বিএনপির নেতৃত্বাধীন হবে বলে বেইজিং প্রত্যাশা করে। নির্বাচনে বিলম্ব বা অন্তর্বর্তী সরকারের বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা বেইজিং পছন্দ করবে বলে মনে হয় না।
চীনের জন্য উদ্বেগের আরেকটি দিক হলো মিয়ানমার সীমান্ত। সেখানে কোনো প্রক্সি যুদ্ধে বাংলাদেশ জড়িয়ে পড়ুক সেটি বেইজিং চায় না। তাদের সংশয় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র বার্মা আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এ রকম কিছু চাইতে পারে।
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ ভারত ও চীনসহ প্রধান আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের নৈকট্যের দ্বারা গঠিত। অন্তর্বর্তী সরকারকে দক্ষতার সাথে কৌশলগত প্রাসঙ্গিকতা সংরক্ষণ এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য এই গতিশীলতা পর্যবেক্ষণ করে এগুতে হবে।
শেখ হাসিনা শেষের কয়েক মাস ছাড়া ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চীনের সাথেও সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারকেও এই সূ² ভারসাম্যমূলক কাজটি করতে হবে, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সুবিধাগুলো অপ্টিমাইজ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের সাথে সম্পর্ক ধরে রাখতে হবে। সেসাথে ভারতের বৈরিতাকে যতটা সম্ভব নিরপেক্ষ রাখতে হবে।
রুশ সম্পর্কে বিপত্তি
রাশিয়ার স্বার্থ বাংলাদেশে খুব বেশি ব্যাপক নয়। তবে রাশিয়া বৈরী হলে তার মূল্য হতে পারে অনেক বড়। রাশিয়া বাংলাদেশে জ্বালানি খাতে সম্পৃক্ত। এখানে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পে তার সবচেয়ে বড় সম্পৃক্ততা। রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ অতি প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য, সার ও জ্বালানি পেতে পারে সাশ্রয়ী মূল্যে। প্রধান উপদেষ্টার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার ম্যান্টিটস্কি। তিনি রূপপুরের কিস্তি বিলম্বিত করা, সাশ্রয়ী দামে গম সার ও জ্বালানি প্রদানের প্রস্তাব দেন বলে জানা যায়। কিন্তু এরপর রূপপুর প্রকল্পে এবং গ্রাসপ্রমকে দেয়া গ্যাস অনুসন্ধান কাজে দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। আর সে সাথে গ্রাসপ্রমের সাথে চুক্তি বাতিল করা হয়। এতে ক্রেমলিন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।
রাশিয়ার সাথে সম্পর্ককে বৈরিতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার অর্থ হবে দিল্লির নেতিবাচক কাজের সাথে মস্কোর সম্পৃক্ততাকে যুক্ত করা। রাশিয়ার সাথে বেইজিং কোনো কারণে বিরক্ত হলে শুধু পশ্চিমের সহযোগিতায় অন্তর্বর্তী সরকারের টিকে থাকা কঠিন হতে পারে।
হলুদ সঙ্কেত!
যান চলাচলে লাল সঙ্কেতের আগে হলুদ জ্বলে ওঠে। কেউ কেউ এমন একটি অবস্থার কথা বলছেন এখন। তারা মনে করছেন যে, পররাষ্ট্রনীতির ভারসাম্যের যে কথা প্রধান উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তার নীতি বক্তব্যে বলেছেন তার বাস্তবে প্রতিফলন প্রয়োজন। ইউনূসের সরকার কৌশলগতভাবে পশ্চিমের মিত্র হবে এবং বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সেটির প্রয়োজনও রয়েছে। তবে রাশিয়া বা চীনের সাথে শত্রুতা ডেকে না এনেই সেটি করা সম্ভব। এ ধরনের ভারসাম্য প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান অথবা তুরস্কের মতো ন্যাটো সদস্য দেশ অনুসরণ করে যাচ্ছে। এটি না করতে পারলে ঢাকার সামনে বিপদ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। হাসিনা একান্ত দিল্লির অনুগত নীতি নিয়ে সব মিত্রকে হারিয়ে নিজের জন্য সেই বিপদ ডেকে এনেছিলেন। অধ্যাপক ইউনূস নিশ্চয় এ বিষয়ে যথেষ্ট পরিণামদর্শিতা রাখেন।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন