গাজা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি কোন পথে
28 February 2024, Wednesday
গাজায় ইসরাইল ফিলিস্তিন যুদ্ধ এক ক্রান্তিকালে উপনীত হয়েছে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এখনো স্থায়ী যুদ্ধবিরতি অথবা ইসরাইল ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রস্তাব মেনে নেননি। ভেতরে বাইরে তীব্র চাপের মুখে নেতানিয়াহু প্যারিসে আরেক দফা যুদ্ধবিরতি আলোচনায় প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন। কিন্তু বলেছেন, এই আলোচনা কেবল সাময়িক যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে ইসরাইলি পণবন্দীদের মুক্ত করার জন্য।
নেতানিয়াহু যেসব দাবি পূরণ করার কথা বলছেন তা যে হামাস কোনোভাবেই মেনে নেবে না সেটি স্পষ্ট। ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে হত্যা ও ধ্বংসলীলা চালানো ছাড়া দীর্ঘ প্রায় পাঁচ মাস যুদ্ধ করার পরও নেতানিয়াহু উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাননি। হামাস ও অন্যান্য প্রতিরোধ সংগঠনগুলোর যুদ্ধক্ষমতা কমে যাচ্ছে এমন কোনো আলামতও লক্ষ করা যাচ্ছে না।
প্রশ্ন হলো, সঙ্ঘাতটি তা হলে কোন দিকে যাচ্ছে? এ প্রশ্নে বড় বিবেচ্য বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা কী চাইছে? নিরাপত্তা পরিষদের সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করেছে কেবলই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অভ্যন্তরীণ জনমতের দিক থেকে প্রবল চাপের মধ্যে থেকেও ইসরাইলকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সমর্থন জুগিয়ে চলেছে দেশটি। মার্কিন বিমানবাহিনীর ২৫ বছর বয়সী পাইলট অ্যারন বুশনেলের গাজায় গণহত্যা ও যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে ইসরাইলের দূতাবাসের সামনে গিয়ে নিজের গায়ে আগুনে আত্মাহুতি দেয়ার ঘটনা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয় পুরো বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছে। আমেরিকান এই পাইলটের মৃত্যুর আগে সর্বশেষ যে কথাটি শোনা গিয়েছিল তা হলো ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’।
এক্স প্রোফাইলের মাধ্যমে এই বিমান সেনার মৃত্যুর ভিডিও যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন আমেরিকার মানবতাবাদী বক্তব্য বিরাট বড় প্রশ্নের মুখে পড়ে। এর পরও আমেরিকা সাময়িক যুদ্ধবিরতিতেই সমর্থন দিচ্ছে। হোয়াইট হাউজের বিভিন্ন কর্মকর্তার বক্তব্যে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কথা মাঝে মধ্যে উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু ওয়াশিংটন সত্যি সত্যি এটি চাইলে যে উদ্যোগ দৃশ্যমান হওয়ার কথা সেটি দেখা যাচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনভাবে ইসরাইলের ব্যাপারে কৌশল ঠিক করতে পারে বলে মনে হয় না। দেশটির নীতিপ্রণয়নে জায়োনিস্ট প্রভাব প্রবল। তুরস্কের অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন যে, মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ দেশটির সরকারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান নয় এটি পাঁচটি পরিবারের মালিকানাধীন। যে পরিবারগুলোর মধ্যে রয়েছে রথচাইল্ড, লেম্যান ব্রাদার্স, ল্যাজার্ড ব্রাদার্স, গোল্ডম্যান শ্যাক্স, ওয়ারবার্গস, কুহন, লোয়েব ও অন্যান্য। এর মধ্যে গত সোমবার ব্রিটিশ ইহুদি ব্যাংকার জ্যাকব রথচাইল্ড ৮৭ বছর বয়সে মারা গেছেন। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে উদ্ভূত, রথসচাইল্ড পরিবারের ইংল্যান্ড শাখা ১৮ শতকের শেষের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
পরিবারের অনেক সদস্য ইহুদিবাদ এবং ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের জন্য তাদের প্রবল সমর্থনের জন্য পরিচিত ছিল। এডমন্ড জেমস ডি রথচাইল্ড ১৮৮২ সালে ফিলিস্তিনে রিশন-লেজিয়নে প্রথম ইহুদি স্থায়ী বসতি স্থাপনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি ১৮৮৩ সালে স্থায়ী বন্দোবস্ত হিসাবে পেটাহ টিকভা প্রতিষ্ঠার জন্য তহবিল সরবরাহ করেন। ১৯১৭ সালে, ওয়াল্টার রথচাইল্ড, ২য় ব্যারন রথচাইল্ড ছিলেন জায়নবাদী ফেডারেশনের কাছে বেলফোর ঘোষণার কথোপকথনকারী। এটি ইহুদি জনগণের জন্য ফিলিস্তিনে একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছিল।
এই রথচাইল্ডসহ চারটি জায়োনিস্ট পরিবার আমেরিকান রিজার্ভ ব্যাংকের মালিক।
অন্যান্য অর্থনৈতিক ও মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণের অবস্থাও একই রকম। এ বিষয়টি নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমেরিকান নেতাদের বাধ্য করার টুলস হিসাবে কাজ করে। বাইডেন নেতানিয়াহুকে পছন্দ না করলেও তাকে ইসরাইলের প্রতি সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। ধীরে হলেও এই অবস্থার বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠছে আমেরিকায়। এটি যতই প্রবল হবে ইসরাইল ততটা নিজেকে বিচ্ছিন্ন ও অসহায় দেখতে পাবে।
এর বাইরে ইসরাইলকে বেপরোয়াভাবে সমর্থন দেয়ার পেছনে আমেরিকান অনেক গভীর কিছু এজেন্ডার কথা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে জায়নবাদীদের ‘অখণ্ড ইসরাইল’ প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা। গত বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে নেতানিয়াহু হাতে মানচিত্র নিয়ে ফিলিস্তিনমুক্ত ইসরাইল প্রতিষ্ঠার কথা যখন বলছিলেন তখন কোনো আপত্তি ওঠেনি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। অধিকন্তু ওয়াশিংটন তখনো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে রিয়াদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে গেছে। নেতানিয়াহুর জাতিসঙ্ঘে দেয়া এই বক্তব্যের পর স্পষ্ট হয়ে যায় যে অখণ্ড ইসরাইল প্রতিষ্ঠার জন্য ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করতে একটি যুদ্ধ আসন্ন।
ইসরাইলের এই পরিকল্পিত যুদ্ধটি শুরু করার আগে হামাস তাদের লিভারেজ বাড়াতে ৭ অক্টোবর ইসরাইলের সীমান্তের অভ্যন্তরে সার্জিক্যাল অপারেশন চালায়। হামাসের এই অপারেশনে ইসরাইল কিছুটা বিস্মিত হলেও তাদের যুদ্ধ পরিচালনা দেখে মনে হয়নি কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই এই সঙ্ঘাতে নামছে। এমনকি বাইডেন থেকে শুরু করে পশ্চিমা নেতারা যেভাবে একে একে ইসরাইলে এসে তাদের জন্য সর্বোচ্চ উজাড় করে সাহায্য করছেন তাতে বড় আকারের ফিলিস্তিন-ইসরাইল সঙ্ঘাতের বিষয় তাদের অজানা ছিল বলে মনে হয়নি।
অখণ্ড ইসরাইল প্রতিষ্ঠা ছাড়াও আরো দুটি বড় এজেন্ডা রয়েছে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের। উভয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য গাজাকে ফিলিস্তিনমুক্ত করার প্রয়োজন অনুভব করেছে তারা। এর একটি হলো সুয়েজ খালের বিকল্প একটি বেনগুরিয়ান ক্যানেল তৈরি করা, যেটি গাজার ওপর দিয়েই যুক্ত হবে। এই ক্যানেলটি সম্পন্ন করা গেলে এখন সুয়েজ খাল থেকে মিসর যে ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো রাজস্ব পায় তার বড় অংশ ইসরাইলে চলে যাবে। একই সাথে মিসরের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেকখানি কমে যাবে।
দ্বিতীয় এজেন্ডাটি হলো গাজা উপকূলের সমুদ্রসীমানায় তেল-গ্যাসের বিশাল মজুদে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। গাজাকে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে আনা গেলে এই সম্পদের কর্তৃত্ব পাবে ইসরাইল। এই প্রকল্পের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের গভীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। যার কারণে ইসরাইল গাজা যুদ্ধ শুরুর আগে আমেরিকান জ্বালানিমন্ত্রী ইসরাইল সফর করেন। এছাড়া বাইডেন যখন ইসরাইলের যুদ্ধের জন্য প্রথম ৩ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেন তখন এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলে জবাবে প্রেসিডেন্ট বলেন, ইসরাইলকে যুদ্ধের জন্য যে তিন বিলিয়ন ডলার দেয়া হচ্ছে এটি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগ। এখানে স্পষ্টতই বাইডেন ইসরাইলের যুদ্ধে আমেরিকার অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
বেনগুরিয়ান খাল আর গাজা উপকূলের গ্যাসসম্পদ ছাড়াও আরেকটি অর্থনৈতিক প্রকল্প রয়েছে ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র স্বার্থসংশ্লিষ্ট। এটি হলো ইথিওপিয়ায় নীল নদের ওপর তৈরি রেনেসাঁ বাঁধ। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এ বাঁধ নির্মাণের কথা বলা হলেও এখানে অনেক সেচ প্রকল্প নেয়া হয়েছে যার আওতায় পানি ইসরাইলের পশ্চিমতীর ও অন্যান্য অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হবে।
বেনগুরিয়ান খালের মতো রেনেসাঁ বাঁধও মিসরীয় অর্থনীতির জন্য মৃত্যু পরোয়ানাতুল্য। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে মিসরের স্বাধীনসত্তাকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সহায়তায় অনেকখানি পণবন্দী করা হয়েছে। দেশটি এখন ১৬৬ বিলিয়ন ডলারের দায়ের মধ্যে রয়েছে। কায়রোকে লোভ দেখানো হচ্ছে ফিলিস্তিনমুক্ত ইসরাইলকে মেনে নেয়া হলে এ ঋণ মওকুফের ব্যবস্থা করা হবে।
এখন পর্যন্ত, নেতানিয়াহু গাজায় যুদ্ধের অবসান ঘটাতে রাজনৈতিক চুক্তির জন্য কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করতে অস্বীকার করেছেন। গাজার বর্তমান ধ্বংসযজ্ঞটি সামান্যই কৌশলগত উদ্দেশ্য পূরণ করছে বলে মনে হচ্ছে। ইসরাইলের অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, নেতানিয়াহুর একমাত্র উদ্দেশ্য রাজনৈতিক বলে মনে হয় : তার অতি-ডানপন্থী জোটের সংহতি বজায় রাখা তার লক্ষ্য, যাতে তিনি ক্ষমতায় থাকতে পারেন। এর মানে হলো যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। কট্টর ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির গাজায় ইসরাইল তাদের সামরিক অভিযান বন্ধ করলে জোট ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। নেতানিয়াহু বলছেন, গাজায় বন্দী সব ইসরাইলি জিম্মির মুক্তি এবং হামাসের সম্পূর্ণ ও নিঃশর্ত ‘বিলুপ্তি’ অর্জন হলেই কেবল যুদ্ধ থামানো যাবে এবং একটি চুক্তি (সম্ভবত গাজায় ইসরাইলি দখলের পুনর্নবীকরণসহ) বাস্তবায়ন করা যাবে।
ইসরাইলি বিশ্লেষকরাই বলছেন, নেতানিয়াহুর এই লক্ষ্য অবাস্তব ও বিপজ্জনক উভয়ই। হামাস একটি ইসলামী জাতীয়তাবাদী সংগঠন যার গভীর শিকড় এবং যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে। ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে, হামাস পশ্চিমতীরে পিএলওর একচেটিয়া শাসনকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এখন, গাজায় ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদী অবস্থানের জন্য হামাস ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। বিশ্লেষক শ্লোমো বেন-অমির ধারণা, ‘ইসরাইল হামাসের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্মূল করতে, তার চেইন অব কমান্ড ভেঙে এবং একটি আনুষ্ঠানিক সংগঠন হিসেবে কাজ করার ক্ষমতা ধ্বংস করতে সফল হলেও হামাসের জনপ্রিয়তা ইঙ্গিত করে যে, অন্য কিছু না হলে, এর নীতিমালা ফিলিস্তিনি জাতীয় আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে। প্রকৃতপক্ষে, হামাসের ধ্বংস সম্ভব হলেও তা ইসরাইলি নিরাপত্তা দুর্বল করতে পারে।
সংঘর্ষ-পরবর্তী বিশৃঙ্খলার মধ্যে, হাজার হাজার হামাস যোদ্ধা চরমপন্থী দলে যোগদান করবে, অন্যরা সালাফিস্ট গোষ্ঠীতে যোগ দেবে যেগুলো আরো বেশি উগ্রপন্থী।’
অন্যদিকে মিসর এ ধরনের একটি পরিকল্পনায় কতটা সম্মত হবে তা স্পষ্ট নয়। তবে দেশটি সৌদি আরব ও ইরানের সাথে ব্রিকস-প্লাস জোটে যোগ দিয়ে রাশিয়া-চীনের সাথে সম্পর্কে নতুন করে যুক্ত রয়েছে। আর অন্যান্য আরব-ইসরাইল সঙ্ঘাতের চেয়ে রাশিয়ার ভূমিকা এবার কিছুটা ব্যতিক্রম বলে মনে হচ্ছে। ইসরাইল গাজায় হামলা শুরু করার পর মস্কো তীব্র সমালোচনা করে। জাতিসঙ্ঘে যুদ্ধ বন্ধের প্রতিটি প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে। হামাসের প্রতিনিধি দলকে রাশিয়ায় স্বাগত জানানো হয়েছে।
সর্বশেষ আজ বুধবার হামাসের প্রতিনিধিদলকে পুতিন আমন্ত্রণ জানিয়েছেন রাশিয়ায়। মস্কো এর আগে দু’পক্ষের মধ্যে বন্দিমুক্তি চুক্তি ও যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতা করার কথা বলেছে। পুতিন এ ব্যাপারে বাস্তব উদ্যোগ নিতে চাইছেন বলে মনে হয়। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদেশগুলো প্যারিসসহ অন্যান্য স্থানে যুদ্ধবিরতির জন্য একাধিক বৈঠকে বসেছে। প্রতিটা উদ্যোগে একতরফা সমাধান চাওয়ায় তাতে সাফল্য আসেনি। সর্বশেষ প্যারিস আলোচনা ব্যর্থ হলে রাশিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
এর মধ্যে ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শাতায়েহ পদত্যাগ করেছেন। পুরো ফিলিস্তিনের ভূমিতে ফিলিস্তিনি সার্বভৌমত্ব সম্প্রসারণের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। শাতায়েহ গত সোমবার গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শাসনের বিষয়ে একটি ‘আন্তঃফিলিস্তিনি ঐকমত্য’ গঠনের সুযোগ তৈরির জন্য এটি করেছেন বলে উল্লেখ করেন।
ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রীর এই পদত্যাগ কেবল পশ্চিমা আকাক্সক্ষায় হয়েছে বলে মনে হয় না। এর সাথে রাশিয়া যে যুদ্ধবিরতি ও দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কথা বলছে তারও সম্পর্ক থাকতে পারে। একসময় রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্য শান্তিপ্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত ছিল। পরে যুক্তরাষ্ট্র দুই রাষ্ট্র সমাধান থেকে সরে এসে নেতানিয়াহুর অখণ্ড ইসরাইলে গোপন সমর্থন দেয়া শুরু করলে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্য শান্তিপ্রক্রিয়ায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। এখন মধ্যপ্রাচ্যে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে সেখানকার শান্তিপ্রক্রিয়ায় আবার রাশিয়া মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে।
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে সরকারি লড়াই করে যাচ্ছে। এই যুদ্ধ অনেক হিসাব নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। একসময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ছিল একতরফা প্রভাব। এখন এই অঞ্চলে তিন বড় শক্তি মিসর, সৌদি আরব, ইরান ব্রিকস-প্লাসে যুক্ত হওয়ায় এক ধরনের ভারসাম্য তৈরি হয়েছে। এই অঞ্চলের আরেক শক্তি তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য হলেও পশ্চিমের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে টুলসে পরিণত না করে রাশিয়ার সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এ পরিস্থিতি এবারের ফিলিস্তিন-ইসরাইল সঙ্ঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধা অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হামাস ও অন্যান্য প্রতিরোধ সংগঠনগুলোর জন্য পাঁচ মাস অবিরাম ইসরাইলের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সহজ কোনো বিষয় নয় যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো সর্বোচ্চ সমর্থন ও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে তেল-আবিবকে। ইরানের মতো প্রকাশ্যে সমর্থন না করলেও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ যে ফিলিস্তিনের জন্য গোপন কোনো উপায়ে সহায়তা করছে তাতে সংশয় নেই।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা এখনো যেভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তাতে নেতানিয়াহুর বিজয় অনেকখানি অসম্ভব হতে পারে। এখন পর্যন্ত লড়াই প্রধানত গাজায় সীমিত। আনসারুল্লাহ হুথিদের ভূমধ্যসাগরে তেল আবিবের স্বার্থসংশ্লিষ্ট জাহাজে অবরোধ এবং হিজবুল্লাহর ইসরাইলের সীমিত অঞ্চলে আক্রমণ এর মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
যুদ্ধ সরঞ্জামের দিক থেকে হিজবুল্লাহ অনেক বেশি শক্তিশালী। এ কারণেই পশ্চিমা মিত্ররা বারবার হিজবুল্লাহ ও ইরানের সাথে সরাসরি লড়াই এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছে ইসরাইলকে। তবে সর্বশেষ দফায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর না হলে যুদ্ধ অনিবার্যভাবে বিস্তৃত হতে পারে। এর মধ্যে মিসরের সাথে তুরস্কের সামরিক সহযোগিতার একাধিক চুক্তি হয়েছে। ইরান তার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সিরিয়া ও লেবাননকে দেয়ার কথা ঘোষণা করছে। লড়াই বিস্তৃত হলে শুধু ইরান প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িত হবে এমনই নয়, একই সাথে রাশিয়াও একটি পক্ষ হয়ে যেতে পারে।
রাশিয়া মধ্যস্থতার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা ব্যর্থ হলে হামাস ও অন্যান্য প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র সহায়তা দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে মস্কো। সিরিয়ায় সমর্থনে রাশিয়া ইসরাইল সীমান্তে তার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় করতে পারে। এতে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির ওপর এখনো যতটা নিয়ন্ত্রণ পশ্চিমের রয়েছে তা ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়তে পারে। রাশিয়া-চীনের নেতৃত্বে ব্রিকস-প্লাস প্রক্রিয়া সচল হয়ে উঠতে পারে।
এ বিষয়টি যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ওপর অনেক বড় চাপ তৈরি করেছে। নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় পেতে চান, তাহলে তাকে একই সাথে বড় বিপর্যয়ের জন্যও অপেক্ষা করতে হবে। সেই দৃশ্যপট ধীরে ধীরে কাছে চলে আসছে।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন