সোনা, নারী আর ক্ষমতার মিশেলের ভয়টা যেখানে
29 May 2024, Wednesday
ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে দেশ কেঁপেছে। তবে রাজনীতিতে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে অন্য তিনটি ঘটনা। তিনটি ঘটনা তিনটি গল্প আসলে। একটি তো অবশ্যই ভয়াবহ ক্রাইম থ্রিলার। অন্য দুটি ট্র্যাজেডি না কমেডি বোঝা যাচ্ছে না। যারা একসময় ছিলেন দুর্ধর্ষ ক্ষমতাবান, এখন তাদের পক্ষ নেওয়ার লোক মিলছে না। মানুষ হাসছে, ফেসবুকে টিটকিরি মারছে। একসময়কার নিষিদ্ধ বিষয়গুলো নিয়ে জবরদস্ত কথাবার্তা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। এবং গুজব সত্যি বলে দেখা দিয়েছে। ভারতে এমপি আজীমের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পদের পাহাড় এবং সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের দুর্নীতিতে জড়ানোর অভিযোগ এখন সংবাদমাধ্যমের প্রধান খোরাক।
আদার সঙ্গে কাঁচকলা মেশালে ভীষণ দুর্গন্ধ হয়। যিনি মানি মেকার তিনি রুল মেকার হলে কী হয়, এমপি আজীম তার মর্মান্তিক উদাহরণ। মাফিয়ার আইনপ্রণেতা বনে যাওয়াই শেষ নয়। এই গল্পে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ আছে, আন্ডারগ্রাউন্ড অপরাধচক্র আছে, আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক আছে, আর আছে নারী। নারী, স্বর্ণ এবং ক্ষমতা এক জায়গায় হলে সেখানে অপরাধ এবং বিপর্যয় ঘটবেই।
খেয়াল করা দরকার, গত এক দশকের অনেক মারাত্মক অপরাধচক্রের কারবারের মধ্যে একটা ব্যাপার কমন ছিল: উচ্চাভিলাষী পুরুষদের সঙ্গে সুযোগসন্ধানী নারীদের বিশেষ রকমের সম্পর্ক। পাপিয়া-সম্রাট থেকে শুরু করে সাহেদ-সাবরিনার কাহিনি আমরা জানি। আরও অনেক কিছুই পরে জানা যাবে বলে ধরে নেওয়া যায়। কোনো নারী জেলে গেছেন, কোনো নারী সেলিব্রিটির আসন আলো করে বসে আছেন, কোনো নারী খুন হয়েছেন, কোনো নারী পুরস্কৃত হয়েছেন। ক্রিমিনাল অর্থনীতির চেরাগ যার হাতে তার চারপাশে এই ধরনের নারীপতঙ্গ ভিড় করছেন। নারী হয়ে উঠেছে রাজনীতি, ব্যবসা ও ক্ষমতার কারবারের বিশেষ রকম আকর্ষণীয় মুদ্রা। এই নারী-মুদ্রা বিনিময়ের ঘটনায় অঘটনও কম ঘটেনি। সব বলাও যায় না, দেখাও যায় না।
ঘূর্ণিঝড়ে সব হারানো মানুষ, অর্থনীতির ছন্নছাড়া দশায় কষ্টে থাকা মানুষ এসব ঘটনার দিকে তাকিয়ে কী ভাবছে? হয়তো ভাবছে, এসব চরিত্রের অন্যায় ও দুর্নীতির জন্যই মানুষের এত কষ্ট! বাংলাদেশের মানুষ এখন পিঁপড়ার মতো দৃষ্টি মাটির দিকে রেখে জীবনটা পার করে দিতে চায়। বড় রকমের বাধ্য না হলে ক্ষমতার মগডালে বসা পাখিদের দিকে তারা আর তাকায় না। এখন তারা মাথা তুলে দেখছে তাদের ভাগ্যবিধাতাদের কয়েকজনের আসল চেহারা! তারা দেখছে, আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালানি কোন ফাঁকে এমপি হয়ে বসে গেছেন। আবার সেই চোরাচালানের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বে নৃশংসভাবে খুনও হয়ে যেতে হলো তাঁকে। তারা দেখছে আইন রক্ষার ভার ছিল যাঁর ওপর, দেশরক্ষার ভার ছিল যাঁর ওপর, তারা আসলে পরিবারের সম্পদ বাড়ানো এবং ভাইবেরাদরদের অপরাধ ঢাকতেই ব্যস্ত ছিলেন।
পাশ্চাত্যের জগৎ শেঠেরা স্পেসশিপে করে মহাকাশে বেড়িয়ে আনন্দ করেন। আমাদের দেশের বড়লোকদের সামনে নারী ও মদ ছাড়া আনন্দের উপকরণ তেমন নাই। আইনভঙ্গের চাইতে বড় বাহাদুরি আর কী আছে? ওদিকে মাফিয়াতন্ত্রের কাছে নারী খুবই আকর্ষণীয় মুদ্রা। রাজনীতিক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বশে আনতে নারীকেই ব্যবহার করা হয় মোক্ষম কোমলাস্ত্র হিসেবে। সেই কোমলাস্ত্র ব্যবহার করেই এমপি আজীমের জন্য হত্যার ফাঁদ পাতা হয়েছিল বলে জানা যাচ্ছে।
এমপি আজীমের উত্থানের গল্পটা খেয়াল করুন। বিএনপি থেকে পাতি নেতা, পাতি নেতা থেকে এমপি এবং অবশেষে করুণ পরিণতি। একজন মাফিয়াকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় ‘নেতা’ বানাতে লাগে ৫-৭ বছর। শুধু তাই নয়, বিশেষ রকমের নির্বাচন ব্যবস্থারও দরকার হয়। সুষ্ঠু নির্বাচনে সত্যিকার প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে, তাদের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সাধারণত মাফিয়ারা পাল্লা দিতে পারে না। বাংলাদেশের গত তিনটি নির্বাচন যে কায়দায় হয়েছে, সেখানে সত্যিকার জনপ্রতিনিধিদের চাইতে টাকার গরম, ক্ষমতার গরমঅলাদের সুযোগ বেশি। এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, গণতান্ত্রিক পরিবেশে এ ধরনের লোকেরা এমপি হতে পারতেন না।
আমাদের অর্থনীতির ৮৫ ভাগই অনানুষ্ঠানিক, কালোটাকা বলে পরিচিত অবৈধ সম্পদের পরিমাণ অপরিমিত। এ ধরনের অর্থনীতিকে বলা হয় ক্রিমিনাল অর্থনীতি। এই ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার নাম দেওয়া যায় ঠগিতন্ত্র। মধ্যযুগীয় ভারতে ঠগিরা মানুষের বন্ধু সেজে তাদের সঙ্গে চলতে চলতে মওকামতো মানুষটাকে মেরে সর্বস্ব কেড়ে নিত। যাদের আজ আমরা ভিলেন ভাবছি, তারা কি একসময় নায়ক ছিল না, বন্ধু সেজে ছিল না আমাদের মধ্যে?
এই ঠগিতন্ত্র কেবল বাংলাদেশেই সুলভ না। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান এ পর্যায়ে ঢুকে পড়েছে। যুক্তরাজ্যের ইউসিএল প্রেস থেকে দ্য ওয়াইল্ড ইস্ট: ক্রিমিনাল পলিটিক্যাল ইকোনমিজ ইন সাউথ এশিয়া নামের একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলায় বললে, বুনো পূর্ব: দক্ষিণ এশিয়ার অপরাধমূলক রাজনৈতিক অর্থনীতি। সহজ ভাষায় রাজনৈতিক ঠগিতন্ত্রের অর্থনীতি। আমেরিকার বুনো পশ্চিমের মতো এটা হলো এশিয়ার বুনো পূর্ব। আমেরিকায় চলত সোনা নিয়ে বন্দুকবাজি। আমাদের এখানে চলে টাকা বানানোর ঠগবাজি। বসবাসের অযোগ্য, চরম বৈষম্যপূর্ণ, নোংরা ও অপরাধে ভরা নগরগুলোতে ক্ষমতাবানেরা গড়ে তোলে নিজস্ব স্বর্গ, বাহিনী আর রাজত্ব। গত এক দশকে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক রূপান্তর বাংলাদেশে ঘটেছে, তার অপরাধজগতের আলো-আঁধারিতে এদের বিচরণ। সেই আলো-আঁধারিতে অর্থ, উপঢৌকন, মদ, সফর আর গাড়ি-বাড়ি-নারীর ব্যবহার ঘটবেই। এবং মাঝেমধ্যেই ঘটবে স্বার্থের হানাহানি, হত্যা এবং কেলেংকারি ফাঁসের ঘটনা। মাফিয়া অর্থনীতিতে এসব স্বাভাবিক ঘটনা, অস্বাভাবিক কিছু না।
এ ধরনের ক্রিমিনাল রাজনৈতিক অর্থনীতি চালাতে গেলে যে ধরনের পদাধিকারীদের দরকার পড়ে, সাবেক পুলিশপ্রধান ও সাবেক সেনাপ্রধান দায়িত্বে থাকার সময় তেমন ভূমিকাই পালন করে গেছেন। এমপি আজীমের অপমৃত্যু দুঃখজনক, তারপরও বলতে হয় তিনি কি তাঁর এলাকায় ক্ষমতাসীনদের খুঁটি ছিলেন না? তবে এরা তো আসলে বড় কিছু না। এরা নষ্ট অর্থনীতির বিশাল যে ডুবোপাহাড় তার অতি সামান্য ডগামাত্র। লাভজনক এবং স্পর্শকাতর পদে থাকা অনেকের আমলনামা হাতে নিলেই এরকম বিস্ময়করভাবে ধনকুবের হওয়ার কাহিনি ফকফকা হয়ে যাবে। ঢাকার অনেক ওয়ার্ডে, দেশের অনেক জেলায় এদের মতো কিংবা এদের চাইতেও জাঁদরেল মানুষ মারাত্মক ক্ষমতার আসনে বসে আছেন। জনগণের ভাগ্যবিধাতা হয়ে আছেন। নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল হয়ে আছেন।
এই ক্ষমতাধরদের কেউ কেউ হয়তো ভুল সময়ে ভুল জায়গায় পা দিয়ে ফেলেন। তখন পতন শুরু হয়। তাতে ক্রিমিনাল অর্থনীতির কোনো অসুবিধা হয় না। সেখানে হাজির হয়ে যায় ‘নতুন মুখ’। টাকা আর ক্ষমতার মানিকজোড় চলতেই থাকে। পতঙ্গের নক্ষত্র হয়ে ওঠার দৃশ্যটা সবার আড়ালেই থাকে। সাধারণ মানুষ কেবল দেখতে পায় তাদের পতন। তখন ওইসব নক্ষত্রকে দেখে মনে হয় লেজে আগুন লাগানো উল্কার মতো।
এই ট্রিপল কাহিনিও একসময় ঝিমিয়ে যাবে। তাদের শূন্যস্থান অন্য কেউ পূরণ করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঠগিতন্ত্রের কারখানা এ ধরনের মানুষের উৎপাদন বহাল রেখেছে। আসল ভয়টা সেখানেই।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক; সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক
উৎসঃ সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন