সোমালিয়ার জেলেদের জলদস্যু করে তুললো কে?
13 March 2024, Wednesday
সোমালিয়ার দুর্ভাগ্যের সাথে জড়িয়ে গেছে ২৩ বাংলাদেশি নাবিক ও তাদের পরিবারেরও ভাগ্য। গত মঙ্গলবার ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার পাশ দিয়ে দিয়ে যাবার সময় বাংলাদেশি বাণিজ্যিক জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে। জলদস্যুতা অবশ্যই ঘৃণিত কাজ। আর যখন বাংলাদেশি নাবিকেরা তাদের হাতে জিম্মি হন, তখন তাঁদের স্বজনদের মতো আমাদের হৃদয়ও উদ্বেগে ভারি হয়ে ওঠে। আমরা তাঁদের মুক্তির জন্য যে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে সরকারের কাছে দাবি জানাই। এ ব্যাপারে বিশ্বে যারা সক্রিয় ও দায়িত্বশীল, তাদের সাহায্যও আমাদের প্রয়োজন।
কিন্তু কেন সোমালিয়ার লোকেরা জলদস্যু হয়ে উঠলো? আর কেনই বা সোমালিয়ায় এই জলদস্যুদের বিপুল জনপ্রিয়তা? কেনই বা তাদের বলা হয় সোমালিয়ার জলরক্ষী?
সোমালিয়ার উপকূলের পানি ছিল আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান। কারণ, এই পানিতেই বিচরণ করে টুনা, মার্লিনসহ দামি মাছেরা। এই সম্পদই সোমালিয়ার কাল হলো। বিদেশি মাছ শিকারিদের নজর পড়লো সেখানে। তারা আধুনিক নৌযান ও গভীরে ফেলবার মতো জাল নিয়ে সোমালিয়ার সমুদ্রসীমার মাছ চুরি করতে থাকলো। এতে বেকার হয়ে পড়তে থাকলো সোমালিয়ার সামুদ্রিক জেলেরা।
দ্বিতীয় বিপদটা আরো ভয়াবহ। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসন উচ্ছেদের পর সোমালিয়ায় গৃহযুদ্ধ লেগে যায়। দীর্ঘ নৈরাজ্যের মধ্যে রাষ্ট্র ভেঙ্গে পড়ে। জাতিসংঘের মাধ্যমে পশ্চিমারা সামরিক হস্তক্ষেপ চালায়। তাছাড়া সোমালিয়ার সমৃদ্ধ খনিজ সম্পদের জন্যও সেখানে নিয়ন্ত্রণ চায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইতালি ও ফ্রান্স। নব্বই দশক থেকে একের পর এক মার্কিন আক্রমণ, সিআইয়ের গোপন অভিযান, মার্কিন মদদে ইথিওপিয়ার আগ্রাসনে বিধ্বস্ত দেশটি আর তার দুর্ভিক্ষপীড়িত কোটি খানেক মানুষকে দোজখের সদর দরজা দেখিয়ে দিয়েছে। অথচ তাদেরও বলবার আছে অন্যরকম এক গল্প।
আর সকল জাতির মতো সোমালিয়দেরও ইতিহাস আছে, আছে নাটকীয় উত্থান-পতন। তাদের একাংশ ছিল ইতালিয় শাসনে আরেকাংশ ছিল ব্রিটিশ শাসনে। তারা খুবই স্বাধীনেচতা জাতি। ১৯২০-এর দশকে ব্রিটিশরা তাদের জনসংখ্যার তিনভাগকে মেরে ফেলে। ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনীও সেখানে গণহত্যা চালায়।
সোমালিয়ার জলদস্যুদের সাথে অনেক জায়গাতেই মিল রয়েছে মধ্যযুগের ইউরোপীয় জলদস্যুদের। জলদস্যু বলতেই কাঁধে তোতাপাখি নিয়ে থাকা শয়তান মানুষের ধারণা আমাদের মনে গেঁথে দিয়েছে হলিউডি ছবিগুলো। আমরা যেমন ভাবি জলদস্যুরা কখনোই তেমনটি ছিল না। জলদস্যুতার স্বর্ণযুগ ছিল ১৬৫০ থেকে ১৭৩০ সাল। সেসময় থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মুখপাত্ররা কুৎসা রটায় যে দস্যুরা হলো অমানুষ, বর্বর ডাকাত। সেই ধারণা আজো অনেকে বিশ্বাস করে। কিন্তু বারবারই আমজনতা তাদের ফাঁসিকাঠ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কেন? ভিলেইনস অব অল ন্যাশনস বইয়ের লেখক ইতিহাসবিদ মারকাস রেডাইকার এ বিষয়ে আমাদের কিছু জানাতে পারেন। ধরুন আপনি সেসময়ের কোনো নাবিক বা সওদাগর, লন্ডনের ইস্ট এন্ড বন্দর থেকে ক্ষুধার্ত ও তরুণ আপনাকে তুলে নেয়া হলো জাহাজে। যাত্রা শুরু করে একসময় দেখতে পেলেন এক কাঠের নরকে করে আপনি ভাসছেন। উদয়াস্ত খাটতে খাটতে আপনার পেশি কুঁচকে গেছে, আধাপেটা খাওয়া, এক মুহূর্তের জন্য কাজে উদাস হয়ে গেছেন। সর্বশক্তিমান সারেং আপনাকে চাবুক পেটা করবে। বারবারই যদি আপনার ফাঁকি ধরা পড়ে তো আপনাকে ছুঁড়ে ফেলা হবে সাগরে। অথবা মাস শেষে দেখলেন আপনার মজুরি মেরে দেওয়া হয়েছে।
এই বর্বর দুনিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহী ঐ জলদস্যুরা। তারা তাদের বর্বর ক্যাপ্টেনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সমুদ্রের কারবারের নতুন নিয়ম তৈরি করেছিল। জাহাজ হাতে পাওয়া মাত্র তারা তাদের ক্যাপ্টেন নির্বাচিত করতো এবং সকল সিদ্ধান্তই নিতো এজমালি ভাবে। লুটের মাল তারা এমনভাবে ভাগ করতো যা থেকে রেডাইকার বলছেন, ‘সেটা ছিল আঠারো শতকের সবচেয়ে সমতাবাদী ভাগজোখ’। এজন্যই ডাকাত হওয়া সত্ত্বেও তারা ছিল জনপ্রিয়। যেমন সোমালিয়দের কাছে জনপ্রিয় তাদের জলদস্যুরা।
পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রশক্তিগুলো মওকা বুঝে সোমালিয়ার খাদ্য সরবরাহ কেড়ে নেয় এবং এর উপকূলে তেজষ্ক্রিয় বর্জ্র্যপদার্থ ফেলতে শুরু করে। সরকার গায়েব হয়ে যাওয়ার মুহূর্ত থেকেই সোমালিয়ার উপকূলে হানা দিতে থাকে রহস্যময় ইউরোপীয় জাহাজ। তারা বিরাট বিরাট ব্যারেল ফেলতে থাকে সেখানে। উপকূলীয় অধিবাসীরা অসুস্থ হতে শুরু করে। প্রথম প্রথম তাদের গায়ে অদ্ভুত দাগ দেখা দিত, তারপর শুরু হলো বমি এবং বিকলাঙ্গ শিশু প্রসব। ২০০৫ সালের সুনামির পর, তাদের উপকূল ভরে যায় হাজার হাজার পরিত্যক্ত ও ফুটো ব্যারেলে। মানুষ তেজষ্ক্রিয়তায় ভুগতে থাকে। ৩০০ এরও বেশি মানুষ মারা যায়। সেসময়ে সোমালিয়ায় জাতিসংঘ প্রতিনিধি আহমেদু আবদাল্লাহ বলেন, ‘কেউ এখানে একটানা পারমানবিক উপাদান ফেলছে। আরও ফেলছে সীসা, ক্যামিয়াম ও মার্কারি।’ খুঁজলে দেখবেন এর বেশিরভাগই আসছে ইউরোপীয় হাসপাতাল ও কারখানাগুলো থেকে। ইতালিয় মাফিয়াদের মাধ্যমে সস্তায় তারা এগুলো সোমালিয়ার জলসীমায় খালাস করে। ইওরোপীয় সরকারগুলো এ নিয়ে কিছু করছে? না, না তারা এগুলো পরিষ্কার করছে, না দিচ্ছে ক্ষতিপূরণ, না ঠেকাচ্ছে এগুলো ফেলা।
একইসময়ে অন্য কিছু ইউরোপীয় জাহাজ সোমালিয়ার সমুদ্র লুট করে চলেছে। সোমালিয়ার প্রধান সম্পদ তাদের সামুদ্রিক মাছের ভাণ্ডার। ইওরোপ আগে অতিশোষণের মাধ্যমে নিজেদের মাছের ভাণ্ডার নিঃশেষ করেছে, এখন হামলে পড়েছে অন্যের পানিতে। সোমালিয়ার অরক্ষিত পানি থেকে তারা ফিবছর ৩০০ মিলিয়ন ডলারের টুনা, চিংড়ি, গলদা চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ ধরে নিয়ে আসে। স্থানীয় জেলেরা দেখতে পেল হঠাৎ, তাদের সর্বস্ব খোয়া গেছে এবং তাদের ক্ষুধার কোনো নিবারণ নাই। রয়টারের কাছে মোহাম্মদ হোসেন নামে এক যুবক বলে, ‘যদি কিছুই করা না হয়, অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের সমুদ্র মাছহীন হয়ে পড়বে।’
এই পটভূমিতেই ওই মানুষদের আবির্ভাব, যাদের আমরা বলছি ‘জলদস্যু’। সকলেই মানে যে, এরা আসলে সাধাসিধা জেলে। প্রথমে তারা স্পিডবোট নিয়ে বর্জ্র্য ফেলা ও মাছ ধরার জাহাজ ও ট্রলারগুলিকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে তাদের ওপর ‘ট্যাক্স’ বসানোরও চেষ্টা চলে। এক টেলিফোন সংলাপে জলদস্যুদের এক নেতা সুগুল আলি বলেন, তাদের উদ্দেশ্য ছিল ‘বেআইনী মাছ ধরা এবং উপকূল দূষণ থামানো...আমরা জলদস্যু নই...ওরাই জলদস্যু যারা আমাদের মাছ কেড়ে নেয়, যারা আমাদের সমুদ্র বিষ দিয়ে ভরে ফেলে এবং আমাদের পানিতে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করে।’
কিন্তু বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ কিংবা ২০১০ সালে অপহৃত হওয়া এমভি জাহান মণির কী অপরাধ? তারা তো সোমালিয়দের কেন, কারোরই কোনো ক্ষতি করেনি। একসময়কার মুক্তিযোদ্ধা অন্যসময়ে ডাকাত হয়ে যায়—আমরা দেখেছি। সোমালিয় জলদস্যুদের মধ্যে বেশ কিছু গুণ্ডা-বদমাশও রয়েছে। তারা জাতিসংঘের খাদ্য সরবরাহও লুট করে। এবং এও সত্য যে, স্থানীয়দের কাছে এই জলদস্যুরা বিপুলভাবে জনপ্রিয়। স্বাধীন সোমালিয় সংবাদ-সাইট WARDHERNEWS এ বিষয়ে সবচেয়ে ভাল একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছে যে, ‘৭০ ভাগ সোমালিয় মনে করে জলদস্যুতাই এখন তাদের সমুদ্র প্রতিরক্ষার জাতীয় কৌশল।’ আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময়, জর্জ ওয়াশিংটনসহ মার্কিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা জলদস্যুদের দিয়ে মার্কিন সমুদ্রসীমা রক্ষার কাজ করিয়ে নিতেন। এজন্য তাদের টাকাও দেওয়া হতো, কারণ সেসময় আমেরিকার কোনো নৌবাহিনী ছিল না। বেশিরভাগ মার্কিনির কাছেও এটাকে ঠিকই মনে হয়েছিল। সোমালিয়রা কি তাদের থেকে খুবই আলাদা?
যদি সত্যিই জলদস্যুতা বন্ধ করতে হয়, তাহলে এর গোড়ায় হাত দিতে হবে। থামাতে হবে পশ্চিমাদের করা অপরাধগুলো। ২০০৯ সালে দুনিয়ার তাবড় তাবড় সরকারগুলো একযোগে সোমালিয় জলদস্যুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সেসময় ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ দুই ডজনেরও বেশি দেশের যুদ্ধজাহাজ নিয়ে সোমালিয়ার জলসীমায় প্রবেশ করে। সেসময় থেকে ওই এলাকায় আন্তর্জাতিক প্রহরা বজায় ছিল। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ শুরুর পর। ইসরায়েলি গণহত্যার জবাবে ইয়েমেনের ইরানপন্থী মিলিশিয়া হুতিরা লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলে বাধা দিতে থাকে। তাদের ঠেকাতে কাছাকাছি থাকা আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী সোমালিয়ার সমুদ্রসীমা থেকে নিয়ে আসা হয় লোহিত সাগরে। এই সুযোগ নেয় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এভাবেই বাংলাদেশি জাহাজ ও তার ২৩ নাবিক দুর্ভাগ্যের শিকার হয়। আর একদিন সকাল হয় উদ্বেগ নিয়ে যে, আমাদেরই ২৩ জন কোন অজানা বিপদের মধ্যে দিনাতিপাত করছে।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও পরিকল্পনা সম্পাদক, সমকাল।
উৎসঃ সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন