কার স্বার্থে আইএস দমন অভিযান
25 September 2014, Thursday
ইসলামী স্টেট, সংক্ষেপে আইএস কী? সহজ উত্তর- মাল্টি-ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ উপহার। একে সাইড ইফেক্টও বলা যায়। দু’দফায় নাম পাল্টে ইসলামী স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লিভান্ট (আইসিল) এবং ইসলামী স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইসিস) এখন ইসলামী স্টেট (আইএস)। এই স্বঘোষিত ইসলামী রাষ্ট্রের ‘খলিফা’ হলেন আবু বকর আল বাগদাদি। নাম পাল্টে বর্তমানে খলিফা ইব্রাহিম।
কে বা কারা এই আইএস? এদের হদিস করতে আমাদের আফগান মুজাহেদীনদের যুগে যেতে হয়। আফগানিস্তানে সোভিয়েতদের ঠেকাতে ওসামা বিন লাদেনের তত্ত্বাবধানে মুজাহেদীনরা প্রথম রণাঙ্গনের স্বাদ পায়। নানা ঘটনা প্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে বিন লাদেনের আল কায়দার ছত্রচ্ছায়ায় মুজাহেদীনরা অতঃপর তালেবানে পরিণত হয়। ‘নাইন-ইলেভেনের’ মূল আর্কিটেক্ট হিসেবে বিন লাদেন ও আল কায়দা তথা তালেবানকে চিহ্নিত করা হয়। তাই আল কায়দা ও তালেবান নির্মূল অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশ করে। কিন্তু আফগানিস্তানে ন্যাটোর বিশাল বহর তালেবান নির্মূলে ব্যর্থ হয়। তালেবানরা প্রতিবেশী পাকিস্তানেও ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে ২০১১ সালের ২ মে প্রেসিডেন্ট ওবামার করিৎকর্মা কমান্ডো দল অ্যাবোটাবাদের গোপন আস্তানায় গিয়ে বিন লাদেনকে হত্যা করে বটে, কিন্তু আল কায়দার বিনাশ তাতে হয়নি। আল কায়দা বা বৃহত্তর পরিসরে তালেবান চ্যাপ্টারটি নিয়ত ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে থাকে। তবে ইরাক, লিবিয়া বা সিরিয়ায় ঢোকার সুযোগ তারা পায়নি অনেক দিন।
কুয়েত যুদ্ধসহ বিবিধ কারণে সাদ্দাম হোসেন মার্কিন তথা পশ্চিমা শক্তির গলার কাঁটায় পরিণত হন। বুশ, ব্লেয়ার তো বটেই, ডিফেন্স পলিসি বোর্ডের প্রধান রিচার্ড পেরলেও বলেন, সন্ত্রাসের অবসান ঘটাতে হলে সাদ্দাম হোসেন নামক দানবটিকে খতম করা ছাড়া আর কোনো সমাধান নেই। ফলে অবৈধভাবে হলেও ২০০৩ সালের মার্চে ইরাকে আক্রমণ চালানো হয়। ফলাফল আমরা সবাই জানি। আক্রমণ পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যেই অভ্যন্তরীণভাবে ইরাক তিন উপদলে ভাগ হয়ে যায়। ‘আল কায়দা ইন ইরাক’ (একিউআই) নাম নিয়ে আল কায়দা সুন্দরভাবে গুছিয়ে বসে ইরাকে। নেতা আবু মুসাব আল জারকাভি ২০০৬ সালে আমেরিকানদের হাতে নিহত হন। কিন্তু একিউআই বহাল তবিয়তেই থাকে। আল জারকাভির অন্যতম মিশন ছিল ‘খিলাফত’ কায়েম করা। আবু বকর আল বাগদাদির নেতৃত্বাধীন এই একিউআই-ই সিরিয়ার আলেপ্পো, হোমস, রাকা ইত্যাদি শহর দখল করার পর ফিরে আসে আদি নিবাস ইরাকে। আল জারকাভির মিশনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নাম বদল হয়- আইসিল, আইসিস, আইএস! লক্ষ্য ইরাক এবং ঐতিহাসিক লিভান্ট নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
২০০৩ সাল থেকে প্রতিদিনই নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে অসামরিক ইরাকিরা মারা যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও ২০১১ সালে মার্কিনিরা পাততাড়ি গুটিয়ে ইরাক থেকে চলে আসে। অর্থাৎ ইরাকের ওপর সরাসরি মার্কিন প্রভাব আর থাকে না। কিন্তু ওই বছরই শুরু হয় আরব বসন্ত। মিসর ও তিউনেসিয়ায় সুশৃংখলভাবেই বাসন্তী হাওয়া সম্পন্ন হয়, কিন্তু লিবিয়া নৃশংস রক্তাক্ত পরিণতির শিকার হয়। ‘জনহিতৈষী বোমাবর্ষণ’ ও ভূমিতে যুদ্ধরত বিভিন্ন উপজাতির সঙ্গে ‘ইসলামী জঙ্গিরাও’ যুক্ত হয়। লিবিয়ার হালহকিকত ইরাকের তুলনায় ভালো কী মন্দ, বলা কঠিন। তবে লক্ষণীয় যে, ইরাক বা লিবিয়ায় পশ্চিমা শক্তি প্রফেশন্যাল ‘বুটস অন দ্য গ্রাউন্ড’ মোতায়েন না করে ভূমিযুদ্ধের দায়দায়িত্ব প্রধানত ‘গণতন্ত্রকামী’দের হাতে রেখে দেয়। ফলে লিবিয়ায়ও প্রতিদিন অসামরিকরা মারা যাচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট বুশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎজা রাইস ‘সৃজনশীল নৈরাজ্য’ বা ‘ক্রিয়েটিভ কেয়োস’ নামক নতুন এক কনসেপ্ট সৃষ্টি করেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, উপরোক্ত উভয় ক্ষেত্রেই কনসেপ্টটি কাজ করছে।
আরব বসন্তের পরবর্তী বা সর্বশেষ টার্গেট সিরিয়া। সাধারণ দাবি-দাওয়া নিয়ে ছোট্ট এক প্রতিবাদ মিছিল দ্রুত হাতবদল হয়ে অ-সিরীয় ‘বিদ্রোহী’দের হাতে চলে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকাভুক্ত, যেমন- আল নুসরা ফ্রন্ট, মার্টাস অব ইয়ারমুক ইত্যাদিও এ দলে ভিড়ে যায়। ফলে গৃহযুদ্ধের রূপ নেয়ার আগেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। চরমপন্থী বিদ্রোহী সুন্নি দল, আসাদের আলাভাইট প্রশাসনও শিয়াবিরোধী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু সাদ্দাম হোসেন বা গাদ্দাফির ভাগ্য আসাদ ঠেকাতে সক্ষম হন। ফলে জর্ডান ও তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে জিহাদিদের ট্রেনিং, অস্ত্রের জোগান দেয়া জরুরি হয়ে পড়ে। ওয়াশিংটন ও সৌদি আরব অস্ত্রের জোগান দেয়, উদারহস্তে আর্থিক সাহায্য প্রদানের দায়িত্ব নেয় উপসাগরীয় দেশগুলো। বলা যায়, ইসলামী জিহাদিরা ‘জামাই আদরতুল্য’ সমাদর পেতে থাকে।
বিদ্রোহীরা যখন-তখন সিরিয়া-তুরস্ক, সিরিয়া-ইরাক, সিরিয়া-লেবানন করতে থাকে। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে গুঞ্জন উঠলে ওয়াশিংটন যে ‘ভালো জিহাদি’ ও ‘মন্দ জিহাদি’র কথা বলে, সেটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ধোপে টেকেনি। বর্তমানে আলেপ্পোসহ সীমান্ত পেরিয়ে ইরাকের ভালো আকৃতির ভূখণ্ড ‘বিদ্রোহী’ আইসিলদের দখলে। তেল বিক্রি করে ধনী তারা। তাছাড়া দেড়-দুই বছর আগে সিরিয়ায় যাদের তারা বন্দি করেছিল, তাদের মুক্তি বাবদ বড়ো অংকের মুক্তিপণ ও ‘দানখয়রাতের’ ব্যাপারও রয়েছে। সিরিয়ার সরকারি অস্ত্রভাণ্ডার লুটকৃত, যার মধ্যে রাসায়নিক অস্ত্রও রয়েছে এবং চারটি ইরাকি ডিভিশনের লুটকৃত অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত তারা।
ওসামা বিন লাদেন কি কখনও ভেবেছিলেন, আল কায়দার শাখা আইসিল, আইসিস বা আইএস কমপক্ষে ৮০টি দেশের নাগরিকের বিশাল এক বহুজাতিক জিহাদিতে পরিণত হবে? কে জানে!
আইসিসরা ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকেই উত্তর ইরাকে গুছিয়ে বসতে থাকে। মসুল, কিরকুক দখল করে। মসুলে অবস্থিত তুর্কি কনস্যুলেটের ৪৯ জনকে বন্দিও করে তারা। সুন্নি-খ্রিস্টান-ইয়াজিদি, নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে সবাই দুর্বার আইসিসের শিকার হয়। বন্দি হয়, নিহত হয় বা ভয়ে পালিয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। ২০১৪ সালের জুনের মধ্যেই তাদের শক্তিমত্তা ও তেজ সুস্পষ্ট হয়ে যায়। অথচ পশ্চিমের মিডিয়া আইসিসের খবর জানায় আগস্টে! তাতে মানুষ কিছুটা ভড়কে গেছে বটে, তবে মিডিয়ার সব খবর ‘গলাধঃকরণ’, যেমন মার্কিন ও যুক্তরাজ্যের সাংবাদিকদের শিরñেদের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ নিরসনের কাজটি সহজ হচ্ছে না।
সৌদি ওয়াহাবি মতবাদের সঙ্গে আইসিসের সংঘাত নেই, অমিলও নেই। আবার অন্যভাবে তারাও ওয়াহাবিপন্থী। সৌদিদের মতো তারাও নিজেদের সুন্নি মুসলমান বলে দাবি করছে। শিয়ারা স্বধর্ম ত্যাগী, তাতেও দ্বিমত নেই কোনো। ওয়াহাবি মতবাদ অনুযায়ী আইসিসরা সিরিয়া, মসুলসহ যেখানেই গেছে, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে ভেঙে চুরমার করছে। সৌদিরাও মক্কা-মদিনার একাধিক ঐতিহাসিক স্থাপত্য, চিহ্ন ইত্যাদি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে বা আদি রূপ পাল্টে দিচ্ছে। এতই যখন মিল, তখন তো সৌদি ও আইসিসের মধ্যে কোনো তফাৎ থাকার কথা নয়! কিন্তু আইসিসরা সৌদিদেরও ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আইসিসকে বুঝতে সৌদি ওয়াহাবি মতবাদের ইতিহাস সাহায্য করতে পারে। তবে এ প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বরং অতি সংক্ষেপে আজ থেকে ১০০ বছর আগের চূড়ান্ত ঘটনার কথা বলা যাক। ১৯১৪ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে সৌদি (ওয়াহাবি) ইখওয়ানের সাহায্যে রাজা আবদুল আজিজ আল সৌদের মক্কা, মদিনা ও জেদ্দা দখলের ইতিহাস এবং অবশেষে ১৯৩০ সালের মধ্যে এ ইখওয়ানেরই বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমনের ঘটনা থেকে এটুকু অন্তত বলা যায়, আইসিস সেই সৌদি ‘ইখওয়ানি রেলিক’য়ের আধুনিক সংস্করণ। হাউস অব সৌদের সঙ্গে ব্যবধান সৃষ্টির মূল কারণ রাষ্ট্রীয় প্রশাসন কর্তৃত্ব দখল করে নেয়া, যা আদি ওয়াহাবি ডকট্রিনের পরিপন্থী।
‘বহুজাতিভিত্তিক আইসিসের সন্ত্রাস’ ঠেকাতে বহুজাতিভিত্তিক ‘বৈশ্বিক’ ব্যবস্থাও ধাপে ধাপে অবয়ব নিচ্ছে। সিরিয়ায় হামলা শুরু হয়েছে মার্কিন নেতৃত্বে। এর আগে টাকা-পয়সা, অস্ত্রশস্ত্র, ড্রোনের সাহায্যে বোমাবর্ষণ, এয়ার সার্ভিলেন্স, অডিয়ো হুমকি, যুদ্ধজাহাজের সার্ভিলেন্স- বেসরকারিভাবে সব শুরু হয়। সৌদিরা ৩০ হাজার সেনা পাঠিয়ে সীমান্ত পাহারার ব্যবস্থা করেছে। পাঁচ সারিবিশিষ্ট মজবুত ট্রান্সপারেন্ট দেয়াল তুলে ইরাকি সীমান্ত দ্রুত সিল করে বন্ধের কাজও প্রায় শেষ করে এনেছে। এখন শেষ পরিণতি কী হয়, সেটাই দেখার অপেক্ষায় আছি।
নাদিরা মজুমদার : চেক প্রজাতন্ত্র প্রবাসী সাংবাদিক
( যুগান্তর )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন