মাঝে মধ্যে মনে হয় আর লিখে কী হবে! অনেক তো লিখলাম। কেউ কি শুনছে? কে শুনছে? কারা শুনছে? যাদের শোনার কথা- তারা এ বাংলার তরুণ প্রজন্ম। যারা পড়ালেখা করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। যাদের হাতে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। যারা দেখাবে নৈতিক বাংলাদেশের আগামীর পথ। যাদের অশুদ্ধ রাজনীতি করার কথা নয়, সেই ছাত্ররাই হামলে পড়ছে তাদের শিক্ষকদের ওপর। তারা নিগৃহীত করছে নিজেদের শিক্ষকদের। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন শিক্ষক ছাত্রদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন। ড. ইয়াসমিন হক তাদেরই একজন। তিনি মিডিয়ায় যে বর্ণনা দিয়েছেন- তা আমাদের লজ্জাকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। তিনি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের সহধর্মিণী। এ দম্পতি যুক্তরাষ্ট্রের বিলাসবহুল জীবন পেছনে ফেলে রেখে বাংলাদেশে গিয়ে শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন।
খবর বেরিয়েছে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কিছু কর্মী এ হামলা চালিয়েছে। তারা কেন এমন আচরণ বেছে নেবে? তারা কেন এত হীন হতে যাবে? মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, আমার খুব কষ্ট লেগেছে, যখন ছাত্রলীগের ছেলেরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে হামলা করেছে। যে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই স্লোগানের এত বড় অপমান আমার জীবনে দেখিনি। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমার তো গলায় দড়ি দিয়ে মরা উচিত। ভিসি যদি মনে করেন এভাবে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে, তাহলে তিনি ভুল করেছেন।’ তিনি অভিযোগ করেন, ভিসিই ছাত্রলীগকে শিক্ষকদের ওপর ‘লেলিয়ে’ দিয়েছেন।
শাবিপ্রবিতে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে তার প্রতিবাদের ভাষা আমাদের জানা নেই। প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা জানছি- রোববার সকাল ৯টা থেকে ভিসি ভবনের সামনে পূর্বনির্ধারিত অবস্থান কর্মসূচি ছিল ভিসির অপসারণের দাবিতে আন্দোলনকারী ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদ’-এর। এর আগে সকাল ৬টা থেকেই ভিসি ভবনের সামনে অবস্থান নেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। সকাল ৭টার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা ভিসি ভবনের সামনে উপস্থিত হলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা নিজেদের সাধারণ শিক্ষার্থী দাবি করে শিক্ষকদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এ সময় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আবু সাঈদ আকন্দ, সহ-সভাপতি অঞ্জন রায় ও যুগ্ম সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম সবুজসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। সকাল ৮টায় ভিসি আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া তার কার্যালয়ে উপস্থিত হলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষকরা ভিসিকে তার কার্যালয়ে প্রবেশে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। শিক্ষকদের বাধা উপেক্ষা করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ভিসিকে নিয়ে তার কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা শিক্ষকদের ওপর চড়াও হন। একপর্যায়ে তারা আন্দোলনকারী শিক্ষকদের ওপর হামলা চালান। ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে শিক্ষকদের মারধর করেন। মারধরের শিকার হন ড. ইয়াসমিন হক, অধ্যাপক মো. ইউনুছ, দীপেন দেবনাথ, সৈয়দ সামসুল আলম, মো. ফারুক উদ্দিন, মোস্তফা কামাল মাসুদ, মোহাম্মদ ওমর ফারুকসহ কয়েকজন শিক্ষক।
প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্ররা শিক্ষকদের মধ্যকার আন্দোলনে পক্ষপাত করবে কেন? শাবিপ্রবিতে গেল কয়েক মাস থেকে যা ঘটছে, তা শিক্ষামন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কারোই অজানা নয়। বিষয়টির সুরাহা রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপেই হওয়া দরকার।
আমরা যারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি দেশে এখন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায়, তাদের জন্য এ ঘটনা খুবই হতাশাজনক। কেন শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া পূরণ করে শান্তি ফিরিয়ে আনা হচ্ছে না? এ মর্মান্তিক ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে একটি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমিন হকের দ্ইু সন্তান। ইউনিভার্সিটি অব আমস্টারডামের ড. নাবিল ইকবাল ও নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ডক্টরাল ছাত্রী ইয়েশিম ইকবাল লিখেছেন- ‘আমরা, ড. ইয়াসমিন হকের সন্তানরা ৩০ আগস্ট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে তার প্রতি এ লেখার মাধ্যমে ধিক্কার জানাই। শিক্ষকদের সন্তান হওয়ার সুবাদে আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বড় হওয়ার। সেজন্য আমরা খুব কাছ থেকে দেখে এসেছি শিক্ষকরা কেবল শিক্ষাদানের দায়িত্ব পালনের ঊর্ধ্বে গিয়ে কতটা ভালোবাসা আর আন্তরিক শ্রম দিয়েছেন ছাত্রছাত্রীদের প্রতি। সে কারণে আমরা ভীষণ হতবাক, কিছু ছাত্র এ ভালোবাসা ও আন্তরিকতার প্রতিদান দিল শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলে! আমাদের স্মৃতিতে যে ক্যাম্পাসের কথা মনে পড়ে, যেখানে আমরা বড় হয়েছি, সে একই ক্যাম্পাসের কিছু ছাত্র শিক্ষকদের ওপর, আমাদের মায়ের ওপর হামলা করতে পারে তা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমরা শাবিপ্রবির শিক্ষকদের ওপর এ আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানাই।’
এ নিন্দা আজ গোটা বাঙালি জাতির। আমি জানতে চাইছি আমাদের লজ্জার প্রকার কী? আর কত নীচ হলে আমরা মানুষ নামের তালিকা থেকে খারিজ হয়ে যাব? আর কত দেখতে হবে এমন অমানবিক-অনৈতিক মহড়া?
আমাদের মনে রাখা দরকার, আমরা বিশ্বব্যাপী একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। খুবই বেদনাদায়কভাবে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হয়েছেন ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের সুপরিচিত যুক্তিবাদী, চিন্তাবিদ এবং নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. মাল্লেশাপ্পা কালবুর্গি ।
ভারতীয় পুলিশের ধারণা, সম্প্রতি মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে এ শিক্ষকের কিছু মন্তব্যের সঙ্গে এ হত্যার সম্পর্ক থাকতে পারে বলে। মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে লেখালেখির জন্যই ডানপন্থী হিন্দু গোষ্ঠীগুলো ড. কালবুর্গির ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছিল। ৭৭ বছর বয়সী ড. মাল্লেশাপ্পা কালবুর্গিকে তার নিজ বাড়িতে একজন অজ্ঞাত পরিচয় বন্দুকধারী গুলি করে হত্যা করেন। খবরে আরও বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের জুন মাসে মূর্তিপূজার সমালোচনা করে ড. কালবুর্গি একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। এরপর তিনি এবং ইউ আর অনন্তমূর্তি নামে আরেকজনের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগ এনে মামলা করেছিলেন একজন হিন্দুত্ববাদী কর্মী। এর ২ বছর আগে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনে শহরে আরেকজন যুক্তিবাদী চিন্তাবিদ ড. নরেন্দ্র দাভোলকার খুন হয়েছিলেন।
প্রগতি ও যুক্তি যেখানে শিকলের অধীন, সেই ভূখণ্ডেই বেড়ে উঠতে হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রজন্মকে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একটি রাজনৈতিক ঐতিহ্য রয়েছে। এ ঐতিহ্য কিছু চিহ্নিত ভাড়াটের হাতে ম্লান হতে দেয়া উচিত নয়। বিষয়টি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে শান্তি ও ভ্রাতৃপ্রতিম সৌহার্দ্য ফিরিয়ে আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, সমাজ একটি আঁধারকাল পার করছে। এর উত্তরণ খুব জরুরি। এ স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের লজ্জার মাত্রা কেবল বেড়েই চলেছে।
একজন মুক্তিযোদ্ধা মানস মুখার্জি। ফরিদপুরের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। একজন মন্ত্রীর আক্রোশে পড়ে এ মুক্তিযোদ্ধা বৃদ্ধ মানুষটি এখন চাঁদাবাজির পাঁচটি মামলা নিয়ে ফরিদপুরের কারাগারে বন্দি! তার ছবি দেখলে কি মনে হয় তিনি একজন চাঁদাবাজ? না হয় না। তারপরও খবর বেরিয়েছে, এ মুক্তিযোদ্ধা একজন ক্ষমতাবান মন্ত্রীর প্রতিহিংসার শিকার। তার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করানো হয়েছে। একজন ৭০-ঊর্ধ্ব বৃদ্ধের বিরুদ্ধে করা এ মিথ্যা মামলাগুলো জামিনযোগ্য। তাকে এখন পর্যন্ত দু’বার জামিনও দেয়া হয়েছে। একবার জামিনে মুক্ত হওয়ার পর তাকে জেলগেট থেকে আবার গ্রেফতার করা হয়েছে। কী অদ্ভুত দেশ! কী আজব আমাদের বিজয়ের ফসল! সম্মানের সঙ্গে বসবাসের জন্যই মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন। সেই দেশে আজ আমরা কি এভাবে জিম্মিকাল কাটাব?
প্রশ্নটি আমি আবারও ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদেরই করছি।
ফকির ইলিয়াস : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কবি ও লেখক
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন