মিনার রশিদ
দাঁতের উপরে দাঁত থাকলে এটাকে বলে গ্যাজা দাঁত। এই গ্যাজা দাঁত অনেকের জন্যে মনোবেদনার কারণ হয়। তবে এই গ্যাজা দাঁত কারও কারও সৌন্দর্য হানি না করে তা আরও বাড়িয়ে দেয়। এমনই ভাগ্যবতীদের একজন তারানা হালিম। যৌবনে অনেকেই আমরা তার সেই গ্যাজা দাঁতের হাসি দেখে মুগ্ধ হতাম। সেই মুগ্ধতা এবং গ্ল্যামারের হাত ধরেই তিনি অভিনেত্রী থেকে নেত্রী হয়েছেন। অবশ্য দুর্মুখেরা বলেন নেতার মৃত্যুর একুশ বছর পর সদ্যমৃতের কান্না ডেলিভার করে তিনি এই পুরস্কারটি পেয়েছিলেন। এখন অনেকেই তাকে অনুসরণ করে একই বর পেতে চাচ্ছেন।
গোলাম মাওলা রনির সাথে এক টক শোতে দেখলাম এককালের গ্ল্যামার গার্ল তারানা হালিমকে! এপিসোডটি দেখে মনে হলো, বিনোদন জগতের এই সব নট-নটিদের বুদ্ধি ছাড়া আমরা সত্যিই অচল। আমাদের রাজনীতিতে বিদেশী তথা আমেরিকার নাক গলানোতে তিনি চরম ক্ষোভ আর গোস্বা প্রকাশ করেছেন! তাঁর মুখ থেকে নিঃসৃত প্রতিটা শব্দ থেকে আমেরিকার প্রতি ঘৃণা ঠিকরে পড়ছিল। আর দেশপ্রেমের একটা স্বর্গীয় রৌশনী চোখ মুখ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এই ফাঁকে আগের ভালোলাগার জায়গা থেকে তাঁর গ্যাজা দাঁতের সেই মনকাড়া হাসিটা মিস করে গেলাম!
'বদের বদ' সেই আমেরিকার সহযোগিতা গ্রহণ করা বিএনপির জন্যে কতটুকু গর্হিত কাজ হচ্ছে তা অত্যন্ত দরদ মাখা কন্ঠে বুঝিয়ে দিলেন এই অভিনেত্রী! সেদিন এই অভিনেত্রী থেকেও টক-শোর উপস্থাপিকার কণ্ঠটি যেন বেশি ভিজে গিয়েছিল!
কিন্তু তারানা হালিমদের প্রিয় সেই দেশটি যখন পাশের দেশটির স্রেফ করদ রাজ্য বনে গেল, সুজাতা সিংরা এসে যখন এরশাদকে ধমক দিয়ে নির্বাচনে নিয়ে গেল; দেশটিকে যখন পাশের দেশটির সাথে নিকাহ দেওয়া হলো; সেই নিকাহর নমুনা হিসাবে কাপড়চোপড়ে অনেক রক্ত-স্রাবের নিশানা স্পষ্ট হলো; আলগা মোমিন যখন ইন্ডিয়াকে বলে আসে হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে, সেই কথাটি যখন দেশে ফিরে উচ্ছ্বাস ভরে জানিয়ে দিল; তখন তারানা হালিমদের সেই চেতনা একটুও জাগ্রত হয় নাই। তারানা হালিম তার নেত্রীর মতই ভাবছেন যে গোল্ডফিশ মেমরির এই জাতি আগের সবকিছু ভুলে গেছে।
সেদিন আমেরিকা ও ব্রিটেন এদেশের গণতন্ত্র ধ্বংসে সহযোগিতা করেছেন আর আজ সেটা বুঝতে পেরে এক ধরণের অপরাধ বোধ থেকেই তা পুনরুদ্ধারে এগিয়ে এসেছেন। দুদিন আগে যে বাইডেনের সাথে এক কাতারে পোঁজ দেওয়ার জন্যে সারা বিশ্বকে হতবাক করে ঘাসের উপর দিয়ে ফাঁড়ি মারলেন, একটা সেলফি তুলতে পেরে দুনিয়া ফাটিয়ে ফেললেন- সেই বাইডেন আবার “গোলামের পুত গোলাম” বনে গেলেন!
যে ইন্ডিয়াকে হাতে পেয়ে আওয়ামীলীগ/শেখ হাসিনা ধরাকে সরা জ্ঞান করে আমেরিকার রাষ্ট্রদূতকে আক্রমণ করেছিল, আমেরিকার এক মন্ত্রীকে দুই আনার মন্ত্রী বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিল, একজন রাষ্ট্রদূতকে কাজের মেয়ে মর্জিনা বলে তিরস্কার করেছিল, খোদ সেই ইন্ডিয়াও উঠতে বসতে আমেরিকাকে নমস্কার করে। এটাকেই বলে সূর্যের চেয়ে বালির উত্তাপ বেশি কিংবা বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়। এখানে সূর্য আর বাঁশ হলো ইন্ডিয়া, বালি বা কঞ্চি হলো আওয়ামীলীগ সরকার।এ ই বালিকে কীভাবে ঠাণ্ডা করতে হয় আর কঞ্চিকে কীভাবে সোজা করতে হয় সেই তরিকাও বোধ হয় আমেরিকা খুঁজে পেয়েছে। আমেরিকার বর্তমান দৃঢ় অবস্থান নির্ধারণে উপরোক্ত অপমানগুলোও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। কাজেই 'ম্যাজিকেল লেডি' সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলবেন, এই আশা এবার দুরাশা হতে পারে।
চিকনা বুদ্ধির কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও শারীরিক ঢলাঢলির পরেও আগের সেই জায়গা থেকে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বকে নড়ানো যায় নাই। বরং একটা মুক্ত, অবাধ ও অংশগ্রহণমুলক নির্বাচনের জন্যে আগের চাপ উত্তরোত্তর বাড়ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, 'আমার ফাঁসি চাই' উপাখ্যানের মহানায়িকাকে নিয়ে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করে ফেলেছে জাতিসংঘ সহ সকল পশ্চিমা দেশগুলো। এবার ঘটনার পরপরই জাতিসংঘ জানিয়ে দিয়েছে যে এই সব (আগুন) সন্ত্রাসের মূল হোতা সরকারি দল! কাজেই ম্যাসেজ অত্যন্ত পরিষ্কার!
এই দস্যু রাণীর আগের সেই আগুন আগুন খেলা আর চলবে না! এর মধ্যে আবার আন্দোলনরত বিরোধীদলের কর্মীদের আগুনে পোড়ানোর সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন এই মাফিয়া রাণী। নিজের মত একটু পেঁচিয়ে বললেও এই নির্দেশের সরল অর্থটিই বুঝে নিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ সংশ্লিষ্ট সকল মহল!
একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে শর্তহীন সংলাপের তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর অন্তর্নিহিত অর্থ উপলব্ধি করে হাফ- হেডেড বা অর্ধ পাগল যেন পুরো পাগল বনে গেছে! তিনিও সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আগে বাইডেন- ট্রাম্প সংলাপে বসুক, তারপর আমিও বসব! তিনবছর কম-আশি বছরের নাবালিকার এই আবোল তাবোল কথার কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া মুশকিল!
ডাক্তার রোগীকে তার রোগ অনুযায়ী প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন। এখন রোগী ডাক্তারকে বলছে, এগুলো আগে আপনি খান, পরে আমি খাব। হিউব্রিস সিন্ড্রোম সহ আরও অনেক জটিল মানসিক রোগে আক্রান্ত এই রোগীকে কে বোঝাবে যে আমাদের দেশে যে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংকট, সেটা কি বাইডেন-ট্রাম্পদের দেশে রয়েছে? এই প্রেসক্রিপশন তো শুধু আমেরিকার না, এই প্রেসক্রিপশন জাতিসংঘের, এই প্রেসক্রিপশন ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ সমগ্র মুক্ত বিশ্বের!
আমাদের মাফিয়া রাণীর মত একই শখ থাকলেও ট্রাম্প জোর করে ক্ষমতায় থাকতে পারেন নি। আমেরিকায় যে সিস্টেম বা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়ে আছে সেখানে ট্রাম্পের মত একটা দুইটা পাগলকে কনটেইন বা ফিল্টারিং করে ফেলতে পারে। অথচ এক হাফ হেডেডের ধাক্কায় আমাদের পুরো দেশটির মাথার সকল কলকব্জা নষ্ট হয়ে পড়েছে।
আমেরিকার সিস্টেম মাইক মিলির মত সেনাপ্রধান জন্ম দেয়। যিনি ট্রাম্প কর্তৃক নিযুক্ত হয়েও ট্রাম্পের বদ মতলবের কাছে মাথা নোয়ান নি। বরং মাথা উঁচু করে জানিয়েছেন, We don’t take an oath to a king, or a queen, or to a tyrant or a dictator. We don’t take an oath to an individual. We take an oath to the Constitution, and we take an oath to the idea that is America — and we’re willing to die to protect it.”
অর্থাৎ জেনারেল মিলি মাইক বলেছেন, “আমরা কোন রাজা, বা রাণী, বা অত্যাচারী বা স্বৈরশাসকের কাছে শপথ নিই না। এবং আমরা একজন স্বৈরশাসকের কাছে শপথ নিই না। আমরা সংবিধানের শপথ নিই, এবং আমরা আমেরিকা এই ধারণার শপথ নিই-এবং আমরা এটি রক্ষা করার জন্য মরতে রাজি।"
কাজেই কোথায় আগরতলা আর কোথায় চৌকির তলা। মিলি মাইকের এই উচ্চারণের জন্যে আমেরিকার জনগণতো বটেই সারা বিশ্ব তাঁকে স্যালুট করেছে! কিন্তু আমাদের এখানে স্বৈরাচারের পদলেহী সেনাপ্রধানদের নাম শুনলেই মুখ থেকে থুথুর দলা বেরিয়ে আসে। এরা দুই বেলা ভাত খেয়ে নিজের মস্তবড় ভুরিতে তৃপ্তির হাতখানা বুলাতে থাকে। এদের নাম যুগ যুগ ধরে ঘৃণার সাথে উচ্চারিত হবে তাদের কাপুরুষতার জন্যে এবং দেশের মানুষের সাথে নিমকহারামির জন্যে। এরা সংবিধানের শপথ নিয়ে স্বৈরশাসকের তাঁবেদারি করে, স্বৈরাচারী শাসকের চৌকিদার হয়ে পড়ে।
দেশের ভেতরের সকল সিস্টেম ও প্রতিষ্ঠান যখন অকার্যকর হয়ে পড়ে তখন বাইরের শক্তির সহযোগিতা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। একারণেই গণতন্ত্রমনা জনগণ আমেরিকার এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছে। তাছাড়া আমাদের গণতন্ত্র ধ্বংস করার পেছনেও এই পশ্চিমা শক্তির একটা ভূমিকা ছিল। কাজেই এদেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার একটা দায় তাদের উপর পড়েছে।
বর্তমান এই অবস্থান থেকে ফিরে যাওয়া গণতান্ত্রিক বিশ্বের জন্যে কঠিন বৈকি! এই সব দস্যুরাণী বা মক্ষী রাণীদের জন্যে এটাই দুঃসংবাদ।
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, লেখক ও গবেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন