সদ্য বুয়েটে চান্স পাওয়া নতুন ছাত্রদের হলের ছাদে বা গণরুমে নিয়ে গিয়ে রাতভর অত্যাচার ও অশ্লীল আচার আচরণে লিপ্ত করাতো তৎকালীন সিনিয়রেরা। যার পুরোটা জুড়েই নেতৃত্বে থাকতো বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ছাত্রদের ক্লাস টেস্ট বা ল্যাব এক্সামের পূর্বে প্রস্তুতিকালীন সময়ে এসব র্যাগিং ও নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক ছাত্রই পড়াশোনার আগ্রহ ও ইচ্ছা হারিয়ে ফেলতো। শুধুমাত্র র্যাগিং এর কারণেই লেখাপড়া থেকে ছিটকে গিয়ে অনিয়মিত হয়ে পড়ার এরূপ অসংখ্য রেকর্ড বুয়েটে রয়েছে।
হলের সিট দখলঃ
একেকজন ছাত্ররাজনীতিতে পদপ্রাপ্ত ছাত্রের অধীনে একাধিক হলের সিট এমনকি একজন সম্পূর্ণ একা একটি রুম পর্যন্ত দখল থাকতো। যার ফলশ্রুতিতে নিজের সিটের অধিকার হারিয়ে গণরুমে কষ্টকর জীবন পার করতে হতো সারাদেশ থেকে পড়তে আসা অসংখ্য বুয়েটিয়ানদের। এসব সিট দখলবাজ দের দৌড়াত্ম্য এতই বেশি ছিলো যে, হলের প্রভোস্টও এদের ভয়ে চুপ থাকতো। পাশ করার পরেও বছরের পর বছর ধরে তারা হলের সিট দখল করে রাখতো। এমনকি সাধারণ ছাত্রদের সিট দখল করে সেটাতে নিজেদের পরিচিত অন্য ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক ভাইদের পার্মানেন্ট ভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে এরূপ বহু ঘটনা ছিলো তখনকার নিয়মিত বিষয়।
ক্যাফেটেরিয়া ও ক্যান্টিনে চাঁদাবাজিঃ
প্রায় প্রতিটি হল ক্যান্টিনে ও বুয়েটের সেন্ট্রাল ক্যাফেটেরিয়ায় লক্ষ লক্ষ টাকার ফ্রি খাবার খেতো ক্ষমতার দাপটে অন্ধ সেসব রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছাত্ররা। বুয়েট সেন্ট্রাল ক্যাফেটেরিয়ায় ছাত্রলীগ কর্নার নামে স্বতন্ত্র একটি স্থানও নির্ধারিত ছিলো ছাত্রলীগের জন্য। যেখানে তারা নিয়মিত কাচ্চি, বিরানী, খিচুড়ি সবই নিয়মিত ফ্রি খেতো আবার নিজেদের পরিচিত মানুষজনকেও খাওয়াতো। হলের ক্যান্টিন চালানো এসব নিম্নমধ্যবিত্ত ভাইদের থেকে এভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা মাগনা খেতে এদের এতটুকুও বিবেকে বাঁধতো না।
বুয়েটের ভবন নির্মাণকাজে বাঁধা: বুয়েটের একাধিক নির্মাণকাজ বহুদিন ধরে অসমাপ্ত ভাবে পরেছিলো শুধুমাত্র তৎকালীন ছাত্রলীগের চাঁদার দাবী পূরণ না করায়। ঠিকাদার চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায়, বুয়েট ছাত্রলীগ তৎকালীন নির্মাণাধীন NAME বিল্ডিং এর কাজ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বন্ধ করে দিয়েছিলো। যা কিনা আবরার হত্যার পরে পুনরায় চালু হয়েছিলো।
সাধারণ ছাত্রদের ডাইনিং অর্থ আত্মসাতঃ
প্রতিটি ছাত্র হলেই সাধারণ ছাত্রদের দু বেলা ভাতের টাকা আত্মসাৎ করে তা দিয়ে নিজেদের খায়েশ মেটাতো রাজনৈতিক মদদপুষ্ট ছাত্ররা। নিজেদের বাইরের কারো জন্য হল ডাইনিং এর ম্যানেজার হওয়ার পথ বন্ধ করে রেখেছিলো প্রতিটি হলের বুয়েট ছাত্রলীগ। খাবার হিসেবে বুয়েটের ছাত্রদের জন্য তারা যা ব্যবস্থা করতো তা ছিলো খুবই নিম্নমানের। প্রতি মাসেই ডাইনিং এর টাকা মেরে কোনো না কোনো ছাত্রলীগের নেতার বাইক কেনা ছিলো খুবই নিয়মিত ঘটনা। সাধারণ ছাত্রদের দু বেলা খাবারের টাকা এভাবে আত্মসাৎ করতে তাদের এতটুকুও বিবেকে বাঁধতো না।
ক্যাম্পাসে মাদকের আসরঃ
প্রতিটি ছাত্রহলেই নির্দিষ্ট কিছু রুমে নিয়মিত মাদকের আসর বসতো, যার নেতৃত্বে থাকতো ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সারাদিনই ঐসব রুম থেকে আসা গাঁজার গন্ধে আশেপাশে অবস্থান করাও দুরূহ ব্যাপার ছিলো। গাঁজা, মদ, ইয়াবা এমন কোনো নেশা নেই যেগুলো ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেবন করতো না। নেশায় মাতাল থাকা অবস্থায় জুনিয়র ছাত্রদের নির্যাতন করা ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমনকি এসব মাদকের সাপ্লাইয়ার হিসেবে যারা সুপরিচিত ছিলো, তারাও কোনো না কোনো হলের ছাত্রলীগের পদধারী নেতা ছিলো। নিজেদের পাশাপাশি সাধারণ বন্ধুদের মাঝেও তারা ভয়াবহ মাদকের নেশা ছড়িয়ে দিয়েছিলো।
প্রক্সি এক্সাম বিজনেসঃ
বুয়েট ছাত্রলীগের কুকর্মের ইতিহাসে অন্যতম একটি অধ্যায় ছিলো “প্রক্সি এক্সাম বিজনেস”। অর্থের বিনিময়ে তারা সারাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এডমিশন টেস্টে প্রক্সি এক্সাম দিতো। যার পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করতো বুয়েট ছাত্রলীগ। সাধারণ ছাত্রদের তারা প্রায়শই বিভিন্ন স্থানে প্রক্সি এক্সাম দিতে বাধ্য করতো। কেউ অসম্মত হলে তাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন থেকে শুরু করে হল থেকে বের করে দেয়ার পর্যন্ত হুমকি দিতো। তাদের দাপটের মুখে অনেক ছাত্রই বাধ্য হয়ে প্রক্সি এক্সাম দেয়ার মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হতো।
সুষ্ঠু নিয়ম মেনে নিয়োগপ্রাপ্ত ডিএসডব্লিউ কে অপসারণঃ
অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টরের যে অবস্থান, বুয়েটে সেই পদ কে বলা হয় DSW বা ছাত্রকল্যাণ পরিচালক। সর্বশেষ যখন প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম অনুসরণ করে কাশেম স্যার কে DSW হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো, তা তখনকার বুয়েট ছাত্রলীগের কাছে পছন্দসই ছিলো না। কাশেম স্যারের ক্ষমতাকালীন সময়ে ক্যাম্পাসে তাদের অন্যায় অপকর্ম গুলো বাঁধাগ্রস্ত হবে এটা তারা সহজেই বুঝতে পেরেছিলো। ফলে, “কাশেম স্যার ছাত্রবান্ধব নয়” এরূপ অপপ্রচার চালিয়ে তারা স্যারের DSW পদে নিয়োগ বাতিল ঘটায় এবং নিজেদের পছন্দের মানুষ হিসেবে বর্তমান DSW মিজানুর রহমান কে পদায়ন করে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন