আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বহুমুখী চ্যালেঞ্জে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। দুটি পর্বে এ চ্যালেঞ্জগুলো ভাগ করে তা মোকাবিলায় কাজ করছেন দলটির হাইকমান্ড। প্রথম পর্বে রয়েছে অর্ধডজন বিষয়। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়।
সে লক্ষ্যে চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা তৈরি করেছে দলটি। শিগগিরই সরকার পতনের একদফায় রাজপথে নামার প্রস্তুতি চলছে। আন্দোলনের চূড়ান্ড লক্ষ্যে পৌঁছাতে দল ও জোটের ঐক্য ধরে রাখা বিএনপির কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া মামলা-হামলা মোকাবিলা করে সফলভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়ন, ‘চেইন অব কমান্ড’ নিশ্চিত করা, সহিংসতা এড়িয়ে আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, জামায়াতের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক কী হবে-সেসব দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন হাইকমান্ড।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে এবার সফলতার বিকল্প ভাবছে না বিএনপি। দাবি আদায় হলে দ্বিতীয় পর্বে দলটির সামনে আরও কিছু কঠিন বিষয় আসবে। সেগুলোর মধ্যে আছে-যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো নিয়ে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, আসন ভাগাভাগি, যোগ্যদের মনোনয়ন দেওয়া এবং নির্বাচনে জয়ী হলে সবাইকে নিয়ে ঐকমত্যের সরকার গঠন। তবে কোনো কারণে আন্দোলন ব্যর্থ হলে দলটি নতুন করে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন প্রতিহত করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এরপরও সরকার যেনতেন নির্বাচন করে উতরে গেলে মামলা-হামলায় জর্জরিত বিএনপিকে টিকিয়ে রাখাই হবে তখন তাদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, সব দল মিলে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন হলে তখনও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মোকাবিলা করতে হবে তাদের। বিশেষ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। ইভিএম না থাকায় ভোটে সূক্ষ্ম কারচুপি হওয়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু ব্যালটে নির্বাচন হওয়ায় ভোটকেন্দ্রে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এ সরকার দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। প্রশাসনসহ সর্বত্র তাদের অনুসারীরা সক্রিয়। প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্র দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে পারে। তাই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও ভোটকেন্দ্র যাতে দখলে নিতে না পারে, সেই প্রস্তুতিও রাখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নেতাকর্মীদের কেন্দ্রে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, শুধু বিএনপি নয় জাতির সামনে এখন একমাত্র চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এ অবৈধ সরকারের পতন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভোটাধিকার নিশ্চিতে এর কোনো বিকল্প নেই। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সেই চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ভোট নিশ্চিত করা গেলে নির্বাচন সংক্রান্ত অনেক বিষয়ই সহজ হয়ে যাবে। আসন ভাগাভাগি, মনোনয়ন কিংবা অন্যান্য বিষয় নিয়ে জটিলতা হবে না।
বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করেই তারা ভোটে অংশ নেবে। দলটির নেতারা মনে করেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে ভোটের ফলাফল কী হবে, তা সবাই জানে।
তাই এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়া একই কথা। আন্দোলনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়েই গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। দল ও সমমনাদের একমঞ্চে এনে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে কর্মসূচি পালন করা অন্যতম চ্যালেঞ্জ মনে করছে দলটি। কারণ, আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের অপচেষ্টা চালানো হতে পারে।
বিএনপির কয়েক নেতা যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে ছোট দলগুলো নানা হিসাব মেলাতে ব্যস্ত থাকে। আদর্শের চেয়ে তাৎক্ষণিক চাওয়া-পাওয়াই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মধ্যে ভাঙন সৃষ্টিতে নানা উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। কোনো দল যুগপৎ আন্দোলন থেকে বেরিয়ে গেলে সেটা নেতিবাচক বার্তা দেবে। তাই আন্দোলনে সফলতা আদায়ে সমমনা দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ধরে রাখা কঠিন।
সমমনা দলগুলোর পাশাপাশি বিএনপির মধ্যে ঐক্য ও চেইন অব কমান্ড নিশ্চিত করাও হাইকমান্ডের দায়িত্ব। কারণ, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে সবকিছু হচ্ছে। দলের সিনিয়র নেতাদের এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। দলটির নেতারা মনে করেন, চূড়ান্ত আন্দোলন নস্যাতে সরকার নানা কৌশলের আশ্রয় নিতে পারে। অতীতের চেয়ে সাংগঠনিকভাবে দল বেশ শক্তিশালী। নেতাকর্মীদের মনোবল ভাঙতে সক্রিয় নেতাদের টার্গেট করে দেওয়া হতে পারে নতুন মামলা। আবার পুরোনো মামলাগুলোও সচল করা হতে পারে। অনেক নেতাকে টার্গেট করে তাদের মামলা দ্রুত শেষ করে দেওয়া হতে পারে সাজা। তাই মামলা ও সাজা মোকাবিলা করে রাজপথে টিকে থাকাও কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে প্রয়োজন একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। দেশে এমন একটি সরকার প্রতিষ্ঠাই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা কাজ করছি। এছাড়া দলীয় কিছু চ্যালেঞ্জ তো সব সময় থাকে। সেগুলোকে আমরা ততটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি না। দলীয়ভাবেই তা সমাধান করা হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলে অন্য সমস্যাগুলো এমননিতেই সমাধান হয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠানগুলো গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত হবে। তাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই আমাদের মূল লক্ষ্য।
বিএনপির একাধিক নেতা যুগান্তরকে বলেন, আন্দোলনে সফল হলে কিছু বিষয় সামনে আসবে। এর মধ্যে রয়েছে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া, মনোনয়ন চূড়ান্ত করা। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মাঠপর্যায়ে জনভিত্তি নেই। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে সবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তাই তাদের বাদ দিয়ে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা কঠিন হবে। আবার তাদের মনোনয়ন দেওয়া হলে দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা বাদ যাবেন। এতে দেখা দেবে ক্ষোভ ও হতাশা। সবাইকে ম্যানেজ করে মনোনয়ন চূড়ান্তে বেশ বেগ পেতে হবে হাইকমান্ডকে। সমমনা দলগুলো একসঙ্গে ভোট করলে জামায়াতকে নিয়ে কী করবে, তাও সামনে আসবে।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যুগান্তরকে বলেন, এ মুহূর্তে এ সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করাই বিএনপির সামনে সবচেয়ে বড় কাজ। কারণ, এ সরকার সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্বই দিচ্ছে না। তারা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা করে ক্ষমতায় টিকে আছে। আগামী দিনেও তারা যে কোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে মরিয়া। তারা সহজে দাবি মেনে নেবে, এটা ভাবার কারণ নেই। তাই এদের কাছ থেকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করাই হচ্ছে বিএনপির মূল লক্ষ্য।
তিনি বলেন, আন্দোলনে থাকা দলগুলো নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে বলে হাইকমান্ড ঘোষণা দিয়েছে। তবে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে নির্বাচন করার ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। যেহেতু আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে এ সরকারের পতন। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন হলে নির্বাচন নিয়ে আমাদের শরিকদের মধ্যে বোঝাপড়ায় সময় লাগবে না। কাজেই এ নিয়ে কোনো সংকটও হবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন