১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের এক করুণ স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজধানীর ফার্মগেটের আনোয়ারা পার্কের নাম। তবে এটি এখন আর পার্ক নেই। বর্তমানে মেট্রোরেলের বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী রাখার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে জায়গাটি। একারণে পার্কটি সর্বসাধারণের ব্যবহারের অনুপযোগী। আরও বিষয় হচ্ছে, এটি আর আগের রূপে ফিরবে না। পরিকল্পনা করা হচ্ছে, এই পার্কে একটি প্লাজা তৈরি করবে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। তবে আপত্তি জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা, উত্তর সিটি করপোরেশনসহ মাঠ ও পরিবেশ রক্ষার বিভিন্ন সংগঠন।
ফার্মগেটে পার্কের এই জায়গাটি গণপূর্ত অধিদফতরের। এটি রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের দায়িত্ব ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি)। অধিদফতরের অনুমতি নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে জায়গাটি মেট্রোরেলের প্রকল্প অফিস ও নির্মাণ উপকরণ রাখার কাজে ব্যবহার করে আসছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। এখন প্লাজা তৈরি করে জায়গাটি নিজেদের করে নিতে চাইছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে ডিএনসিসি’র জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসেন জানান, ১৯৬৯ এর ২৫ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের দ্বিতীয় দিন ঢাকার নাখালপাড়ার ৪৮৪ নম্বর বাসায় চার মাসের শিশু সন্তান নার্গিসকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলেন মা আনোয়ারা বেগম। এমন সময় পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ বাহিনীর বুলেট টিনের বেড়া ভেদ করে আনোয়ারা বেগমের গায়ে লাগে এবং তিনি নিহত হন। এই ঘটনায় তার স্মরণে মাঠটিতে আনোয়ারা বাগান নামে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এটি আনোয়ারা মাঠ নামে পরিচিতি পায়।
পার্কটি আগে যেমন ছিল (ছবি: সংগৃহীত)
তিনি আরও জানান, মাঠটি সংস্কার করে শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা ও বিনোদনের উপযোগী করে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের। এছাড়া এই পার্ক বয়স্কদের হাঁটার উপযোগী করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি একটি নান্দনিক জায়গা হবে।
তবে ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা যায়, মেট্রোরেলের চারটি স্টেশন প্লাজা নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। মেট্রোরেলের পরিচালন ব্যয় মেটানোর জন্য উত্তরা উত্তর, আগারগাঁও, ফার্মগেট ও কমলাপুর স্টেশনে হবে প্লাজা। মেট্রো প্লাজাগুলোয় বাণিজ্যিক কার্যক্রম থাকবে। বিভিন্ন দোকান, সময় কাটানোর জন্য হোটেল, রেস্টুরেন্ট, কফিশপ, বিনোদন কেন্দ্রসহ শিশুদের জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থা রাখা হবে। এতে মেট্রোরেল পরিচালনার ৩০ শতাংশ উঠিয়ে আনা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্লাজা নির্মাণের পরিকল্পনা আছে জানিয়ে ডিএমটিসিএল পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. আব্দুল বাকী মিয়া বলেন, ‘বিষয়টি এখনও পরিকল্পনার পর্যায়ে আছে। ধাপে ধাপে করবো। গণপূর্তের আমাদের জায়গা দিলে তারপর আমরা করবো। সেটা করতেও সময় আছে।’
এ বিষয়ে জানতে গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে গণপূর্ত অধিদফতরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্র জানান, যেহেতু এই বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি, তাই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ থেকে প্লাজা বানানোর অনুমতি চেয়ে মন্ত্রণালয়ের চিঠি এসেছে। এই চিঠি মিনিস্ট্রি পর্যন্ত গিয়েছে। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
পার্কটির বর্তমান চিত্র (ছবি: বাংলা ট্রিবিউন)
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে প্লাজা নির্মাণের জন্য পার্কের জায়গাটি দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, এমনটি জানিয়ে তিনি বলেন, সব দেশেই মেট্রোরেলকে বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও মাঠটি মেট্রোরেলে কর্তৃপক্ষকে দেওয়ার কথা চলছে। উত্তর সিটি করপোরেশন থেকেও ফার্মগেটের এই জায়গাটি চাওয়া হয়েছিল। তবে যেহেতু এটি গণপূর্তের সম্পদ, তাই সিটি করপোরেশন কেবল এর রক্ষণাবেক্ষণ ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করতে পারবে।
ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক আনোয়ারা পার্কে শপিং মল তৈরি করা হবে। এই মাঠটিকে ফার্মগেটের ফুসফুস বলা যায়। ফার্মগেটের মতো এরকম বাণিজ্যিক এলাকায় একটা খোলা উদ্যান থাকবে না, এটা তো মেনে নেওয়া কষ্টকর। এমনিতেই ফার্মগেটে যথেষ্ট শপিং মল, বাণিজ্যিক ভবন আছে। নতুন করে একটা না বানালে কিছু হবে না৷ আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ জানাবো যেন পার্কটি নষ্ট করা না হয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী খোলা মাঠ পছন্দ করেন। আশা করি তিনি আমাদের কথা শুনবেন।’
গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি বিজড়িত শহিদ আনোয়ারা বেগমের নামে এই পার্কটি থাকুক, দাবি এলাকাবাসীর। স্থানীয় বাসিন্দা ইফতি মাহবুব বলেন, ‘এই মাঠে আমাদের ছোটবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এখানে এক সময় আমরা ক্রিকেট খেলতাম। জায়গাটি কখনোই তেমনভাবে সংরক্ষণ ও পরিচর্যা করা হয়নি। মাঠটি বরাবরই অবহেলিত ছিল। এবার যখন আশপাশের সড়ক ও এলাকার উন্নয়ন হয়েছে, আশা করেছিলাম পার্কটির অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে। এখন শুনছি পার্কটিই আর থাকছে না। এটা এখানে শপিং মল নির্মাণের সিদ্ধান্তটি একেবারে ভুল বলে আমি মনে করি।’
পার্কের সঙ্গে লাগোয়া সড়কটিও ছিল দৃষ্টিনন্দন (ছবি: সংগৃহীত)
মেট্রোরেলের পাশে সুন্দর পার্ক ফার্মগেট এলাকার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে মন্তব্য করে জিনিয়া নামে এক পথচারী বলেন, ‘মেট্রোরেল একটা সুন্দর স্থাপনা। এর পাশে একটি দৃষ্টিনন্দন পার্ক থাকলে চলাচল করা মানুষদের মাঝে একটা প্রশান্তি আসবে। এমনিতেই ফার্মগেটজুড়ে বিল্ডিং আর বিল্ডিং। নতুন আর কোনও ভবন না হলেই ভালো।’
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত কয়েকটি ঘটনায় স্মৃতি হিসেবে রাজধানীর কয়েকটি স্থানেই স্থাপনা বা স্মৃতিফলক রয়েছে যা ধীরে ধীরে মলিন হয়ে যাচ্ছে৷ মোহাম্মদপুরে আসাদ গেট, ফার্মগেটের এই আনোয়ারা পার্ক এগুলো গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি বহন করে। তাই আমাদের উচিত হবে এগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা। যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এদেশ কত সংগ্রাম করে স্বাধীন হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস জানতে পারে।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘ঢাকার মতো কোটি কোটি মানুষের শহরে যেখানে পার্কের এত ক্রাইসিস সেখানে আরেকটি পার্ক ধ্বংস করে ভবন তৈরি এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এই অন্যায্যতার বৈধতা দেওয়ার কোনও সুযোগ নাই৷ ফার্মগেটের মতো এরকম ব্যস্ত একটা এলাকায় যারা নিয়মিত যাতায়াত করেন, স্থানীয় বাসিন্দা তারা দম ফেলবেন কোথায়? উন্নত বিশ্বে মেট্রোরেলের পাশেই সুন্দর পার্ক থাকে যেন নগরবাসী এসে কিছু সময় উপভোগ করতে পারেন। আমাদের তো এমনিতেই মাঠ-পার্কের সংকট যা আছে। তা যদি ধ্বংস করা হয় তাহলে তা জনগণের সঙ্গে অন্যায় করা হবে। আমরা আশা করি গণপূর্ত অধিদফতর গণমানুষের বিষয়টি বিবেচনা করবে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন