সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো আমাদের জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে নানাভাবে। সাধারণ যোগাযোগ থেকে পেশাগত প্রয়োজন—এর তুলনা হয় না। তবে অপ্রয়োজনে ঘণ্টার পর ঘণ্টাও কিন্তু আমরা কাটিয়ে দিই এসবের পেছনে। আপাতদৃষ্টে সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রলিং নিরীহ কার্যকলাপ মনে হলেও আমাদের মনের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব মারাত্মক। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে মাত্রাতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রলিংয়ের বেশ কিছু উদ্বেগজনক প্রভাবের প্রমাণ। এখানে কিছু সমস্যা এবং তা থেকে উত্তরণের ইঙ্গিত তুলে ধরা হলো—
হারিয়ে ফেলার ভয়
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকে নিজের ফিড থেকে বের হয়ে গেলে কি কেমন খালি খালি লাগে? মজার বা আকর্ষণীয় কিছু মিস করছেন, এমনটা মনে হয়? যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিকিৎসাবিষয়ক জার্নালের প্রকাশক বাইশিডেং পাবলিশিং গ্রুপ একটি গবেষণায় তুলে ধরেছে, ফিয়ার অব মিসিং আউট (ফোমো) বা হারিয়ে ফেলার ভয় আদতে মাত্রাতিরিক্ত সামাজিক যোগাযোগামাধ্যম স্ক্রলিংয়ের অন্যতম কারণ। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রমাগত অন্যের সাফল্য, আনন্দ, উচ্ছ্বাসের ছবি বা লেখা কিন্তু আপনাকে উদ্বেগ ও বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। তবে মনে রাখবেন, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে কিন্তু মানুষের আসল চেহারাটা ফুটে ওঠে না। এসব ক্ষেত্রে মানুষ কেবল তাঁদের বাছাই করা সবচেয়ে ভালো ছবিটাই দেয়, ভালো কথাটাই শেয়ার করে। তাই এটা উপলব্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা যা দেখি, তা দৈনন্দিন জীবনের কিছু সুনির্বাচিত অংশমাত্র।
নিজেকে তুচ্ছজ্ঞান
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের অন্যতম একটি বিপদ হলো তুলনার ফাঁদের পড়া। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক গবেষণাপত্র প্রকাশনা সংস্থা আটলান্টিস প্রেসের প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, অনলাইনে যাঁরা তথাকথিত ‘সফল’ বা ‘আকর্ষণীয়’, তাঁদের সঙ্গে নিজেকে ক্রমাগত তুলনা করার ফলে নিজের আত্মসম্মান কমে যেতে পারে। পাশাপাশি নিজের ভেতরে অসন্তোষ বাড়তে পারে কিংবা ঈর্ষা বা বিরক্তির কারণও তৈরি হতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না যে প্রত্যেকের চলার পথ ভিন্ন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাস্তবতার প্রকৃত উপস্থাপন খুব কমই দেখা যায়। তাই নিজের পথচলা ও অর্জনকে মূল্য দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আসক্তির চক্র
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওয়েবসাইট বা অ্যাপগুলো এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে আমরা আকৃষ্ট না হয়ে পারি না। এটা অনেকটা নেশাদ্রব্যের মতো। ফলে এ ক্ষেত্রে আমরা যেন পাখা গজানো পিপিলিকা আর ওসব ওয়েবসাইট আগুন! কাজেই মাত্রাতিরিক্ত স্ক্রলিংয়ের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের মানবিক সম্পর্ক, কমে যায় একাগ্রতা, উৎপাদনশীলতা ও ঘুম। আর এসবের ফলে সৃষ্টি হয় একটি ডোপামিন চক্র। তবে স্ক্রলিংয়ের সময়সীমা এবং উদ্দেশ্য ঠিক থাকলে এই ডোপামিন চক্র ভেঙে ফেলা সম্ভব। মাত্রাতিরিক্ত স্ক্রলিংয়ের হাত থেকে বাঁচতে সামাজিক কোনো কাজে নিজেকে যুক্ত করুন, উপকার মিলবে।
সংযুক্তির দুনিয়ায় একাকিত্ব
নামে ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম’ থাকলে কী হবে, মাত্রাতিরিক্ত স্ক্রলিংয়ে কিন্তু ব্যবহারকারী সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে পারেন বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেও পারেন। মানুষের সঙ্গে সরাসরি দেখা হওয়া কিংবা সৌহার্দ্যপূর্ণ যোগাযোগ কমে যাওয়ার ফলে একাকিত্ব, দূরে সরে যাওয়া ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি চরমভাবে ঘিরে ফেলতে পারে একজনকে। একটি সুস্থ সামাজিক জীবন বজায় রাখার জন্য ডিজিটাল ও অফলাইন কার্যক্রমের ভারসাম্য গুরুত্বপূর্ণ। সরাসরি যোগাযোগ ও কার্যকলাপ নিজের ভেতরে আনন্দ ও পরিপূর্ণতা নিয়ে আসে।
মাত্রাতিরিক্ত স্ক্রলিং থেকে নিজেকে রক্ষা করবেন কীভাবে?
ছোট ছোট সাধারণ কয়েকটি অভ্যাসের চর্চা করলে এর থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। প্রথমত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার সীমিত করে ফেলুন। একেবারে বাদ দেওয়ার কোনো দরকার নেই। কেবল সময়সীমা ও উদ্দেশ্যটা ঠিক করুন। বৈচিত্র্যময় কনটেন্ট উপভোগ করুন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, অফলাইন কার্যকলাপে যুক্ত থাকুন বেশি বেশি। প্রয়োজনে বা স্রেফ মনের আনন্দের জন্য বাস্তবের দুনিয়ায় মানুষের সঙ্গে কথা বলুন। প্রকৃতির কাছে যান। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবকে সময় দিন। বই, সিনেমা, নাটক থেকে শুরু করে যেকোনো শখের কাজে ডুবে যান। মনে রাখবেন, নিজেকে ভালো রাখার হাজারো উপাদান ছড়িয়ে আছে আপনার চারপাশে।
তথ্যসূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন