দেশের ব্যাংক খাতে নগদ টাকার চাহিদা আরো তীব্র হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নতুন টাকা ছাপানো অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ২০ জুন দেশে ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকায়। দেশে এর আগে কখনো এত পরিমাণে ইস্যুকৃত নোট দেখা যায়নি। ইস্যুকৃত নোটের ৯৫ শতাংশই ব্যাংক খাতের বাইরে চলে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, চলতি জুলাইয়ে এসে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। সাধারণত ঈদসহ যেকোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে নগদ অর্থের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু বর্তমানে কোনো উপলক্ষ ছাড়াই মানুষের মধ্যে নগদ অর্থ ধরে রাখার প্রবণতা বেড়েছে। বিশেষ করে গত সপ্তাহে সংঘটিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থার ঘাটতি আরো তীব্র হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত সপ্তাহজুড়ে দেশে সংঘাত-সংঘর্ষ, প্রাণহানি, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ জারির মতো ঘটনা ঘটেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে টানা পাঁচদিন বন্ধ ছিল ব্যাংকসহ অর্থ লেনদেনের আনুষ্ঠানিক প্রায় সব মাধ্যম। টাকা না থাকায় বন্ধ ছিল বেশির ভাগ এটিএম বুথও। ব্যাংকে টাকা থাকা সত্ত্বেও নগদ অর্থের সংকটে ছিল সারা দেশের মানুষ। এ অবস্থায় বুধবার টাকা তুলতে ব্যাংকের শাখাগুলোয় ছিল গ্রাহকদের লম্বা সারি। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ওইদিন ২৫ হাজার ৫২১ কোটি টাকা ধার নিয়েছে অন্তত ৩০টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। গ্রাহকদের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি ধারের অর্থে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) সংরক্ষণ করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বুধবার গ্রাহকদের নগদ টাকার চাহিদা পূরণ করার সামর্থ্য দেশের অনেক ব্যাংকেরই ছিল না। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এত পরিমাণ অর্থ ধার করতে হয়েছে। বৃহস্পতিবারও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি ধার দিয়েছে। দেশের দুই ডজনের বেশি ব্যাংকের দৈনন্দিন লেনদেন এখন পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারনির্ভর হয়ে পড়েছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জাফর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘টানা পাঁচদিন মানুষ অর্থ লেনদেন করতে পারেনি। এ কারণে বুধ ও বৃহস্পতিবার নগদ উত্তোলনের চাপ বেশি ছিল। এ সময় কিছু টাকা জমাও হয়েছে। আমরা নিজেদের সামর্থ্যের মধ্যেই গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে পেরেছি। এ দুদিন রেমিট্যান্স আসার প্রবণতা কিছুটা কম ছিল।’
প্রায় একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও কিছু দুর্ঘটনার কারণে মানুষের মধ্যে নগদ টাকা ধরে রাখার প্রবণতা বেড়েছে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ বাড়ছে। গত দুদিন নগদ টাকা উত্তোলনের চাপ থাকলেও আমাদের ব্যাংকের জমার পরিমাণও বেশ ভালো ছিল। রেমিট্যান্স প্রবাহ স্বাভাবিক হলে ব্যাংকগুলোয় তারল্য প্রবাহ বাড়বে। আশা করছি, দুই-চারদিনের মধ্যে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’
গত দুই অর্থবছর ধরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণ করে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বাজারে অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদহার (রেপো রেট) বাড়ানো হয়। কয়েক দফায় বাড়িয়ে রেপো রেট উন্নীত করা হয় সাড়ে ৮ শতাংশে। তুলে নেয়া হয় ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশের সীমাও। এরপর দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার ক্রমাগত বেড়ে ১৫-১৬ শতাংশে ঠেকেছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহও এখন বেশ স্থবির। আমদানি কমিয়ে আনা হয়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশ। শিল্পের উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি এ সময়ে বাজারে পণ্যের চাহিদারও পতন হয়েছে। এ পরিস্থিতিতেও ইস্যুকৃত নোট ক্রমাগত বাড়িয়ে চলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ডিসেম্বর শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত নোটের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এসে নগদ নোটের স্থিতি বেড়ে ২ লাখ ৮০ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এরপর ফেব্রুয়ারিতে তা আরো বেড়ে ২ লাখ ৮২ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। মার্চে ইস্যুকৃত নোটের স্থিতি দাঁড়ায় ২ লাখ ৯১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকায়। এপ্রিলে এসে ইস্যুকৃত এ নোটের স্থিতি বেড়ে ৩ লাখ ৫ হাজার ১৯৮ কোটি টাকায় ঠেকে। সর্বশেষ গত ২০ জুন ইস্যুকৃত নোটের স্থিতি ৩ লাখ ২৭ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের আস্থাহীনতার কারণেই ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ বাড়াতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোট ইস্যু করছে আর সে নোট ব্যাংকের বাইরে চলে যাচ্ছে। এত পরিমাণ নগদ নোট ব্যাংকের বাইরে রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কখনই সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের ভাষ্যমতে, ‘ডিজিটালের পর সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা বলছে। অথচ গত এক সপ্তাহ দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে রেখেছে। মানুষ এখনো অ্যাপভিত্তিক লেনদেন করতে পারছে না। এভাবে তো ‘ক্যাশলেস’ অর্থব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব নয়।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে দেশের অনেক ব্যাংক দৈনন্দিন লেনদেন সম্পন্ন করছে। কিছু ব্যাংককে নতুন টাকা ছাপিয়ে হলেও অর্থের জোগান দিতে হচ্ছে। এসবের প্রভাবে দেশে মূল্যস্ফীতির হার আরো উসকে উঠবে। মানুষ আরো বেশি ব্যাংক বিমুখ হবে। বিদেশী বিনিয়োগ আসার পথ রুদ্ধ হবে। বিদেশীরা দেখছে, সরকার চাইলেই এখানে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে পারে। ব্যাংকে লেনদেন বন্ধ করে রাখতে পারে। তাহলে কেন এ দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসবে। পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে সরকারের আগে নিজেকে সংশোধন করতে হবে।’
প্রায় দুই বছর ধরে দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, নগদ টাকার তীব্র সংকটে রয়েছে অন্তত এক ডজন ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়েও কিছু ব্যাংককে সহায়তা করে আসছে। এর মধ্যে কোনো কোনো ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) ১০০ শতাংশেরও বেশি। গত ঈদুল আজহার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দৈনিক ধারের পরিমাণ ছিল ১৫-২০ হাজার কোটি টাকা। তবে ঈদের পর ধারের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে আসছিল। গত ১১ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মাত্র ৬ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা ধার করেছিল কিছু ব্যাংক। ১৬ জুলাই এ ধারের পরিমাণ বেড়ে ৯ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। গত ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ বেড়ে ১৬ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। এরপর শুক্রবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত টানা পাঁচদিন ব্যাংক বন্ধ ছিল। এ সময়ে বন্ধ ছিল ইন্টারনেটসহ অর্থ লেনদেনের আনুষ্ঠানিক প্রায় সব মাধ্যম। বুধবার থেকে কারফিউ শিথিলকালীন সময়ে সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং চলছে। এক্ষেত্রে ব্যাংক খোলা থাকছে বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত। দেশের ব্যাংকগুলো তাদের অর্ধেক শাখা খোলা রেখে বুধ ও বৃহস্পতিবার ব্যাংকিং সেবা দিয়েছে। এর মধ্যে ২৪ জুলাই বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অন্তত ৩০টি ব্যাংক ২৫ হাজার ৫২১ কোটি টাকা ধার নেয়। বৃহস্পতিবারও ধার নিতে হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। রেপো, অ্যাসিউরড রেপো, অ্যাসিউরড লিকুইডিটি সাপোর্ট (এএলএস) ও শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর জন্য ইসলামিক ব্যাংকস লিকুইডিটি ফ্যাসিলিটির (আইবিএলএফ) মাধ্যমে এসব অর্থ ধার দেয়া হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন