টানা এক মাসের বেশি সময় ধরে গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে। এতে নিহতের সংখ্যা ১৩ হাজার ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছে ৩০ হাজারের বেশি। ধ্বংস হয়েছে হাজার হাজার ভবন। এসবের মধ্যে মসজিদ, গির্জা, স্কুল ও হাসপাতালও আছে।
এতে উপত্যকাটির অনেক অভিজাত এলাকাও অনেকটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তেমনই একটি এলাকা আল-জাহরা। সেই অভিজাত গাজান পাড়ার বাসিন্দারা গত ২০ অক্টোবর শুক্রবার দুপুরের দিকে, ধুলা-ময়লা আর ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এই ধ্বংসপ্রাপ্ত জায়গাটি এক সময় ছিল তাদের আবাসস্থল।
শুক্রবার দিনটি তাদের জন্য বিশেষ হওয়ার কথা ছিল। কেননা ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে শুক্রবার হলো প্রার্থনার দিন এবং এই দিন থেকেই সাপ্তাহিক ছুটি শুরু হয়। আল-জাহরায় এই ছুটির দিনের অর্থ ছিল ফালাফেল এবং হম্মুস, সেইসঙ্গে কফি এবং চা খাওয়ার দিন।
ভূমধ্যসাগরের তীর জুড়ে বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট বা ভিলায় থাকা এই পরিবারগুলো বিশেষ এই দিনে খাবারগুলো পরিবেশন করতো। এখানকার বাসিন্দারা জানতেন যে তারা গাজার অধিকাংশ বাসিন্দাদের চাইতে অনেক ভাগ্যবান।
কিন্তু এক রাতের মাথায়, ইসরায়েলি বোমা হামলা এখানকার ২৫টি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়, যেখানে অন্তত শতাধিক মানুষ বসবাস করতেন। গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার জবাবে গাজায় একটানা বোমা হামলা চালায় ইসরায়েল। কিন্তু ২০ অক্টোবরের আগ পর্যন্ত আল-জাহরায় কোনো হামলা চালানো হয়নি।
ধসে পড়া এই অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে যারা বাস করতেন, তাদের মধ্যে কেউ ডাক্তার, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, ফ্যাশন ডিজাইনার আবার অনেকে উদ্যোক্তা ছিলেন। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই তারা টিকে থাকা আর জীবনধারণের চেষ্টা করছেন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় খুব সামান্য কিছু সঙ্গে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন এই মানুষগুলো।
পরে তারা গাজা ভূখণ্ডের নানা জায়গায় আশ্রয় নেন। হানা হুসেন, আল-জাহরায় বেড়ে উঠলেও গত দুই বছর ধরে তিনি তুরস্কে থাকছেন। কয়েকশ মাইল দূর থেকে অনেক আতঙ্কের সঙ্গে গাজা উপত্যকায় হামলার নানা খবরে চোখ রাখছিলেন তিনি। ওইদিন তাড়াহুড়ো করে, তিনি তার পরিবারকে ফোন করে খোঁজ নিয়েছিলেন যে তারা নিরাপদে আছেন কি না।
সেখানকার ধ্বংস হওয়া অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের বাসিন্দারা বোমা হামলা থেকে বাঁচতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করেছিলেন স্থানীয় দন্ত চিকিৎসক মাহমুদ শাহীন। তিনি তার প্রতিবেশীদের দ্রুত ওই ভবন থেকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
হামলার দিন ভোর বেলায় এক ইসরায়েলি গোয়েন্দা এজেন্টের কাছ থেকে এই দন্ত চিকিৎসক ফোন কল পান। সেখানে তাকে সতর্ক করে বলা হয় যে ওই অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকগুলোয় কিছুক্ষণ পর বোমা ফেলা হবে।
মাহমুদ শাহীন এ বিষয়ে আরও নিশ্চিত হতে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) কাছে জানতে চান, তারা আল-জাহরার আবাসিক ব্লকগুলোয় হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না। এ বিষয়ে আইডিএফ বিবিসিকে জানায়, তারা নির্দিষ্ট কোন কোন স্থানে অভিযান চালাবে সে সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না।
হামাস, গাজা উপত্যকার বিভিন্ন স্থান থেকে ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ করছে এবং তারা বেসামরিক অবকাঠামোয় অবস্থান করছে, বলে জানিয়েছে আইডিএফ। তবে আল-জাহরায় হামলায় কোন হামাস যোদ্ধা নিহত হয়েছেন কি না এমন কারও নাম উল্লেখ করেনি আইডিএফ। ধারণা করা হয়, ওই হামলায় কেউ মারা যায়নি।
ইসরায়েল বলেছে, তাদের কৌশল হলো হামাসকে নির্মূল করা। হামাস বেসামরিক মানুষদের মাঝে থেকে, তাদের অভিযান পরিচালনা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আইডিএফ এর দাবি, তারা বেসামরিক মানুষ হতাহতের ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে।
যে এজেন্ট ওই দন্ত চিকিৎসককে ফোন করেছিলেন, তিনি এটাও বলেছিলেন, আমরা এমন অনেক কিছুই দেখি যা আপনি দেখতে পান না। মাহমুদের প্রতিবেশীরা সেদিন হয়তো সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছিলেন। কিন্তু এরপরে যা ঘটেছে, তা থেকে সবাই রক্ষা পায়নি।
বিবিসি দুই সপ্তাহ ওই এলাকা ঘুরে দেখেছে এবং সেখানকার বেশ কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে। সেখানে যেমন প্রতিষ্ঠিত বাসিন্দারা ছিলেন, সেইসঙ্গে ছিলেন উচ্চাভিলাষী নবাগত তরুণ।
তারা বিবিসিকে জানায় , তারা কীভাবে তাদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় হাতের কাছে যা কিছু পেয়েছে তা নিয়ে কোনোভাবে পালিয়েছে। এরপর তারা চোখের সামনে নিজেদের বাড়ি বিস্ফোরিত হতে দেখেন। এরপর গাজার চারপাশে এক অনিশ্চিত ভাগ্যের পথে পা বাড়ান।
গাজা উপত্যকা জুড়ে অস্থায়ী শিবির এবং অস্থায়ী ঘরগুলোয় যারা আশ্রয় নিয়েছেন, তারা তাদের প্রিয় এলাকাটির জন্ম ও মৃত্যুর গল্পের কথা বলতে চেয়েছেন। তাদের সঙ্গে বিবিসির টেলিফোনে যতোটা যোগাযোগ হয়েছে সেটাও বারবার কেটে যাচ্ছিল, ভাঙ্গা ভাঙ্গা ফোন কলে কথা হয়েছে।
কখনও কখনও ওইপাশ থেকে তীব্র বোমার শব্দ পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে ছিল বিক্ষিপ্ত কিছু হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা। তখন এই মানুষরা নিরাপদ আশ্রয় খোঁজার জন্য ছোটাছুটি করতেন। এজন্য তারা বেশিক্ষণ কথা বলতে পারতেন না।
গাজা উপত্যকায় তীব্র ইসরায়েলি হামলার সময় সাম্প্রতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার পরে, আল-জাহরার এক বাসিন্দার কাছ থেকে অবশেষে একটি ক্ষুদে বার্তা আসে। তিনি লিখেছিলেন, ‘জানতে চাওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমরা এখনো বেঁচে আছি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন