ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আদানি পাওয়ারের সঙ্গে করা বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিগুলো কতটুকু যৌক্তিক ও জাতির স্বার্থ কতটুকু রক্ষা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে মূল্যায়ন কমিটি করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেই কমিটির প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে৷
অন্তবর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘২০১০ সালের বিতর্কিত আইন নিয়ে তো আমরা কিছু করতে পারব না, কারণ সেটা আদালতের বিবেচনাধীন৷ তবে বিগত সরকারের সময় বিদ্যুতের যে চুক্তিগুলো হয়েছিল, সেগুলো রিভিউ করার জন্য আমরা একটা স্বাধীন কমিটি করেছি। ওই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব। কমিটি এখনো রিপোর্ট দেয়নি৷’
আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে গত শুক্রবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা বলেছে, বাংলাদেশ চুক্তিটি রাখতে পারে। সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ঝাড়খন্ডের গোড্ডার যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আদানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করে, সেখানকার উৎপাদন অন্তত ৫০০ মেগাওয়াট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা ১ হাজার ৪৯৮ মেগাওয়াট।
আদানির এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তির বিশেষ দিক হলো— এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট সক্ষমতার অন্তত ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি)। প্রয়োজন না থাকলেও ৩৪ ভাগ বিদ্যুৎ কিনতে হবে। তা না কিনলেও ওই পরিমাণ বিদ্যুতের জন্য আদানিকে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ পরিশোধ করতে হবে। প্রতি চার মাসের চাহিদা একবারে দিতে হবে। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পিডিবি কী পরিমাণ বিদ্যুৎ নেবে, তা ডিসেম্বরেই জানাতে হবে। কোনো কারণে বিদ্যুৎ না নিলেও আমদানি করা কয়লার দাম পিডিবিকে পরিশোধ করতে হবে।
সরকার চাইলেই এই চুক্তি বাতিল করতে পারে কিনা জানতে চাইলে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক শামসুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এই চুক্তি বাতিল করতে গেলে সরকারকে বেশ কিছু বিপদে পড়তে হবে। কারণ এই চুক্তিটি রাষ্ট্র করেছে। ফলে আমাদের অনেক গচ্চা দিতে হতে পারে। আবার তারা আন্তর্জাতিক আদালতেও যেতে পারে। ফলে চাইলেই এখন চুক্তিটি বাতিল করা সম্ভব নয়।’
তবে চুক্তির মধ্যে এমন কিছু ‘ব্যত্যয়’ হয়েছে, সেগুলো নিয়ে সরকার কাজ করতে পারে বলে তিনি মনে করেন। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এই প্রকৌশলী বলেন, ‘তারা আমাদের সঙ্গে কয়লার দাম নিয়ে প্রতারণা করেছে, সেটা নিয়ে ধরা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, এই চুক্তিটি যারা করেছে সেটা আমাদের দেশের স্বার্থবিরোধী হয়েছে। ফলে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আবার ক্যাপাসিটি চার্জ যেটা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা কোনো আইন মেনে করা হয়নি। ফলে বিষয়টি নিয়ে সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে৷’
২০২৩-২৪ অর্থবছরের সর্বশেষ নীরিক্ষা প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে পিডিবির এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, আদানির প্রতি ইউনিটে প্রায় ১২ টাকা খরচ হয়, যা ভারতের অন্যান্য বেসরকারি উৎপাদকদের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি। আর ভারতীয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানির তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি।
বিগত সরকারের এই চুক্তির অধীনে ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে আদানি ও অন্যান্য ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রায় ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে বাংলাদেশ।
ভারতের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘বাংলাদেশ চুক্তিটি পর্যালোচনা করলেও এ বিষয়ে আদানির কোনো ইঙ্গিত নেই। বকেয়া বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও আমরা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালিয়ে যাচ্ছি, যা উদ্বেগের বিষয়।’
আদানিসহ আরও কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ সংস্থার কাছে বাংলাদেশের মোট বকেয়ার পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এই অর্থের কিছুটা এখনই পরিশোধ না করা গেলে দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ আরও বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আদানির সঙ্গে চুক্তিতে বাংলাদেশ লাভবান হয়েছে কিনা জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এখানে অনেকগুলো বিষয় আছে। প্রথমত, আদানি নিজেদের প্লান্ট থেকে কয়লা ব্যবহার করে। সেটাতে যে মূল্য ধরা হয়, সেটা আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে অনেক বেশি। এখানে আরেকটা জিনিস আছে, তারা যদি কোন ট্যাক্স রিবেট পেয়ে থাকে সেটা মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় হবে। কিন্তু তারা ট্যাক্স সুবিধা পাওয়ার পরও মূল্যের সঙ্গে সেটা সমন্বয় করেনি। ফলে তাদের পাওনার বিষয়ে যেমন সমন্বয় দরকার, তেমনি মূল্যের সমন্বয়ও দরকার। এখন আপনি এটা বাতিল করতে গেলে যৌক্তিক কোন কারণ আছে কিনা? এই বিদ্যুৎ না এলে বাংলাদেশের বিদ্যুতের বিকল্প কি? সেটা কি নিশ্চিত করা গেছে? আবার সরকার যদি মনে করে, আর্থিকভাবে তাদের মূল্য পরিশোধ সম্ভব নয় বা কষ্টকর হচ্ছে বা সামর্থ্য নেই তাহলে চুক্তি বাতিলের দিকে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এই ‘ক্লজ’গুলো আছে কিনা সেটা দেখতে হবে৷’
পুরো বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য সরকার রিভিউ কমিটি করেছে। কমিটি গত ৩ আগস্ট জনগণের কাছে দুর্নীতির তথ্য চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদন এবং সরবরাহকারী সংস্থার দুর্নীতি সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত ইমেইলে পাঠানো যাবে। রিভিউ কমিটি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করবে।
পর্যালোচনায় গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে। কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন বুয়েটের অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আলী আশফাক, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক মোশতাক খান।
পর্যালোচনা কমিটির কাজ কতদূর এগিয়েছে জানতে চাইলে অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা কাজ করছি, এটি একটি বিশাল কাজ। কাজটা করতে আমাদের একটু সময় লাগবে। আমরা শুধু বিদ্যুৎ নয়, জ্বালানি নিয়েও কাজ করছি। ফলে পুরো কাজ শেষ না করা পর্যন্ত মন্তব্য করা কঠিন। তবে এটুকু বলতে পারি, আমরা আদানির সঙ্গে চুক্তির পুরো বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করছি৷’
প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালে দুই বছরের জন্য ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’ করে। পরে ২০১২ সালে দুই বছর, ২০১৪ সালে চার বছর, ২০১৮ সালে তিন বছর এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে পাঁচ বছরের জন্য আইনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।
এ আইনে এমন বিধান করা হয় যে, বিদ্যুতের জন্য জ্বালানি আমদানি অথবা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন অথবা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অন্য কোনো কার্যক্রম, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের কাছে প্রশ্ন উপস্থাপন করা যাবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন