কোটা পুনর্বহাল করে ৫ জুন হাইকোর্টের রায়ের পর থেকে আন্দোলন করে আসছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বুধবার (১০ জুলাই) হাইকোর্টের রায়ে আপিল বিভাগ চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা জারি করলেও সন্তুষ্ট হননি আন্দোলনকারীরা। আদালত নয়, নির্বাহী বিভাগ থেকেই সমাধান চান তারা। বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) হাইকোর্টের রায়ের প্রকাশিত মূল অংশে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটা পদ্ধতির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবে। এই অবস্থায় কোটা ইস্যুতে সমাধানটা কে দেবে, বিচার বিভাগ নাকি নির্বাহী বিভাগ- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে অনেকের মাঝে।
আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটাপদ্ধতি বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তখন সরকারি চাকরিতে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল ৩০ শতাংশ। এছাড়া ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা ছিল। সব মিলিয়ে ৫৬ শতাংশ।
কোটা বাতিল করে সরকারের পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর রুল দেন হাইকোর্ট। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৫ জুন রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে আদালত বাতিল হওয়া মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখেন। এরপর শুরু হয় কোটাবিরোধী আন্দোলন।
দুই ছাত্রের করা রিটের ওপর বুধবার (১০ জুলাই) জনাকীর্ণ আদালতে বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হয় শুনানি। রাষ্ট্র ও দুই ছাত্রের পক্ষের আইনজীবী হাইকোর্টের রায় স্থগিতের আবেদন জানান। আর বহাল রাখার পক্ষে মত দেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের আইনজীবী।
তিন পক্ষের শুনানি শেষে কোটা নিয়ে ৪ সপ্তাহের স্থিতাবস্থা জারি করেন আপিল বিভাগ। এর ফলে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালের সরকারের পরিপত্র অনুযায়ী নিয়োগ পরীক্ষা হবে। তবে সেটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত।
তবে আদালতের রায় প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, কমিশন গঠন করে কোটা পদ্ধতির সংস্কার ও স্থায়ী সমাধান হওয়ার আগে পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
সবশেষ বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) রাত ৯টার দিকে শাহবাগ মোড়ে সংবাদ সম্মেলনে শুক্রবার সারাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভ-সমাবেশের ঘোষণা দিয়ে অবরোধ তুলে নেন কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘১৮-এর পরিপত্র দিয়ে হাইকোর্টকে সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। এবার আর সেই সুযোগ আন্দোলনকারীরা দেবে না। আইন করে কোটার সমাধান করতে হবে। নিজেদের কাজ না করে সরকার আদালতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’
সংসদের জরুরি অধিবেশন ডেকে আইন পাসের কথাও জানান কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা। তা নাহলে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন তারা।
সরকার কী ভাবছে?
শুরু থেকেই সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, আদালতে বিচারাধীন থাকায় সেখানেই কোটার বিষয়টি সমাধান হতে হবে। বিচারাধীন বিষয়ে সরকার কথা বলবে না।
৯ জুলাই সচিবালয়ে কোটা আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত স্পষ্ট করেই বলেছেন, এটা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয় না, কোটার ইস্যুটি এখন সর্বোচ্চ আদালতের কাছে আছে। সর্বোচ্চ আদালত সেখানে সিদ্ধান্ত নিলে তারা সব পক্ষের কথা শুনে তারপরে সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দেবেন বলে আমি মনে করি।’
বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) সচিবালয়ের নিজ দফতরে জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের বলবো, ‘সরকারও চায় বিষয়টি নিষ্পত্তি হোক। কিন্তু যেখানে যে বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়া দরকার, সেখানেই তা নিষ্পত্তি হতে হবে। রাস্তা অবরোধ করে, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করার চেয়ে আদালতে যাওয়াই যৌক্তিক। ওখানে গিয়ে যৌক্তিকভাবে সব তুলে ধরলে একটি সহজ সমাধান হবে।’
কোটা সম্পর্কে একইদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান বলেন, ‘‘আমরা বলেছি, প্রধান বিচারপতি একটা নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, হাইকোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছেন, সেটা স্থগিত। পরবর্তী সময়ে যে মামলা চলছে, সেই মামলার রায় না হওয়া পর্যন্ত এটা স্থগিত থাকবে। কাজেই হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছিল, সেটা অচল, সেটা এখন নেই।’’
সিদ্ধান্ত এখন কোথা থেকে আসবে?
২০১৮ সালে কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া রায়ের মূল অংশ আজ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটা পদ্ধতির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবে। কোটা পূরণ না হলে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে পারবে।
তবে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখা সংক্রান্ত হাইকোর্টের দেয়া রায়ে চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দেয়ার পর প্রধান বিচারপতি শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘যারা আন্দোলন করছে তাদের মনেও ক্ষোভ রয়ছে। তবে তারা যেটা করছে সেটা অ্যাপ্রিসিয়েট করার মতো না। রাস্তায় আন্দোলন করে রায় পরিবর্তন করা যায় না। আমরাও তো মানুষ, বিভিন্ন দিকে কথাবার্তা হচ্ছে, কিন্তু বিষয়টা সলভ করতে হবে।’
একইদিন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, আপিল বিভাগের আদেশের পর আন্দোলন করার আর কোনো যৌক্তিকতা নেই।
এদিকে কোটা পুনর্বহাল স্থগিত চেয়ে রিটকারীদের আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, হাইকোর্ট ডিভিশনের রায়ে বলে দিয়েছেন সরকার কোটা পদ্ধতি আবারও ঠিক করতে পারবে একটি প্রজ্ঞাপন দিয়ে। আন্দোলনকারীরাও কিন্তু সংস্কারের কথা বলছে। সেটা যেহেতু অ্যাপিলেট ডিভিশনে গিয়েছে, অ্যাপিলেট ডিভিশনে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই জাজমেন্টের ওপর আর কোনো কাজ হবে না। সুতরাং যদি নির্বাহী বিভাগকেও ক্ষমতা দেয়, তাহলে এখন আপিল বিভাগ থেকে নিষ্পত্তি হওয়ার পর যেতে হবে।
সুতরাং, চার সপ্তাহের জন্য যে স্থগিতাদেশ রয়েছে সে পর্যন্ত অবশ্যই শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করা উচিত বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন