ভারতের ১৮ তম সাধারণ নির্বাচনের ফলে ‘নতুন’ সরকার ক্ষমতায় এসেছে যা অনেকটা ‘আগের’ সরকারের মতোই। নেতৃত্বে নরেন্দ্র মোদি-ই। তবুও, অনেকেই ভাবছেন, ভারতের প্রতিবেশীদের প্রতি দেশটির দৃষ্টিভঙ্গি এবং সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন হয় কিনা।
তিন ধরনের বিবেচনায় এমন প্রশ্নের উদ্রেক। প্রথমতঃ ভোটের দিক দিয়ে বিজেপি, বিশেষ করে মোদির সমর্থনের গুরুতর পতনের পর তিনি কিছু আত্মদর্শন করতে পারেন। দ্বিতীয়তঃ মোদির বিগত দুই মেয়াদে এই অঞ্চলে চীনের বিপরীতে ভারতের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে, যা স্পষ্টতই মোদির ‘প্রতিবেশী প্রথম’ বৈদেশিক নীতির ব্যর্থতা। তৃতীয়তঃ বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ ব্লকের শক্তি, যারা বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকারকে তার অভ্যন্তরীণ এজেন্ডা এবং বিদেশ নীতির উদ্দেশ্যের বিষয়ে চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশে যারা শেখ হাসিনার প্রতি মোদি সরকারের নিরঙ্কুশ সমর্থনকে গুরুতর গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের অনুঘটক হিসেবে দেখেন, তারা আশা করছেন, এসবের কারণে মোদির তৃতীয় মেয়াদ ভিন্ন রকম হয়ে উঠবে। যদিও, তারা উদ্বেগ ধরেই রাখবেন।
২০১৪ সালে বিজেপি যখন ক্ষমতায় এসেছিল তখন বাংলাদেশের কেউ কেউ আশা করেছিলেন যে, বাংলাদেশের সাথে নিজেদের সম্পর্কের বিষয়ে বিজেপির শাসনামল তার পূর্বসূরি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস থেকে ভিন্ন হবে। সেটি ঘটেনি।
অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে এ কারণে যে, সংসদে আসন সংখ্যা হ্রাস পেলেও বিজেপি এখনও ক্ষমতায়।
২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে অবাধ, সুষ্ঠু এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ খোলাখুলিভাবেই নয়াদিল্লির নিরঙ্কুশ হস্তক্ষেপের জন্য বলেছিল। নির্বাচনের পরপরই বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ স্বীকার করেন যে, ভারত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল। তিনি বলেন, ‘এ বছরের নির্বাচনেও ভারতের অবস্থান কি ছিল তা আপনারা সবাই জানেন।’
গত এক দশক ধরে (দু দেশের) সম্পর্ক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই ছিল অসম, প্রাপ্তির দিক থেকে বাংলাদেশ ছিল পেছনে।
সমানভাবে এটা বলাও গুরুত্বপূর্ণ যে, ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত স্বার্থ গ্রহণ করলেও, বিজেপি নেতারা বাংলাদেশিদের প্রতি নিজেদের ঘৃণা প্রকাশ করতে এবং তাদের ‘উইপোকা’ আখ্যা দিতে কখনই পিছপা হননি।
নির্বাচনের ফলাফল যেহেতু সরকারে কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় না, তাই মোদি সরকারের পদ্ধতি বা নীতিতে পরিবর্তন আসবে- এমনটি আশা করার কোনো কারণ নেই।
অন্য দুটি উপাদানও একই নীতির ধারাবাহিকতার পক্ষে।
ভারতের বাংলাদেশ নীতিতে ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের ব্যাপক সমর্থনের সকল চিহ্ন রয়েছে। গত এক দশকে, বিশেষ করে ২০১৩ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল, তখন ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কিছুই বলে নি।
দ্বিতীয়ত, ভারতীয় নীতি দেশটির নিরাপত্তা হুমকির ধারণা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্পষ্টতই বাংলাদেশকে নিরাপত্তার লেন্স দিয়ে দেখে। তারা মনে করেন, কেবল আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে শেখ হাসিনাই এটা নিশ্চিত করতে পারেন যে, ভারতের অশান্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো সহ পূর্ব ফ্রন্টে ভারতকে নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হতে হবে না।
এই ধারাবাহিকতার পক্ষে জোরালো যুক্তি থাকা সত্ত্বেও, (নতুন ভাবনার ক্ষেত্রে) অজানা উপাদান হল বিরোধী দলের ভূমিকা। তারা কি সরকারের আঞ্চলিক নীতিকে ইস্যুতে পরিণত করবে? কেউ কেউ স্মরণ করতে পারেন যে ২০১৮ সালে, কংগ্রেস প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে মোদি সরকারের বিদেশ নীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। কংগ্রেস মোদি সরকারের আঞ্চলিক নীতিকে ‘প্রতিবেশী হারানো’ বলে ডকুমেন্ট প্রকাশ করেছিল:
''গত তিন বছরের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় যে, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি কৌশলগত লাভের দিক থেকে খুব কমই অর্জন করেছে। ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতি ‘নেইবারহুড লস্ট’ নীতিতে পরিণত হয়েছে যেখানে ভারত বিচ্ছিন্ন এবং ‘বিশ্বাস না করতে পারা’ প্রতিবেশী হয়ে উঠেছে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অনেকের মধ্যেই নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযোগ রয়েছে৷ ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোকে উত্যক্ত করার এবং তাদের স্থানীয় রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপ করার প্রয়াস নিয়ে অনেক গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।''
কংগ্রেসের ডকুমেন্টে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছেঃ ''বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যার সাথে ভারতের ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ এবং ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তাদের সাথেও আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে চাপের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশেও ‘গুডউইল’ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।''
যদিও ২০১৮ সালের এই মূল্যায়ন এবং পরবর্তীকালের আরও ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারেন না; কিন্তু, এটিও সত্য যে এটা শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ এলায়েন্স (ইউপিএ) সরকারের আমলে; যখন তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং একটি বিতর্কিত নির্বাচনের আগে ঢাকা সফর করেছিলেন এবং সাবেক স্বৈরশাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি করিয়েছিলেন। সকল বিরোধী দলের বয়কট করা ওই নির্বাচনটি ছিল গণতান্ত্রিক ক্ষয়ের পথে এক বড় পদক্ষেপ এবং ভারতের ভূমিকাকে অনেক বাংলাদেশি কম করে হলেও হস্তক্ষেপকারী হিসেবে দেখেছিলেন।
কংগ্রেসের রাজনৈতিক বক্তৃতায় বাংলাদেশ ফের আবির্ভূত হয়েছিল গত বছর যখন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী মোদি-আদানি সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এবং কিছু দুর্নীতিমূলক অনুশীলনের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি স্পষ্টভাবে প্রশ্ন তোলেন যে "মোদি সরকারের বিদেশ নীতির উদ্দেশ্য কি শিল্পপতি গৌতম আদানিকে আরও ধনী করা।" তিনি মোদির ২০১৫ সালের বাংলাদেশ সফরের কথা উল্লেখ করেন, যখন আদানি গ্রুপ বাংলাদেশের সাথে একটি বিদ্যুৎ-উৎপাদন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। এর মধ্য দিয়ে ভারতের অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ যে দামে বিদ্যুৎ আমদানি করছে, তার চেয়ে তিনগুণ বেশি দামে রপ্তানির সুযোগ করে দেওয়া হয় আদানিকে।
এটি লক্ষণীয় যে ২০২৩ সাল থেকে এবং নির্বাচনী প্রচারের সময়, (রাহুল) গান্ধী বারবার “আদানি এবং আম্বানি”কে মোদি সরকারের দুর্নীতির প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদশে গণতন্ত্রের অবস্থা কি সেটা ভারতের বিরোধী দলগুলোর কাছে অজানা নয়। নির্বাচনী প্রচারণার সময় আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছিলেন, "বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং রাশিয়ার মতোই ভারতের গণতন্ত্রের পরিণতি হোক, তা আমরা চাই না।"
যারা বাংলাদেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করেন, তাদের কাছে এটা (নতুন) কোনো ধরনের উদঘাটন ছিল না, বরং এটা ছিল ভারতের কোনো জাতীয় রাজনৈতিক নেতা কর্তৃক বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অভাবের এক বিরল স্বীকৃতি।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়, পররাষ্ট্র নীতি মূলত নির্বাহী বিভাগের আওতায় থাকে এবং খুব কম ক্ষেত্রেই বিরোধীরা সেই পথ পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু, বিরোধী দলগুলো জবাবদিহির জন্য চাপ দিতে পারে এবং নীতিমালার পেছনের মূল উদ্দেশ্যগুলো প্রকাশ করতে পারে। কংগ্রেস দল এবং তাদের জোট নিজেদের ক্ষমতা ব্যবহার করে মোদির আঞ্চলিক পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে পর্যালোচনা করতে ইচ্ছুক কিনা তা ভবিষ্যতে দেখা যাবে। সে পর্যন্ত ভারত মোদির নেতৃত্বের তৃতীয় মেয়াদেও (বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে) একই অবস্থা বজায় রাখবে।
আলী রীয়াজ
[যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট আলী রীয়াজের এই লেখাটি ওয়াশিংটন ডি.সি. ভিত্তিক খ্যাতনামা ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগাজিনে ১০ জুন প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন তারিক চয়ন]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন