দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কষ্টে আছে সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে ফেব্রুয়ারি মাস শেষে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অথচ চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার। এক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেওয়া কোনো কৌশলই কাজে আসছে না। আমদানি শুল্ক কমানো, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন, ব্যাংকঋণের সুদ বৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়, বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়া- এর একটি কৌশলও
কার্যকর হয়নি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। যার ফলে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে পণ্যমূল্য। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে মূল্যস্ফীতি। জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বমুখিতা ও বাজার পরিস্থিতিতে চরম অব্যবস্থাপনার কারণে জীবনযাত্রার অস্বাভাবিক ব্যয় মেটাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে মানুষ।
জানা গেছে, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদের হার বাড়ানো হলেও বাস্তবে মূল্যস্ফীতি কমছে না। উল্টো বেড়ে যাচ্ছে। এতে ভোক্তার ওপর চাপ আরও বেড়েছে। গত আট মাসে সুদ ৮-৯ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন হয়েছে সাড়ে ১৩ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশের বেশি।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, একদিকে চড়া সুদের ফলে মূল্যস্ফীতির হার কমেনি, অন্যদিকে এত সুদে ঋণ নিয়ে উদ্যোক্তারা বিপাকে পড়ছেন। কারণ, এত সুদে ঋণ নিয়ে যে লাভ করছেন, তা থেকে সুদসহ ঋণের টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে ঋণখেলাপির প্রবণতা বেড়ে যাবে। আর বাংলাদেশের মতো দেশে ঋণের সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এর জন্য বাজার ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এখানে শৃঙ্খলা আনতে হবে। তা হলে পণ্যের দাম যৌক্তিক হবে। তখন মূল্যস্ফীতির হার কমবে।
আবু আহমেদ বলেন, ঋণের সুদের হার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এদিকে বেশি সুদে উদ্যোক্তারা ঋণ নেওয়া কমিয়ে দেওয়ায় কর্মসংস্থান কমে গেছে। এতে মানুষের আয় কমছে। বেকারদের চাকরি হচ্ছে না। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতিও কমছে না। এতে দুদিক থেকেই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে সবার আগে জিনিসপত্রের দাম কমাতে হবে। এর সঙ্গে বাজারে মনিটরিং জোরদার করতে হবে। জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। এতে করে মূল্যস্ফীতি কমবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বিবিএস তথ্যমতে, ফেব্রুয়ারি-২০২৪ শেষে খ্যাবহির্ভূত পণ্যের দাম কমায় আলোচ্য মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১৯ বেসিস পয়েন্ট কমে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জানুয়ারিতে ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। তবে সামগ্রিক ও খাদ্য খাতের মূল্যস্ফীতি এখনো অনেক বেশি। ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশে, যা আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ। একইভাবে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে নেমে এসেছে। রমজান মাসজুড়ে কাক্সিক্ষত হারে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় মার্চ শেষে মূল্যস্ফীতির চাপ আবারও বাড়তে পারে বলে মনে করে বিশ্লেষকরা।
এদিকে বর্তমান অবস্থায় দেশে মূল্যস্ফীতির উচ্চ হারকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মূল হুমকি বলে মনে করেন বিভিন্ন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা (সিইও)। সেই সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে দুই বছর ধরে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, সেটাকেও ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তারা। প্রাইস ওয়াটার হাউজ কুপারসের (পিডব্লিউসি) এক জরিপে অংশ নেওয়া দেশের বিভিন্ন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা এ রকম মন্তব্য করেছেন।
অবশ্য অর্থ বিভাগ আশা করছে, সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে আগামী জুন নাগাদ মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। অর্থ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বন্ধ করে ট্রেজারি বন্ড ও বিলের মাধ্যমে বাজার থেকে ঋণ নিচ্ছে। বাজারে অর্থ সরবরাহ সংকোচনে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে, বাজার সরবরাহ ঠিক রাখতে টিসিবি, ওএমএস বাড়ানো হচ্ছে। বাজার মনিটরিং জোরদার করা হবে। বিলাসপণ্য আমদানিতেও বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন