পুরান ঢাকার নিমতলীর ভয়াবহ আগুনের ঘটনা এখনও সবার মনে দাগ কেটে আছে। ২০১০ সালের ৩ জুনের সেই ঘটনায় অন্তত ১২৩ জনের মৃত্যু দেখে দেশ। এরপর গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি রাজধানীকে অগ্নিঝুঁকিমুক্ত করতে ১৭ দফা সুপারিশ করে। এর মধ্যে অন্যতম সুপারিশ ছিল পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম স্থানান্তর ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুসরণ করা। ওই সময় শিল্প মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে রাসায়নিক গুদামগুলো শ্যামপুর, কেরানীগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত ১৪ বছরেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। পুরান ঢাকার অনেক এলাকাতে এখনও রাসায়নিকের গুদাম ও ব্যবসা চলছে দেদার।
নিমতলীর ঘটনার ৯ বছর পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে মারা যান আরও অন্তত ৭১ জন। একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে নেভে ২৬ প্রাণ। এ ছাড়া মগবাজার, নিউমার্কেট, বঙ্গবাজার, সিদ্দিকবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে মাঝে মাঝেই অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এভাবে গত ১৪ বছরে রাজধানীতে বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ২৬৭ জনের মৃত্যু হয়। এর পরও এসব ঘটনায় দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। বিভিন্ন সময় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশও খেই হারিয়েছে।
এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদ বলেন, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা স্থানান্তরই ছিল প্রধান
সুপারিশ। সেটা যখন বাস্তবায়ন হয়নি তখন সহজেই বোঝা যায়, অন্য সুপারিশও কার্যকর হয়নি। আর বিএনবিসির অধ্যায় ৭-এ ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি স্বাধীন ইমারত নির্মাণ কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা আছে। সেটাও গঠন হয়নি।
জানা গেছে, রাজধানীকে অগ্নিঝুঁকিমুক্ত করতে বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশে আরও ছিল রাসায়নিক গুদামে রাজধানীর বাইরে বা প্রান্তসীমায় স্থানান্তর, যাচাই-বাছাই করে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া, অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত না থাকলে ভবন মালিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, নকশাবহির্ভূত কোনো অবকাঠামো তৈরি না করা উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি বিএনবিসিতে কোথায় কী ধরনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে, তা স্পষ্ট করে বলা আছে। তবে অন্তত ৮০ শতাংশ ভবনে সেসব মানা হচ্ছে না। আবাসিক ভবন, বাণিজ্যিক ভবন, হোটেল, রেস্টুরেন্টের গ্যাস সিলিন্ডারগুলো ভবনের নিচে একটি নির্দিষ্ট স্থানে রাখার কথা থাকলেও কেউ আমলে নিচ্ছে না। সেখান থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তলায় তলায় গ্যাস সরবরাহের কথা বলা হলেও তা করা হয় না। ভবনগুলো আগুনের সতর্ক করার যন্ত্র, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, পানির রিজার্ভার, ফায়ার এপিট রাখার কথা বলা আছে। মূল নকশা অবজ্ঞা করে ভবন মালিকরা ইচ্ছেমতো কাচ দিয়ে পুরো ভবন মুড়িয়ে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলছে। এতে বড় ধরনের অগ্নিঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। গ্রিন কোজি কটেজের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তবে তদারক সংস্থা হিসেবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (রাজউক) তা দেখভাল করেনি।
রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদা বলেন, ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যাপারে জাতীয় বিল্ডিং কোডে অনেক নির্দেশনা দেওয়া আছে। ঢাকার ৮০ শতাংশ ভবনে তা মানা হচ্ছে না। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে অগ্নিদুর্ঘটনায় এত হতাহত হতো না।
এ ব্যাপারে রাজউকের বোর্ড সদস্য (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) আব্দুল আহাদ সমকালকে বলেন, ভবনটি সঠিকভাবে তৈরি হচ্ছে কিনা, সেটা রাজউক তদারকি করে। এরপর ভবনটি ব্যবহার করার জন্য রাজউক থেকে অক্যুপেন্সি সনদ নেওয়ার নিয়ম আছে। তবে অনেকেই নিয়মটি মানছেন না। এর বাইরে বেশি তদারকি করার সক্ষমতা রাজউকের নেই। তবে সিটি করপোরেশন যখন ওইসব ভবনে ট্রেড লাইসেন্স দেয়, তিতাস গ্যাস ও বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ দেয়, তখন তারা বিষয়টি পর্যালোচনা করতে পারে।
নিমতলী ট্র্যাজেডির পর পুরান ঢাকার রাসায়নিক কারখানাগুলো শ্যামপুর, কেরানীগঞ্জ ও সিরাজদীখানে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। তবে তা কার্যকর না হওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মুখপাত্র আবু নাছের বলেন, এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের যে দায়িত্ব পালনের কথা ছিল, তার প্রায় সবকিছুই করে ফেলেছি। মাঠ পরিদর্শন করে ১ হাজার ৯২৪টি রাসায়নিক গুদামের তালিকা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ওই তালিকায় কোন কারখানায় কী মাত্রার ঝুঁকি আছে, তাও উল্লেখ করা ছিল। রাসায়নিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ট্রেড লাইসেন্স নবায়নও বন্ধ রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান বলেন, রাসায়নিক গোডাউনের জন্য মালিকদের শ্যামপুরে প্লট দেওয়ার জন্য একটি কমিটি আছে। কমিটি জমির যে সালামি নির্ধারণ করে দিয়েছিল তা ব্যবসায়ীরা দিতে রাজি হননি। পরে আবার দর কমিয়ে দেওয়া হয়। এর পরও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এ প্লট দেওয়ার জন্য কয়েকবার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এর পরও ব্যবসায়ীরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
এদিকে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩-এ স্পষ্টভাবে বলা আছে, অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত না করলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অভিযুক্ত ভবন মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে। মামলায় সর্বনিম্ন ছয় মাসের জেলের বিধানও উল্লেখ আছে। কিন্তু অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত না করার দায়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মামলার তেমন নজির নেই। বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পর তারা একটি মামলা করে, যেটা ফায়ার সার্ভিসের ভবনে হামলা করার অভিযোগে।
এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম বলেন, অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইনের ২০১৪ সালের বিধিমালাটি ২০১৯ সালে একটি মহলের স্বার্থের কারণে স্থগিত করা হয়েছে। এ কারণে মামলার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। এর পরও মামলা করা যায়, তবে মামলা ১০-১৫ বছর ধরে চলতে থাকে। আবার কর্মকর্তাদের বদলিসংক্রান্ত ঝামেলাও আছে। এ ছাড়া মামলার হাজিরা দিতে গেলে হয়তো সরকারের পক্ষ থেকে যাতায়াত ভাতা দেওয়া হয়। কিন্তু অন্য খরচ দেওয়া হয় না। এ জন্য অনেক সময় মামলা করা থেকে বিরত থাকতে হয়। এর পরও মামলার কাজটা সহজ হতো যদি বিধিমালাটা স্থগিত না থাকত। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সুযোগ আছে। তবে রাজউক বা সিটি করপোরশনের যে রকম ম্যাজিস্ট্রেট আছে, ফায়ার সার্ভিসের নেই। এ জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করা যায় না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন