ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হলেই জানা যায় হাসপাতাল বা ক্লিনিক অবৈধ। বলা হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি বা লাইসেন্স ছাড়াই চলছিল হাসপাতালটি। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটার আগেই কেন এমন হাসপাতাল বা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না বা তাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না এমন প্রশ্ন দীর্ঘ দিনের। সুন্নতে খতনার মতো সাধারণ সার্জারিতে সম্প্রতি দুইু শিশুর করুণ মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য খাতের অরাজকতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। দুটি ঘটনা প্রকাশের পরই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায় দুটি হাসপাতালই অনুমোদনহীনভাবে চলছিল।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন দায়িত্ব নেয়ার পর অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেছেন। মন্ত্রীর এমন নির্দেশ দেয়ার পরও একের পর এক ঘটনা সামনে আসছে।
অধিদপ্তর সূত্র জানায়, কিছুদিনের চলা অভিযানে সারা দেশে এক হাজার ২৮৫টি অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শিগগিরই প্রশাসনকে তালিকা পাঠাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাইসেন্স থাকলেও তারা শর্ত মানছে না। অনেকের লাইসেন্সও নবায়ন করা নেই।
লাইসেন্স দেয়া হয় এক বছরের জন্য, এক বছরের পর আবার নবায়ন করতে হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক বিভাগের একজন সাবেক পরিচালক জানান, ঢাকা ছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ক্লিনিকের লাইসেন্স যখন দেয়া হয় তখন ডাক্তার, নার্স, যন্ত্রপাতি ভাড়া করে আনে মালিক কর্তৃপক্ষ। সেটা দেখিয়ে তারা লাইসেন্স নেয়। ফলে অনেক ক্লিনিকই বাস্তবে শর্ত পূরণ করে না।
সবচেয়ে বেশি ঢাকায় ৪১৫টি অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক রয়েছে। এরপর ময়মনসিংহে ২৫২টি। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ২৪০টি, খুলনায় ১৫৬টি, রংপুরে ১১১টি, রাজশাহীতে ৫৫টি, বরিশালে ৪৮টি ও সিলেট বিভাগে ৮টি অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, অবৈধ প্রতিষ্ঠানের কোনোটি ক্লিনিকের লাইসেন্স নিয়ে এর সঙ্গে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কোনোটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়ে এর সঙ্গে ক্লিনিক পরিচালনা করে আসছে। আবার কোনোটি শুধু লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে ওই আবেদনের কপি ডেস্কের সামনে ঝুলিয়ে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে জানা যায়, দেশে প্রাথমিক নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যা ৫০ হাজারের মতো। যাদের অনেকেই এক প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা মোবাইল নম্বর দিয়ে ১০ থেকে ১২টি নিবন্ধন করেছে। অনেকের নিবন্ধন নম্বর থাকলেও প্রতিষ্ঠান আলোর মুখ দেখেনি। তবে সারা দেশে অনুমোদিত বেসরকারি হাসপাতাল আছে ৫ হাজার। এ ছাড়া ১০ হাজার ডায়াগনস্টিক সেন্টার চলছে অনুমোদন নিয়ে। ২০১০ সালের ২৮শে অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসার অবহেলায় ২৮০টির মতো অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৪০টির মতো নিষ্পত্তি করতে পেরেছে বিএমডিসি।
দেশের জনস্বাস্থ্যবিদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ আসার পর হাসপাতালের লাইসেন্স ছিল না বলা দায়সারা আচরণ কেন? মনিটরিং নেই। স্বাস্থ্যসেবা দিতে গেলে হাসপাতাল, ক্লিনিকের লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। এটা দেখার দায়িত্ব কিন্তু রাষ্ট্রের। মানুষের জীবন-মরণ নিয়ে খেলা চলছে দেশে। দেখার কেউ নেই। অবহেলায় এরকম গুরুত্বপূর্ণ সেবা দেয়ার সুযোগ নেই। এ ধরনের ঘটনা দেশের স্বাস্থ্যসেবার প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এসব বিষয় নিয়ে মানবজমিনের সঙ্গে কথা বলেন দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাপ্তি বেড়েছে। কিন্তু সক্ষমতা বাড়েনি। ফলে মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটছে। এখানে নজরদারির অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, এই সব বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। আইনের দুর্বলতা রয়েছে। ১৯৮২ সালের আইন দিয়ে এখন চলে না। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আইনকে যুগোপযোগী করা জরুরি।
মানুষ মারা যাওয়ার পর জানা যায় হাসপাতাল বা ক্লিনিকটি অবৈধ-এটা কেন? জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান মানবজমিনকে বলেন, যেখানে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে সেসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নেই। ওখানে নিম্নমানের সেবা দেয়া হয়। সম্প্রতি যে দু’টি প্রতিষ্ঠানে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তাদেরও লাইসেন্স নেই। ফলে অবৈধদের বিরুদ্ধে অভিযান করা হয়। এ পর্যন্ত ১ হাজার ২৭টি অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযান করা হয়েছে। এই সংখ্যাটি হাইকোর্টেও জমা দেয়া হয়েছে। সারা দেশে এ মুহূর্তে অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতালের সংখ্যা কতো জানতে চাইলে পরিচালক আরও জানান, বৈধ সংখ্যা ১৫ হাজার ২৫০টি। তবে অবৈধ যাদের লাইসেন্স নেই তাদের সংখ্যা বলা মুশকিল।
গত ৩১শে ডিসেম্বর খতনা করাতে ছেলে আয়ান আহমেদ (৫)কে নিয়ে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন বাবা-মা। অ্যানেন্থেসিয়া দেয়ার পর আর জ্ঞান ফেরেনি আয়ানের। সাত দিন পর ছেলের লাশ নিয়ে ফিরতে হয় বাড়ি। এ ঘটনায় দেশ জুড়ে তোলপাড়ের মধ্যেই মঙ্গলবার জে এস মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে খতনা করাতে গিয়ে শিশু আয়হাম তাহমিদ মারা গেছে। অভিযোগ সেই একই অ্যানেন্থেসিয়ায় অবহেলা। গত সোমবার ধানমণ্ডির একটি হাসপাতালে এন্ডোসকপি করতে গিয়ে ৩২ বছরের যুবকের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় রিপোর্ট না দেখে অ্যানেন্থেসিয়া দেয়ার অভিযোগ করে পরিবার। ইবনেসিনা হাসপাতালে ওয়ার্ডবয়ের বিরুদ্ধে রুশ কিশোরীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠে। ধারাবাহিক এসব ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি। দেশের পাঁচ তারকা হাসপাতাল, সাধারণ ক্লিনিক কোনোটাই বাদ যাচ্ছে না অভিযোগের তালিকা থেকে। এটা কি অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা নাকি অবহেলা তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
রাজধানীর মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল সেন্টারে খতনা করাতে গিয়ে শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, কিছুদিন আগেও এমন একটি ঘটনা আমরা লক্ষ্য করেছি। সে ঘটনায় আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থাও নিয়েছি। তবে সেই ঘটনার পরও যারা সতর্ক হতে পারেনি, এরকম আর কারও কোনোরকম দায়িত্বে অবহেলা বা গাফিলতি কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না। দোষী প্রমাণিত হলে স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির বিরুদ্ধে শুধু কঠোর ব্যবস্থা নেয়াই হবে না, ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলাকারী দোষীদেরও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে। যাতে পরবর্তীতে আর কোনো প্রতিষ্ঠান এরকম গুরুদায়িত্বে অবহেলা করতে সাহস না পায়। চিকিৎসায় অবহেলা পাওয়া গেলে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন