চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল ঘিরে সক্রিয় রয়েছে দালাল চক্র। চক্রটি সরকারি এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ফাঁদে ফেলে বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া, রোগীর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা নির্দিষ্ট ল্যাবে করানো এবং রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র নির্দিষ্ট ফার্মেসি থেকে কিনতে বাধ্য করে। চক্রটির উৎপাতে অতিষ্ঠ রোগীরা। এতে ব্যাহত হচ্ছে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মো. নূরুল আলম আশিক জানান, চমেক হাসপাতাল থেকে গত দুই বছরে ১৫৫ জন দালালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২০২২ সালে ২২ জন, ২০২৩ সালে ১১৮ জন এবং চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আরও ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জামিনযোগ্য ধারায় দালালদের আদালতে সোপর্দ করার কারণে সামান্য টাকা জরিমানা দিয়ে জামিন মিলছে। পরদিন থেকে আবারও তারা এ কাজে জড়িয়ে পড়ছে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৫৭ সালে আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল থেকে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। পরে ১৯৬০ সালে নগরীর কেবি ফজলুল কাদের রোডে মাত্র ১২০ শয্যা এবং সীমিত জনবল নিয়ে বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬৯ সালে ৫০০ শয্যায়, ১৯৯৬ সালে ৭৫০ শয্যায়, ২০০১ সালে এক হাজার ১০ শয্যায়, ২০১৩ সালে এক হাজার ৩১৩ শয্যায় এবং ২০২২ সালের জুনে দুই হাজার ২০০ শয্যায় উন্নীত হয় এ হাসপাতাল। তবে এ হাসপাতালে দৈনিক রোগী ভর্তি থাকে সাড়ে তিন হাজার। তিন পার্বত্য জেলাসহ চট্টগ্রামের ১৫টি উপজেলা ও নগরী ছাড়াও এ অঞ্চলে ফেনী এবং কক্সবাজারের বাসিন্দারা উন্নত স্বাস্থ্যসেবার জন্য আসেন এখানে।
শয্যার চেয়ে বেশিসংখ্যক রোগী ভর্তি থাকায় অনেককে থাকতে হচ্ছে হাসপাতালের মেঝেতে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এ হাসপাতাল থেকে রোগীদের অধিকাংশ ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। কম খরচে এ হাসপাতালের নিজস্ব ল্যাবে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ আছে। পাশাপাশি এ হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন চট্টগ্রামের নামকরা সব অভিজ্ঞ চিকিৎসক। তবে বিনামূল্যে চিকিৎসা নিতে আসা এ হাসপাতালের নিরীহ রোগীদের নিয়ে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেছে দালাল চক্র। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক, বিভিন্ন বেসরকারি ল্যাব এবং ফার্মেসির হয়ে এ হাসপাতালের ভেতরে কাজ করে।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা জাকির হোসেন বলেন, ‘চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র লেখা শেষ করলেই হাত থেকে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে নেয় দালালরা। এরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তাদের নির্দিষ্ট রোগনির্ণয় কেন্দ্রে যেতে বাধ্য করা হয়। বিভিন্ন ভয় দেখিয়ে ক্লিনিকে নিয়ে যায়। তাদের এই অত্যাচারে অতিষ্ঠ আমরা।’
হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মো. নূরুল আলম আশিক বলেন, ‘এ হাসপাতাল থেকে ২০২৩ সালে ১১৮ জন এবং চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আরও ১৫ জন দালাল চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়। এ চক্রের সদস্যরা মূলত তিনটি কাজ করে। যার মধ্যে আছে- চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ফুসলে বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য চমেক হাসপাতাল ল্যাবের পরিবর্তে বেসরকারি বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেওয়া এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ নির্দিষ্ট কোনও ফার্মেসি থেকে কিনতে উদ্বুদ্ধ করা। এ কাজের জন্য চক্রের সদস্যরা নির্ধারিত হারে কমিশন পেয়ে থাকে।’
পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত বছর চমেক হাসপাতাল থেকে বিপুলসংখ্যক দালালচক্রের সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মেট্রোপলিটন পুলিশ আইনে আটক দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়। এ আইন জামিনযোগ্য।’
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘দালালদের নিয়ে এখনও দেশে সুনির্দিষ্ট আইন নেই। এ কারণে তাদের মেট্রোপলিটন পুলিশ আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়। এটি জামিনযোগ্য। যেহেতু দালালরা হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে, হয়রানি করছে; সে জন্য তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া যেতে পারে।’
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, ‘দালালদের বিষয়ে কোনও আপস নেই। দালালের অস্তিত্ব পাওয়ামাত্রই তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হচ্ছে। আগে দালালরা হাসপাতাল থেকে যে পরিমাণ রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যেতো, তা এখন অনেক কমে এসেছে। চমেক হাসপাতালকে সম্পূর্ণ দালালমুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছি।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন