প্রত্যেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলেই প্রবীণদের জীবন সুন্দর হতে পারে। (ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
দিনটি প্রবীণদের জন্য, যাদের ‘সিনিয়র সিটিজেনের’ মর্যাদা দিয়েছে রাষ্ট্র। কিন্তু ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র— প্রতিটি ক্ষেত্রে নানান প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন এই মানুষগুলো। তিলে তিলে যারা নিজ পরিবার গড়েছেন, সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করতে ঝরিয়েছেন ঘাম। সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি— কোথায় নেই তাদের অবদান! অথচ বার্ধক্যে এসে এর প্রতিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য আর উপেক্ষার শিকার হতে হয় তাদের। এমনই এক কঠিন বাস্তবতায় বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। প্রতিবছর দিবসটি পালিত হলেও পরিস্থিতির কী কোনও উন্নতি হয়েছে, সেই প্রশ্ন সবার মাঝে উঁকি দিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করার আছে অনেক কিছু। তবু সবাই যেন নির্বিকার! প্রত্যেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলেই প্রবীণদের জীবন সুন্দর হতে পারে।
আজ রবিবার (১ অক্টোবর), আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। প্রতিবছর এদিন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হয় দিবসটি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা আয়োজন থাকে। বিশেষ করে প্রবীণদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্ণীল আয়োজন সবার চোখে পড়ে। ব্যক্তি পর্যায়েও এই দিনটি ছুঁয়ে যায় প্রবীণদের। তাই তারা ভালো থাকতে চান জীবনের শেষ দিন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। এই চাওয়া কী অযৌক্তিক বা খুব বেশি কিছু?
প্রবীণ দিবসকে সামনে রেখে আলাপ করতে গেলে শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর রমনা পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে এমন প্রশ্ন করলেন সাবিহ উদ্দিন (ছদ্মনাম)। তিনি সরকারি উচ্চ পদে চাকরি করে অবসর নিয়েছেন অনেক বছর হলো। তার বয়স এখন নব্বই ছুঁইছুঁই। আক্ষেপ করে বলছিলেন, প্রবীণদের কী অবস্থা, তা দেখতে আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার দরকার হবে না। আপনার আশপাশে তাকালেই দেখতে পারবেন, বুঝতে পারবেন। বিষয়টি নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে আমার পরিচয়টাও দিতে চাইছি না, বুঝতে পারছেন!
সমাজের শ্রেণিভুক্ত সাবিহ উদ্দিনের এক ছেলে, এক মেয়ে। তারা উচ্চ শিক্ষা নিতে ইউরোপের একটি দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। সে দেশেই থেকে গেছেন, বিয়ে করে পরিবার নিয়ে গেছেন। কিন্তু দেশেই থেকে গেছেন সাবিহ উদ্দিন ও তার স্ত্রী। সন্তানরা ভালো আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, তারা মোবাইলে কল করে, অনলাইনে ভিডিও কল করে। কথা হয়, দেখাও হয় ভার্চুয়ালি। তারা বলে, ভালো আছে। আমরাও ভালো থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু এভাবে কী আর ভালো থাকা যায়!
সন্ধ্যার পরে শিল্পকলা একাডেমির মাঠে সবুজ ঘাসের ওপর তিন প্রবীণ বসে আছেন। তারা সবাই মোটামুটি মধ্যবিত্ত বলা যায়। তাদের সঙ্গে কথা শুরু হলো গল্পের ছলে, ফাঁকে প্রবীণদের নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আসতে থাকে মিশ্র জবাব।
মেজবাহ উল ইসলাম (৬৫) বলছিলেন, আমরা আমাদের যৌবনের সেরা সময়, শ্রম এবং সকল উপার্জন বিনিয়োগ করেছি সন্তানদের জন্য, পরিবারের জন্য। তারা এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নিজেদের সন্তান, পরিবার হয়েছে। তারা তাদের ভবিষ্যৎ গড়তে আমার মতো সব কিছু বিনিয়োগ করছে। কিন্তু তারপরও একটা মৌলিক পার্থক্য আছে দুই প্রজন্মের মধ্যে। আমরা বাবা-মায়ের সঙ্গে যৌথ পরিবারে থাকতাম এবং তাদের ও সন্তানদের প্রতি সমান যত্নবান হতাম। সন্তানদের ক্ষেত্রে দেখছি প্রায় তার উল্টোটা। আমার একার পরিবারে নয়, আমাদের সমাজেই এমন পরিবর্তনটা লক্ষ করছি।
এসব কথা যখন মেজবাহ সাহেব বলছিলেন, তখন পাশে বসে থাকা আনোয়ার হোসেন ও জিল্লুর রহমান মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছিলেন। নিজের ভিন্ন অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা দাদা-দাদির সঙ্গে খেলা করে বড় হয়েছি। আর এখন নাতি-নাতনিরা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাদা বাসায় থাকায় আমরা বুড়োরা গল্প করছি, দেখতেই পাচ্ছেন। জিল্লুর রহমান বলেন, আমরা বাবা-মাকে যেভাবে গুরুত্ব দিতাম, এখন সেভাবে উপেক্ষা করে সন্তানরা। এটা অনেক সময় যন্ত্রণা দেয়।
ষাটোর্ধ্ব রমিজ মিয়া এখনও রাজপথে রিকশা চালিয়ে নিজে উপার্জন করেন। তা দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করেন তিনি। বাসাবোতে তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে বলেন, একটা মেয়ে আছে, বিয়ে দিয়েছি। সে স্বামীর সংসারে। আমি ও আমার স্ত্রী একটা বাসায় থাকি। এখান থেকে কাছেই, ছোট একটি বাসা। মেয়ে মাঝেমধ্যে আসে, খোঁজখবর নেয়। আমার ইনকাম দিয়ে আমার সংসার চলে। একটা ছেলে থাকলে হয়তো এই বয়সে এত কষ্ট করতে হতো না। বয়স্ক ভাতা পেলে হয়তো আরেকটু ভালো থাকতে পারতাম। জিনিসপত্রের যে দাম, অন্য কিছু ভাবার সময় কই!
সত্তরোর্ধ্ব আফসার গাজী পান-সিগারেট বিক্রি করেন রামপুরার দক্ষিণ বনশ্রীতে। তিনি বলেন, ছেলে আছে দুইটা। আলাদা থাকে বউ নিয়া। আমি একা থাকি। যা আয় হয়, তা দিয়ে চলতে হয়। ছেলেরা খোঁজখবর নেয়। এভাবেই চলছে জীবন। মরার আগ পর্যন্ত এভাবেই হয়তো চলতে হবে। কিন্তু সন্তানদের কত কষ্ট করে বড় করেছি, চিন্তা করলে কষ্ট লাগে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
গ্রুমিং ফ্রিক্সের ডিপ্রেশন ও ট্রমা বিশেষজ্ঞ এবং সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর সামিয়া আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের কাছে আসা প্রবীণদের কমন সমস্যা হলো— একাকীত্বে ভোগা। এটা হচ্ছে প্রথম এবং প্রধান সমস্যা। পরিবারের সঙ্গে থাকলেও সদস্যদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছেন না। আবার পরিবার থেকে আলাদা থাকলে তো কথাই নাই। সবার সঙ্গে প্রবীণদের দূরত্ব তৈরি হয়। সেবা-যত্নটা প্রত্যাশা অনুযায়ী হয় না অনেক সময়। তারা মনে করেন, তাদের উপার্জন না থাকায় গুরুত্বটা কমে গেছে।
তার মতে, মানুষের বয়স হলে অনেক সময় হীনম্মন্যতা ভোগে। নিজের অক্ষমতা মাথায় আসে, নিজের সফলতা-ব্যর্থতা, অবদানসহ নানা কিছু কিন্তু করতে থাকে। ভাবে, পরিবারের জন্য সব করলাম কিন্তু কী পেলাম? জীবনে কত যে স্বপ্ন বা আশা পূরণ হয়নি, তা অজান্তেই ভাবনায় আসে। নিজের বিসর্জন আর অর্জনের হিসাব মেলাতে থাকেন অনেকে। অবসর সময়ে অনেক কিছু ভাবার সময় পান তারা। এ ক্ষেত্রে নেগেটিভ বিষয়গুলো বেশি প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায়। এখান থেকে ডিপ্রেশন কাজ করে।
প্রবীণদের ক্ষেত্রে 'জেনারেশন গ্যাপের' নতুন একটা সমস্যা দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন সায়া আলম। তিনি বলেন, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সম্পর্কটা সেভাবে থাকে না, এটাও একটা বড় কারণ। নতুন প্রজন্মের সঙ্গে আগের প্রজন্মের একটা মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আমাদের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে আমাদের বাবা-মায়েদের চিন্তা-ভাবনার একটা পার্থক্য রয়েছে। এখনকার জেনারেশনটা একটু অন্য রকম। তথ্য-প্রযুক্তির প্রভাব, সামাজিক প্রভাব, অর্থনৈতিক প্রভাব, রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি যেমন আছে, তেমনই এসব কারণে এখনকার প্রজন্মের সাথে আগের প্রজন্মের একটা গ্যাপ তৈরি হচ্ছে। এই জেনারেশন গ্যাপ অনেক ক্ষেত্রে ক্লেশ তৈরি করছে। তা ছাড়া প্রবীণদের ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধার নানা সীমাবদ্ধতা তো আছেই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন