সাম্প্রতিককালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ বেড়েছে। চলতি বছরের ছয় মাসে বাংলাদেশি নতুন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ হাজার ৪৪টি নিবন্ধন নিয়েছে । দুবাই চেম্বার অব কমার্সের পরিসংখ্যান সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সংগঠনটি চলতি মাসে নিজেদের ওয়েবসাইটে এই তথ্য প্রকাশ করে। মাসের শুরুতে চেম্বার জানায়, সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী- দুবাই চেম্বারে সব মিলিয়ে সদস্য হিসাবে নিবন্ধিত বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৯৭৫টিতে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দুবাই চেম্বার এমন সময়ে নতুন সদস্য হিসেবে যুক্ত হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা প্রকাশ করলো যখন বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির আড়ালে ও হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা রেখে দেয়ার অভিযোগ জোরালো হয়ে দেখা দিয়েছে। নির্বাচনকালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেটি আরও বাড়ে। এ ছাড়া ইদানীং দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে দুবাইয়ে ব্যবসার কথা প্রায়ই আলোচিত হচ্ছে। তাদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপে বিনিয়োগে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। কমপ্লায়েন্স পূরণ করতে হয়। এতে করে ঝামেলা এড়াতে দুবাইয়ে ঝুঁকছেন ব্যবসায়ীরা।
সূত্রমতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ পাঠাতে পারে না।
বিজ্ঞাপন
এখন পর্যন্ত খুব কমসংখ্যক দেশি প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন পেয়েছে। গত জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ১৭ প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুমোদিত বিনিয়োগ প্রায় ৪০.১৫ মিলিয়ন ডলার। তবে দুবাই চেম্বার বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের পরিমাণ প্রকাশ করেনি। বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে বিনিয়োগের অনুমতি নিয়ে কেউ ইউএইতে ব্যবসা করছে না, এমন তথ্য জানা গেছে। বৈধ অনুমতি না থাকলেও ইউএই’র দুবাই, শারজাহ, আবুধাবি, আজমানসহ বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশিরা নিজের ও অন্যের নামে ভিলা, ফ্ল্যাট, ছোট হোটেল, তারকা হোটেলসহ নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছেন। তবে এসব বিনিয়োগে নিজেদের আড়াল করে রাখছেন অনেকেই। এজন্য তারা বাংলাদেশের পরিবর্তে আলবেনিয়া, সাইপ্রাসসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব ব্যবহার করেন বলে জানা গেছে।
অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ইউরোপ-আমেরিকায় বৈধভাবে বিনিয়োগ করলেও অনেক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। ফলে বিনিয়োগকারীরা ঝামেলা এড়াতে ওইসব দেশে এখন বিনিয়োগ করতে কিছুটা অনীহা দেখান। সেইদিক থেকে দুবাই বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। এখানে খুব বেশি ঝামেলা পোহাতে হয় না। তাই অনেকেই দুবাইকে বিনিয়োগের কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তবে বাংলদেশিদের বিনিয়োগ বা কোম্পানি দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি অবাক করছে বলে মনে করেন তিনি। অর্থাৎ দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তবে সবাই যে পাচার করছেন এমন না। অনেক বাংলাদেশি অন্য দেশ থেকে অর্থ এনেও বিনিয়োগ করতে পারেন। আবার যারা চাকরির উদ্দেশ্যে দুবাই গেছেন তারাও অর্থ জমিয়ে বিনিয়োগ করেছেন।
দুবাই চেম্বার জানিয়েছে, ২০২৩ সালের প্রথম ৬ মাসে ৩০ হাজার ১৪৬ নতুন প্রতিষ্ঠান যোগ দিয়েছে। তালিকার শীর্ষে আছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এরপর আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও পাকিস্তান। গত জুনের শেষ পর্যন্ত নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ২২.৩ শতাংশ ছিল ভারতীয়। গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ হাজার ৭১৭টি নতুন ভারতীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান দুবাই চেম্বারের সদস্যপদের জন্য চুক্তিসই করেছে। আগের বছরের একই সময়ের ৪ হাজার ৮৪৫ প্রতিষ্ঠানের তুলনায় এই সংখ্যা ৩৯ শতাংশ বেশি। পাকিস্তান থেকে ৩ হাজার ৩৯৫টি নতুন প্রতিষ্ঠান দুবাই চেম্বারে যোগ দিয়েছে। এর সংখ্যা ৫৯ শতাংশ বেড়েছে। দুবাই চেম্বারে নিবন্ধিত মোট পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৩১৫টি। এ ছাড়া মিশর, যুক্তরাজ্য ও চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো দুবাই চেম্বারের নতুন সদস্যদের তালিকায় শীর্ষে আছে। জর্ডান ও লেবাননের প্রতিষ্ঠানগুলোও শীর্ষ নতুন সদস্যের মধ্যে আছে উল্লেখ করে দুবাই চেম্বার জানায়, ৪২.৪ শতাংশ নতুন প্রতিষ্ঠান বাণিজ্য ও মেরামত খাতে নিযুক্ত আছে। ৩০.৮ শতাংশ আছে আবাসন, ভাড়া ও ব্যবসায়িক পরিষেবা খাতে। নির্মাণ শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো ৭.২ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে। পরিবহন, স্টোরেজ ও টেলিযোগাযোগ খাত আছে চতুর্থ অবস্থানে। বছরের প্রথমার্ধে চেম্বারে যোগ দেয়া নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এগুলোর অবদান ৬.৩ শতাংশ।
দুবাই চেম্বার অব কমার্সের ওয়েবসাইটে জানানো হয়, চেম্বারের সাড়ে তিন লাখের বেশি সদস্য কোম্পানি চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে ১৩ হাজার ৭০০ কোটি দিরহাম বা ৩ হাজার ৭২৯ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি ও পুনরায় রপ্তানি করেছে।
দুবাই চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ও সিইও মোহাম্মদ আলী রাশেদ লুতাহ গণমাধ্যমকে জানান, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে নতুন চেম্বার সদস্যদের সংখ্যা ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। তিনি বলেন, চেম্বারে যোগ দেয়া নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিন্ন ভিন্ন জাতীয়তা দুবাইয়ের ব্যবসায়িক পরিবেশের গতিশীলতার পাশাপাশি আমিরাতের বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষমতা প্রকাশ করে। দুবাই চেম্বার বলেছে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে নতুন সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় জাপানের প্রতিষ্ঠানও আছে। পূর্ব- এশিয়ার সমৃদ্ধ এই দেশটির প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৫৩ শতাংশ বেড়ে ৬০-এ পৌঁছেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, ১১ হাজার বাংলাদেশি মালিকানাধীন কোম্পানি দুবাই চেম্বারের সদস্য হওয়ার তথ্যই বলছে, দেশটিতে অর্থ পাচার বাড়ছে। পাচারকৃত অর্থ দিয়েই ইউএইতে বাংলাদেশিদের সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠছে। তবে শ্রমিক হিসেবে দেশটিতে গিয়ে বৈধভাবে আয় করে পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগ করেছে, এমন শ্রেণিও আছে। সরকার আগ্রহী হলে সহজেই ইউএই সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এই তালিকা সংগ্রহ করতে পারবে।
বিত্তবান বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে ২০১৯ সালে গোল্ডেন ভিসা চালু করে ইউএই। ২০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থসম্পদের মালিকানা থাকলেই এ ভিসার জন্য আবেদন করা যায়। বাড়ি কেনার লেনদেনের ৭০ শতাংশ করা যাচ্ছে নগদ অর্থে। এ সুযোগ দেয়ার পরই দুবাইয়ে বাংলাদেশিসহ অনেক দেশের নাগরিকদের সম্পদ কেনার পরিমাণ হু হু করে বাড়তে থাকে।
অর্থ পাচার রোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যতম সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুসন্ধান করা উচিত, কারা দুবাই চেম্বারের সদস্য হয়েছেন। বেআইনিভাবে অর্থ মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে নিয়ে গেলে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া দরকার। কারণ, তাদের কারণে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন