ট্রেনের জানালার পাশে দাঁড়ানো বা সিটে বসাকে কেন্দ্র করে ট্রেনের যাত্রী মঞ্জুর কাদেরের এলোপাতাড়ি লাথি, কিল, ঘুষিতে মারা গেছেন ট্রেনের আরেক যাত্রী ঝুমুর কান্তি বাউল। ৪৮ বছর বয়সী ঝুমুর কান্তি বাউলের এই অকালমৃত্যুতে শোকগ্রস্ত ছোট বোন স্নিগ্ধা বাউল ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার বাবা হারিয়েছেন তাঁর প্রথম সন্তান। মা হারিয়েছেন তুলায় মোড়ানো নাড়ি, আমার বউদি হারিয়েছেন তাঁর একমাত্র অবলম্বন আর পৌলমী ও মৈথিলী হারিয়ে ফেলেছে তাদের ভবিষ্যৎ। দেশ কী হারিয়েছে, তা আমি জানি না। আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার একটা বটগাছ।’
ঝুমুর কান্তি বাউল ঢাকায় একটি বায়িং হাউসে সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার হিসেবে কাজ করতেন। নরসিংদী থেকে ঢাকায় ট্রেনে যাতায়াত করতেন। প্রতিদিনের মতো ৬ জুন বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন ভোরে। চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী ঢাকা মেইল ট্রেনের পেছন থেকে দ্বিতীয় বগিতে উঠেছিলেন। ট্রেনে অনেক ভিড় ছিল। নরসিংদী স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার আগেই ট্রেনের যাত্রী চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মঞ্জুর কাদেরের সঙ্গে তাঁর কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে মঞ্জুর কাদের কিল, ঘুষি মারতে থাকেন। এতে ঝুমুর কান্তি বাউল অজ্ঞান হয়ে ট্রেনের মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। পরে ট্রেন থেকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।
স্নিগ্ধা বাউল প্রথম আলোকে বলছিলেন, ভাইয়ের এভাবে মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছেন না। যদি অসুখ, সড়ক দুর্ঘটনা বা স্ট্রোক করে মৃত্যু হতো, তাহলে এক কথা ছিল। কিন্তু একজন মানুষ শুধু তাঁর রাগ, ক্ষোভের কারণে কিল, ঘুষি মেরে এভাবে কাউকে মেরে ফেলবেন, তা তো কেউ বিশ্বাসই করতে পারছেন না। এক ঝুমুর কান্তি বাউলের মৃত্যুতে পুরো পরিবার অসহায় হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে তাঁর তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া মেয়ে পৌলমী বাউল এবং এক বছর দুই মাস বয়সী মৈথিলী বাউলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
স্নিগ্ধা বাউল বলেন, ‘ঘটনার সময় ট্রেনে আমার দাদা একা ছিলেন। ট্রেনে এলাকার পরিচিত একজন এবং অন্য যাত্রীরা যেটুকু বলেছেন, সেটাই আমরা শুনেছি। হয়তো জানালার পাশের সিট দাদার ছিল বা জানালার পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, তারপর কথা-কাটাকাটি ও কিল, ঘুষিতে দাদা ট্রেনে লুটিয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান। যাত্রীরাই হাসপাতালে নেন। তারপর মারা যান।’
২০১৮ সালে কলকাতায় ঝুমুর কান্তি বাউলের হৃদ্যন্ত্রে একটি অস্ত্রোপচার হয়েছিল বলে জানান স্নিগ্ধা বাউল। ‘কিন্তু মারা যাওয়ার আগে দাদা ভালো ছিলেন। চিকিৎসক ওষুধ কমিয়ে দিয়েছিলেন,’ বলেন তিনি।
স্ত্রী, দুই মেয়ে, বাবা প্রদ্যুৎ কুমার বাউল ও মা মিনতি বাউলকে নিয়ে নরসিংদীতে থাকতেন ঝুমুর কান্তি বাউল। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। এক ভাই বিয়ে করেছেন, একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করছেন। স্নিগ্ধা চাকরির জন্য ঢাকায় থাকেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করা স্নিগ্ধা বাউল এখন বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের উপপরিচালক। তাঁর লেখাপড়ার জন্য বড় ভাই ঝুমুর কান্তি বাউলের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে স্নিগ্ধা বলেন, ‘দাদা আমার পড়াশোনাসহ পরিবারের জন্য অনেক করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পড়াশোনার যাতে সমস্যা না হয়, তাই দাদা দেরিতে বিয়ে করেন। দাদার অপারেশনের জন্য আমি সাড়ে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। কিছু গয়না বিক্রি করেছিলাম। এই ঋণ শোধ হলো গত ফেব্রুয়ারি মাসে। আর এখন দাদাই চলে গেলেন!’
স্নিগ্ধা জানান, তাঁদের বাবা কেরানীগঞ্জে ঢাকা জুট মিলে চাকরি করতেন। ২০০০ সালের শুরুর দিকে একদিন গিয়ে দেখেন, মিলের ফটকে তালা ঝুলছে। জুট মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাবা কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। এরপর সংসারের বড় ছেলে হিসেবে দাদার (ঝুমুর কান্তি বাউল) জীবনটা পাল্টে যায়। কম্পিউটার শেখেন। নারায়ণগঞ্জে একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেন। পরে ঢাকায় বায়িং হাউসে কাজ পান। দাদা খেলাঘরের সদস্য ছিলেন। নাটক করতেন। কবিতা লিখতেন। ছবি আঁকতেন। আবৃত্তি করতেন। বেহালা বাজাতেন। তবে এত কিছু করেও জীবনে তেমন কিছু হতে পারেননি শুধু সংসারের চাপে।
তবে সংসারের জন্য করতে গিয়ে জীবনে তেমন কিছু হতে না পারার জন্য কোনো আক্ষেপ ছিল না ঝুমুর কান্তি বাউলের। স্নিগ্ধা বলেন, ‘কয়েক দিন আগেও দাদাকে বলেছিলাম, তুমি তো জীবনে কিছুই হতে পারলে না। অন্যরা কত কিছু করে ফেলছে। তখন দাদা উত্তর দিয়েছিলেন, অন্যরা অনেক কিছু করলেও ঘুমাতে পারেন না, আমি বাড়ি ফিরে শান্তিতে ঘুমাতে পারি।’
ঝুমুর কান্তি বাউল ছিলেন খুবই শান্ত প্রকৃতির। পরিবারের অন্যরা চিল্লাপাল্লা বা রাগারাগি করলে তিনি স্বাভাবিকভাবে কথা বলে সমস্যার সমাধান করতে বলতেন। সেই তিনিই আরেকজনের রাগের বলি হলেন, এই ভাবনাও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের।
ঝুমুর কান্তি বাউলের ছোট মেয়ে মৈথিলী শুধু বলতে পারে, বাবা নেই। রাত হলেই বাবা বাড়ি ফিরবে, সে আশায় বসে থাকে। বড় মেয়ে পৌলমী প্রথম দিন তেমন কিছু বুঝতে পারেনি। রাতে বাবা ঘুমাবে বলে বিছানায় বালিশ গুছিয়েছে। তারপর যখন তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলা হয়েছে যে বাবা মারা গেছেন, আর ফিরবেন না, তার পর থেকে সে গম্ভীর হয়ে গেছে। মারা যাওয়ার দিন বাবার গায়ে যে শার্ট ছিল, তার বোতাম ছিঁড়ে গেছে, বিভিন্ন জায়গায় দাগ লেগেছে। পৌলমী তা যত্ন করে ভাঁজ করে রেখেছে।
ঝুমুর কান্তি বাউলের স্ত্রী বন্যা বাউল জানান, ছোট মেয়েটা তো এখনো তেমন বুঝতে পারছে না যে তার বাবা নেই। তবে রাতে বাবার জন্য অপেক্ষা করে। আর বড় মেয়ে চুপ হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে চিৎকার করে কাঁদে। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুস্থ মানুষ বাসা থেকে বের হইল। কিছুক্ষণ পরই শুনি, মানুষটা মারা গেছে। এই মৃত্যু তো মানা যায় না।’
বন্যা বাউল নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তাঁর বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। স্বামীর মৃত্যুতে দিশাহারা বন্যা বাউল বলেন, ‘আমার দুই মেয়ের ভবিষ্যৎটাই নষ্ট হয়ে গেল! আমার মাথার ওপর থেকে ছাদটাই নাই হয়ে গেল। আমার বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি, আমার বৃদ্ধ মা–বাবা সবার ভরসার জায়গাটা হারিয়ে গেছে। এখন আমি কেমনে চলব, তা-ই তো বুঝতে পারতেছি না।’
স্নিগ্ধা বলেন, ‘শনিবার বাবা আর দাদা মিলে বাজার করতেন। দাদা মারা যাওয়ার পর বাবা শার্ট গায়ে দিয়ে বাজারে যাওয়ার জন্য চুপচাপ বসে ছিলেন। মা তো প্রায় পাগল হয়ে গেছেন। আর বউদি তো কিছু বুঝেই উঠতে পারছেন না।’
ঝুমুর কান্তি বাউলকে আঘাত করার পরই মঞ্জুর কাদেরকে আটকে রাখেন ট্রেনের যাত্রীরা। কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছানোর পর তাঁকে ঢাকা রেলওয়ে থানা–পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন তাঁরা। পরে তাঁকে ভৈরব রেলওয়ে থানায় নেওয়া হয়। এ ঘটনায় ভৈরব রেলওয়ে থানায় ঝুমুর কান্তি বাউলের ছোট ভাই রুমুর বাউল তাঁর ভাইকে কিল, ঘুষি মেরে হত্যার অভিযোগে মামলা করেছেন।
মামলাটি তদন্ত করছেন নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ। তিনি আজ মঙ্গলবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন এবং ঝুমুর কান্তি বাউলের ঠিকানা যাচাই হলে দ্রুত আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
ভাই হত্যার বিচার চেয়ে স্নিগ্ধা বাউল বলেন, ‘কতটা আঘাত করলে একটা মানুষ মরে যেতে পারে, তা তো সবাই বুঝতেই পারছেন। ট্রেনের ওই যাত্রীর সঙ্গে আমাদের জানাশোনা নেই। কোনো বাদবিবাদও নেই। অথচ কত বড় একটা বিপর্যয় ঘটে গেল আমাদের পরিবারে। ট্রেনের ওই লোক যা করেছেন, তাকে হত্যা বলা ছাড়া তো উপায় নেই। আমরা আমাদের ভাই হত্যার বিচার চাই।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন