বাংলাদেশে এক বছরের মাথায় আবারো বিদ্যুতের দাম বাড়ালো সরকার। এ দফায় গ্রাহক পর্যায়ে ইউনিটপ্রতি সর্বনিম্ন ২৮ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ এক টাকা ৩৫ পয়সা পর্যন্ত দাম বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে গড়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ।
গত মাস, অর্থাৎ পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন এই দাম কার্যকর করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সরকার।
বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত দু’টি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়।
এর আগে, গত মঙ্গলবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। এর দুই দিনের মাথায় বিদ্যুতের দাম বাড়িতে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন দফায় প্রতিমাসে গড়ে ৫ শতাংশ করে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল।
বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ সামলাতে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
‘এবার বিদ্যুতের ভর্তুকি গিয়ে দাঁড়াবে ৪৩ হাজার কোটি টাকায়। সে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দাম সমন্বয়ে যেতে হবে। জ্বালানির দামের সাথে সমন্বয় করতে হবে। আমরা ধীরে ধীরে কয়েক বছর ধরে মূল্য সমন্বয়ে যাবো’ বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে একথা বলেন হামিদ।
ডলার ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
‘আমাদের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ প্রায় ১২ টাকা। আর আমরা গড়ে প্রতি ইউনিট বিক্রি করছি সাত টাকায়। ফলে সমন্বয়টা উপরের দিকে বেশি করছি, নিচের দিকে কম করছি’, বলেন প্রতিমন্ত্রী হামিদ।
খুচরার পাশাপাশি এ দফায় পাইকারিতেও গড়ে পাঁচ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। এনিয়ে গত দেড় দশকে বিদ্যুতের দাম দশ বারেও বেশি বাড়ানো হলো।
আগে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করত এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে আইন সংশোধন করে বিইআরসির পাশাপাশি দাম বাড়ানোর ক্ষমতা হাতে নেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এর পর থেকে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়িয়ে আসছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
কোন খাতে কত বেড়েছে?
এ দফায় গ্রাহক পর্যায়ে ইউনিটপ্রতি গড়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৭০ পয়সা।
এর মধ্যে বাসাবাড়িতে সবচেয়ে কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী বা লাইফলাইন গ্রাহকদের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ২৮ পয়সা।
আগে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য তাদের খরচ করতে হতো চার টাকা ৩৫ পয়সা। এখন সেটি বেড়ে হয়েছে চার টাকা ৬৩ পয়সা। অর্থাৎ দাম সাড়ে ছয় শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
এই শ্রেণির গ্রাহকরা সাধারণত বাসায় একটি ফ্যান ও দু'টি বাতি চালান এবং মাসে সর্বোচ্চ ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন।
এর ফলে ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যহারকারী একজন লাইফলাইন গ্রহকের আগে যেখানে মাসে নিট বিল আসতো ২১৭ টাকা ৫০ পয়সা, এখন সেটি বেড়ে বিল আসবে ২৩১ টাকা ৫০ পয়সা।
অর্থ্যাৎ অন্তত ১৪ টাকা বেশি বিল দিতে হবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, বাংলাদেশে এ ধরনের গ্রাহক রয়েছে প্রায় এক কোটি ৬৫ লাখ।
গ্রাহকদের মধ্যে যাদের বাসায় একাধিক বাতি, ফ্যান, টিভি, ফ্রিজ এবং একটি এসি রয়েছে, তারা সাধারণত ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে থাকে।
তাদের জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ইউনিটপ্রতি ৫৭ পয়সা। ফলে এখন থেকে মাসে তাদের প্রায় এক শ’ টাকা বেশি বিল গুনতে হতে পারে।
আগে এই শ্রেণিতে বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দাম ছিল ছয় টাকা ৬৩ পয়সা। এখন সেটি বাড়িয়ে প্রতি ইউনিটের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে সাত টাকা ২০ পয়সা।
অন্যদিকে, আবাসিকে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৬০০ ইউনিটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গ্রাহকদের। মূলত : বিত্তবানরাই এই শ্রেণির গ্রাহক।
তাদের জন্য ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতে দাম সর্বোচ্চ এক টাকা ৩৫ পয়সা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
আগে যেখানে প্রতি ইউনিটের জন্য তাদের মূল্য দিতে হতো ১৩ টাকা ২৬ পয়সা, এখন সেটি বেড়ে হয়েছে ১৪ টাকা ৬১ পয়সা।
ফলে আগে ৬৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে যেখানে বিল আসতো ৮ হাজার ৬১৯ টাকা, এখন সেখানে বিল দিতে হবে ৯ হাজার ৪৯৬ টাকার মতো।
অর্থ্যাৎ গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তাদেরকে আট শ’ টাকার মতো বাড়তি বিল দিতে হবে।
এছাড়া গ্রাহকদের মধ্যে অনেকেরই বিদ্যুতের ব্যবহার ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিটের মধ্যে হয়ে থাকে।
তাদের ক্ষেত্রে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের মূল্য ছয় টাকা ৯৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে সাত টাকা ৫৯ পয়সা করা হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত দামে বিদ্যুৎ কিনে নেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এরপর তারা উৎপাদন খরচের চেয়ে কিছুটা কমে সরকার নির্ধারিত পাইকারি দামে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার কাছে বিক্রি করে। ঘাটতি মেটাতে পিডিবি সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নেয়।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবি লোকসান করেছে ৪৩ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা।
এ ক্ষতির দায় কাটাতে ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ করেছে সরকার।
তবে বিতরণ সংস্থাগুলো কোনো ভর্তুকির পায় না। তারা খুচরা দামে ভোক্তার কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে মুনাফা করে থাকে।
আরো যেসবে দাম বেড়েছে
নতুন দর অনুযায়ী সেচে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম চার টাকা ৮২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে পাঁচ টাকা ২৫ পয়সা করা হয়েছে।
নিম্নচাপে (২৩০-৪০০ ভোল্ট) বাণিজ্যিক ও অফিসে গড় দাম ১১ টাকা ৯৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৩ টাকা এক পয়সা করা হয়েছে।
মধ্যম চাপের (১১ কিলো ভোল্ট) ক্ষেত্রে এটি করা হয়েছে গড়ে ১১ টাকা ৬৩ পয়সা।
উচ্চ চাপে (৩৩ কিলো ভোল্ট) শিল্পের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট গড়ে নয় টাকা ৯০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ৭৫ পয়সা করা হয়েছে।
আর অতি উচ্চ চাপে (১৩২ ও ২৩০ কিলো ভোল্ট) নয় টাকা ৬৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ৬৬ পয়সা করা হয়েছে। ভারী শিল্পকারখানাগুলোই মূলত এই শ্রেণির গ্রাহক।
এছাড়া শিক্ষা, ধর্মীয়, হাসপাতাল ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ছয় টাকা ৯৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে সাত টাকা ৫৫ পয়সা করা হয়েছে।
দাম বাড়লো কেন?
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত মঙ্গলবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেন।
তখন এর কারণ ব্যখ্যা করে তিনি বলেন, প্রতিবছর শুধু বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে ৪৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয় এবং জ্বালানির ক্ষেত্রে দিতে হয় ছয় হাজার কোটি টাকা।
‘আগামী কয়েক বছর ধরে আমরা এই দামটা সমন্বয় করবো… বিদ্যুতের ক্ষেত্রে উৎপাদনে অতিরিক্ত খরচ দিতে হচ্ছে, সেখানে সমন্বয় করতে হবে,’ বলেন তিনি।
‘আগামী বছর আমাদের নিউক্লিয়ার চলে আসবে। ভারত থেকে কম দামে বিদ্যুৎ আসছে। দুই বছরের মাঝে দুই হাজার মেগাওয়াট সোলার এটার সাথে যোগ হবে।’
‘কিন্তু তারপরও যে- ভর্তুকিটা রয়ে যাবে, তা ডলারের দামের পার্থক্যের কারণে। সেই কারণেই এই দামটা আমাদের সমন্বয় করা দরকার।’
ডলারের দাম প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্য, ‘আমরা যখন কয়লার পাওয়ার প্লান্টগুলো নিয়ে আসছি, সেই সময়ে ডলারের যে ভ্যালু এবং কয়লার যে দাম ছিল, তা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রতি ডলারে প্রায় ৪০ টাকা পার্থক্য হয়ে গেছে।’
সূত্র : বিবিসি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন