গ্যাস সংকটের কারণে সক্ষমতা থাকার পরও প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে। ডলার সংকটে তেল আমদানি স্বাভাবিক করতে পারছে না বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। সরকারের কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের বকেয়া পাওনার পরিমাণ ২৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ফলে তারাও বিদ্যুৎ উৎপাদন সচল রাখতে আগ্রহ হারাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে আরও সংকটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা।
গত কয়েক দিন ধরে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় লোডশেডিংয়ের তীব্রতা বেড়েছে। আগামী কয়েক সপ্তাহে তা আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেছেন, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ঠিক রাখা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। জ¦ালানি আমদানি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সামনের দিনগুলোতে লোডশেডিংয়ের তীব্রতা বাড়বে।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, গতকাল রাজধানী ও আশপাশের জেলাগুলোতে লোডশেডিংয়ের তীব্রতা বেড়েছে। মোহাম্মদপুর শেখেরটেক এলাকার স্কুলশিক্ষিকা সাবিহা মুমতাজ আমাদের সময়কে বলেন, ‘গভীর রাতেও বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। বাচ্চাদের নিয়ে কষ্টে আছি। একদিকে মশা, অন্যদিকে লোডশেডিং- সব মিলিয়ে একটি সংকটে আছি।’ নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা মো. হারুনুর রশিদ জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে লোডশেডিং বেড়েছে। মঙ্গলবারও দফায় দফায় বিদ্যুৎ গেছে জানিয়ে এই বেসরকারি চাকুরে বলেন, সামনে বাচ্চাদের পরীক্ষা শুরু হবে। বিদ্যুৎ যদি খুব বেশি যাওয়া-আসা করে তবে সংকট বাড়বে।
রাজধানী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের একটি অংশে বিদ্যুৎ সবরাহকারী কোম্পানি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন (ডিপিডিসি)। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান আমাদের সময়কে জানান, তারা চাহিদার চেয়ে প্রায় ৩শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম সরবরাহ করছে পিডিবি। ফলে লোডম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণ করতে হচ্ছে। সরবরাহ আরও কমলে লোডশেডিং বাড়বে বলেও জানান তিনি।
প্রায় একই কথা জানান ঢাকা ইলেকট্রিক পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী কাওসার আমীর আলী। তিনি বলেন, গতকাল (মঙ্গলবার) বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১২শ মেগাওয়াটের মতো। পিডিবি সরবরাহ করেছে এক হাজার মেগাওয়াট। ফলে লোডশেডিং করে সরবরাহ সামাল দিতে হয়েছে।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন বিদ্যুৎ কোম্পানির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করেও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। টেলিফোনে পিডিবি চেয়ারম্যানকে না পাওয়া নিয়ে খোদ সংসদীয় কমিটির সভাতে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে গতকালও তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে সাড়া পাওয়া যায়নি।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন আমাদের সময়কে বলেন, সামগ্রিকভাবে কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে। তবে এখন বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমে আসছে। তিনি বলেন, ‘আপাতত এলএনজি আমদানি স্বাভাবিক আছে। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। ফলে লোডশেডিং কিছুটা বাড়লেও বড় কোনো সংকট হবে বলে মনে করছি না।’
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বিদ্যুৎ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমাদের সময়কে বলেন, বর্তমানে পিডিবির দায়িত্বশীলদের খামখেয়ালি ও অদক্ষতায় দিন দিন সংকট বাড়ছে। তিনি বলেন, পায়রার মতো বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়া পিডিবির কর্মকর্তাদের অব্যবস্থাপনার খেসারত। আগে থেকে তৎপর হয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের জানালে এমনটা হতো না। ওই কর্মকর্তা বলেন, নিজেরা ঋণগ্রস্ত হয়ে সংস্থাটিকে ডুবিয়েছে। এখন বিতরণ কোম্পানির কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে লাভে থাকা বিতরণ কোম্পানিগুলোকেও ডুবানোর চেষ্টা চলছে।
এদিকে গত সোমবার এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, সরকার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের স্বাভাবিক সরবরাহ অব্যাহত রাখতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বৈশি^ক সংকটের কারণে নানা ধরনের অভ্যন্তরীণ সংকট তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, এ বছর রমজান ও গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াট নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী উৎপাদন পরিকল্পনা করা হয়। তবে চাহিদা বেড়েছে ধারণার চেয়ে বেশি। আর এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৬০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পেরেছে সরকার।
পিডিবির ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, গতকাল বিদ্যুতের আনুমানিক চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৯৩৭ মেগাওয়াট। তেমন কোনো লোডশেডিং ছিল না। ওয়েবসাইটে গতানুগতিক তথ্য দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে পিডিবির বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পিডিবি কর্মকর্তা বলেছেন, পিডিবি যতটুকু উৎপাদন করতে পারবে ততটুকুই চাহিদা দেখায়। প্রকৃত চাহিদা কখনো ওয়েবসাইটে দেয় না।
উল্লেখ্য, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সর্বোচ্চ উৎপাদন সম্ভব ১৫ হাজার ৬০৪ মেগাওয়াট। জ¦ালানি সংকট এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কারণে প্রায় সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। গ্যাসের সরবরাহ বাড়লেও তা চাহিদার তুলনায় কম। ফলে বর্ধিত চাহিদায় লোডশেডিংয়ের কোনো বিকল্প আপাতত নেই সরকারের কাছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন