নঈম নিজাম
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্কের বন্ধনে জড়িয়ে রয়েছে ইন্দিরা গান্ধীর নাম। রাষ্ট্রক্ষমতায় লৌহমানবী বলা হতো তাঁকে। চলাফেরায় ছিল নিজস্ব স্টাইল। দুই ফিতার চপ্পল পরতেন। চুলের একটা পাশ ছিল সাদা-পাকা। বাকিটা কালো। শাড়ি পরারও আলাদা ধাঁচ ছিল। পড়াশোনার জন্য কিছু সময় কাটিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। চলনে শান্তিনিকেতনী ভাব ছিল। কালো সানগ্লাস পরতেন। অনেক কঠোরতা, সুখ-দুঃখ, অশ্রু ঢেকে যেত কালো চশমার আড়ালে। কেউ বুঝতে পারত না প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধীকে। আসলেই তিনি ব্যতিক্রম ছিলেন। ভীষণ দাপুটে মানুষটি যেদিকে হেঁটে যেতেন তছনছ হয়ে যেত সবকিছু। দাদা মতিলাল নেহেরুর হাত ধরে রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন। ছোটবেলায় দাদার কাছে ছিল যত আবদার। বাবার বকা শুনে আশ্রয় নিতেন দাদার। শেয়ার করতেন সব সুখ-দুঃখ। মতিলাল নেহেরু ছিলেন ইন্দিরার ছোটবেলার নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
তখন ব্রিটিশ শাসনকাল এ উপমহাদেশে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ভারতজুড়ে। নেহেরু পরিবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বলিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল। ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর জন্ম ইন্দিরার। বাবার নাম জওহরলাল নেহেরু। মা কমলা দেবী। ছোটবেলায় ইন্দিরা দেখতেন তাঁদের বাড়িতে কংগ্রেসের বৈঠক বসছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পরিকল্পনা হচ্ছে। রাজনৈতিক কর্মীতে মুখরিত থাকা বাড়িতে যখন তখন পুলিশ আসত, দাদা ও বাবাকে কারাগারে যেতে হতো। ইন্দিরা সবকিছু দেখে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। বুঝতে পারেন ক্ষমতা ও কারাগার পাশাপাশি হাঁটে। ইন্দিরাকে রাজনীতিতে আসার উৎসাহটা বাবার চেয়ে দাদাই বেশি দেন। প্রিয় নাতনিকে জানাতেন রাজনীতির অন্দরমহল। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ইন্দিরা আভিজাত্যের পাশাপাশি কাঠিন্য দেখে বড় হন। বাবা-মায়ের কারাবরণ তাঁকে কষ্ট দিত। কাঠিন্যের সেই দিনগুলোয় কারাগার থেকে এক দিন জওহরলাল নেহেরু কন্যা ইন্দিরার কাছে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘যখন সন্দিগ্ধ-চিত্ত হও তখন গোপনীয় কিছু কোনোক্রমেই কোরো না, যা কারও উদ্দেশে কলঙ্ক আনতে এবং আমাদের জাতিকে অপমান করতে পারে। সাহসী হও এবং উল্লেখযোগ্য সবকিছু করে আসবে। ভীতি একটা খারাপ বিষয়, গোপনভাবে কিংবা চুপিসারে কোনো কিছুই কোরো না। আমার আদুরে সোনামণি, তা হলে তুমি জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত, অকুতোভয়, স্বচ্ছ ও শান্ত এবং অবিচল কন্যারূপে গড়ে উঠবে।’
বাবার সেই চিঠি প্রভাবিত করেছিল ইন্দিরাকে। চিঠিটি প্রকাশিত হয়েছিল জওহরলালের লেখা ‘এক নজরে দেখা বিশ্ব ইতিহাস’ বইতে। ইন্দিরা বাবার চিঠি সামনে রেখেই পথচলা শুরু করেন। সাহসী একজন হিসেবে বেড়ে ওঠেন। ১৯৩০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দাদা মতিলাল নেহেরুর মৃত্যু ইন্দিরার জীবনে প্রভাব ফেলে। এ মৃত্যুর পাঁচ দশক পরে ইন্দিরা লিখেছিলেন, ‘তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আনন্দভবন নিঃশব্দ হয়ে পড়ে। তাঁর প্রতিধ্বনিময় কণ্ঠস্বর কক্ষগুলোতে অথবা বারান্দার এক দিক থেকে অন্যদিকে আর অনুরণিত হয় না।’ ব্যক্তিগত জীবনে ইন্দিরা বিয়ে করেন ফিরোজ গান্ধীকে। ১৯৪২ সালের মার্চে বিয়ের জন্য উপযুক্ত সময় ছিল না। একদিকে বিশ্বযুদ্ধ, অন্যদিকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। মানুষের কাছ থেকে সমালোচনার ভয় ছিল। এ কঠিন পরিবেশে ইন্দিরার বিয়ের অনুমতি আসে মহাত্মা গান্ধীর কাছ থেকে। এ নিয়ে ইন্দিরা লিখেছেন, ‘সমগ্র জাতি ছিল আমার বিয়ের বিরুদ্ধে। বিয়েকে আক্রমণ করে অশ্রাব্য, অকথ্য বিদ্রুপাত্মক চিঠিপত্র আসছিল।’ ১৯৪২ সালের ১৬ মার্চ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় আনন্দভবনের সামনের খোলা চত্বরে। বিয়েতে ইন্দিরা গোলাপি রঙের সুতি শাড়ি পরেন। এ শাড়ির সুতোগুলো তাঁর বাবা জওহরলাল নেহেরু কারাগারে থাকার সময় বুনেছিলেন। ইন্দিরার গলায় ছিল ফুলের মালা, হাতে কাচের চুড়ি। কোনো গহনা ছিল না। সাদামাটাভাবে তিনি বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। দেখে মনে হচ্ছিল ভারতের কোনো সাধারণ পরিবারের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে।
ইন্দিরার রাজনীতির আনুষ্ঠানিক যাত্রা বিয়ের বছরই শুরু হয়েছিল। এলাহাবাদের একটি জনসভায় ভাষণ দেন তিনি। এর পরই তাঁকে আটক করা হয়। কারাগারে রাজনীতির হাতেখড়ি পূর্ণতা পায়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়। নানা ঘাতপ্রতিঘাতে ইন্দিরা ধীরে ধীরে রাজনীতিতে নিজের অবস্থান বাড়ান। তিনি স্বাধীন ভারতে তারুণ্যকে নিয়ে কাজ শুরু করেন। একটা নতুন চিন্তাভাবনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। ১৯৫৭ সালের নির্বাচনের আগে ভারতীয় কংগ্রেসের সদস্য হন। সবাই ভেবেছিলেন ইন্দিরা ভোট করবেন। তিনি ভোট করেননি। বাবার নির্বাচনি এলাকায় গিয়ে কাজ করেন। ১৯৫৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ইন্দিরা ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। তখন তাঁর বয়স ৪০ বছর। সবাই ভেবেছিলেন দলের দায়িত্ব নিয়ে কী করবেন ইন্দিরা? কীভাবে সামাল দেবেন সবকিছু। সবার মুখে ছাই দিয়ে দায়িত্ব নিয়েই দল সংগঠিত করতে থাকেন নিজের মতো করে। ক্লান্তিহীনভাবে ঘুরতে থাকেন ভারতের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। বাবা জওহরলাল নেহেরু তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। দালাইলামাকে ঘিরে চীন তখন ভারতের আসাম সীমান্তে সেনা জড়ো করে। তেজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পালিয়ে যান। সরকারি কর্মকর্তারা লাপাত্তা হয়ে যান। সাধারণ নাগরিক ছিল আতঙ্কগ্রস্ত। এমন পরিবেশে ইন্দিরা সীমান্তে আসেন। সাধারণ মানুষকে সাহস জোগান। এ নিয়ে সমালোচনা ছিল। ইন্দিরা গুরুত্ব দেননি। তিনি নিজের অবস্থানে বহাল থাকেন। এ সময় নেহেরুকে সমালোচনা সইতে হয়েছিল ইন্দিরার বিভিন্ন কাজের। ১৯৬৪ সালের ২৭ মে নেহেরু পরলোকগমন করেন। নেহেরুর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারের প্রশ্ন আসে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারিলালকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী করা হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উঠে আসে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও কামরাজের নাম। শেষ পর্যন্ত শপথ নেন শাস্ত্রী। তিনি তাঁর মন্ত্রিসভায় ইন্দিরাকে নিয়ে আসেন। সে সময় ইন্দিরাকে তাঁর আপনজনেরা প্রশ্ন করেছিলেন কেন প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে আগ্রহ দেখাননি? জবাবে তিনি বলেছিলেন, তাঁরা (প্রবীণ নেতারা) আমাকে শেষ করে দিতেন অল্প দিনের ভিতরে।
১৯৬৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন ১৯৬৬ সালে। তথ্যমন্ত্রী থাকাকালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তিনি পশ্চিম সীমান্তে গিয়ে সেনাদের উৎসাহ জোগান। কোনো বেসামরিক রাজনীতিবিদের এভাবে যুদ্ধের ময়দানে ছুটে যাওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। সরকারপ্রধান হিসেবে ইন্দিরা দীর্ঘ সময়ের জন্য সুযোগ পান। ১৯৭৭ সালের মার্চ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। মাঝে নানামুখী ষড়যন্ত্রে ক্ষমতা হারান। মাত্র তিন বছরের ভিতরে ঘুরে দাঁড়ান। ১৯৮০ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর ইন্দিরা নিহত হন দিল্লির বাসভবনে শিখ বিদ্রোহী সেনার হাতে। স্বর্ণ মন্দিরে সেনা অপারেশনের বদলা নিতেই নিজের দেহরক্ষীরা ইন্দিরাকে হত্যা করে। ইন্দিরার দুই পুত্র রাজীব ও সঞ্জয় গান্ধী। ইন্দিরা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে সঞ্জয় গান্ধী দিল্লিতে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। এ মৃত্যু এখনো অনেক রহস্যের জালে আটকা। দীর্ঘমেয়াদের ক্ষমতার রাজনীতিতে ইন্দিরা নিজেকে অমর করে রেখেছেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ রাজনীতিক ও সমরবিদ। ছিলেন যোদ্ধা। চলার পথে বারবার হোঁচট খেয়েছেন। ষড়যন্ত্রের কবলে পড়েছেন। অকারণে নিন্দাবাক্য শুনেছেন। তার পরও নিজেকে থামাননি। কোনো ক্লান্তি তাঁকে থামাতে পারেনি। অপ্রতিরোধ্য গতিতে সারা জীবন লড়েছেন। ক্ষমতা হারিয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁর ওপর ইট ছুড়ে মারা হয়েছিল। ক্ষমতা হারানোর পর আদালতে তাঁকে অপদস্থ করা হয়। বসতে দেওয়া হয়নি। তার পরও থামেননি। ঘুরে দাঁড়িয়েছেন দ্রুততম সময়ে।
বাংলাদেশের এই বন্ধু ১৯৭১ সালে দুই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আমাদের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন। নয়টি মাস পাশে ছিলেন কঠিনভাবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সব ধরনের সহায়তা, শরণার্থীদের আশ্রয়দানের পাশাপাশি বাংলাদেশের পক্ষে গড়েছিলেন আন্তর্জাতিক জনমত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে ভারতীয় সেনা ফিরিয়ে নিয়েছিলেন দ্রুততম সময়ে। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতীয় সেনারা ফিরে যাওয়া শুরু করে। দুনিয়াতে যুদ্ধের পর মিত্রবাহিনীর সেনাদের এত দ্রুত সময়ে ফিরে যাওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। এখনো মার্কিন সেনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গড়ে তোলা সেনাছাউনিতে বহাল রয়েছে। ইন্দিরা সবকিছুতে আলাদা ছিলেন। তিনি অল্প সময়ে সেনা ফিরিয়ে নিয়ে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
ইন্দিরার মৃত্যু ছিল বেদনাদায়ক। ১৯৮৪ সালের ৩০ অক্টোবর ভুবনেশ্বরে জীবনের শেষ ভাষণ দেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আজ এখানে রয়েছি। কাল না-ও থাকতে পারি। এটা নিয়ে ভাবি না যে আমি থাকলাম কি না। অনেক দিন বেঁচেছি। আমার গর্ব আছে আমি পুরো জীবনটাই দেশের মানুষের সেবায় লাগাতে পেরেছি বলে। আর শেষনিঃশ্বাস নেওয়া পর্যন্ত মানুষের সেবাই করে যাব। যেদিন চলে যাব চিরতরে আমার প্রতিটি ফোঁটা রক্ত ভারতকে আরও মজবুত করার কাজে লাগবে।’ ইন্দিরার এ বক্তব্য সেদিন তাঁর অনেক কাছের বন্ধুর ভালো লাগেনি। অনেকে ভেবেছিলেন এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু কেউই সে সুযোগ পাননি। ভুবনেশ্বর থেকে দিল্লি ফিরে সে-রাতে ইন্দিরা ঘুমাননি। তিনি ছিলেন ভীষণ ক্লান্ত। ভোর ৪টায় শরীর খারাপ লাগছিল পাশের ঘরে থাকা সোনিয়া গান্ধীর। তিনি বাথরুমে যান ওষুধটা খুঁজতে। ওষুধ পাচ্ছিলেন না। সোনিয়ার উঠে যাওয়ার শব্দ পান ইন্দিরা। তিনি উঠে এসে ওষুধটা খুঁজে বের করতে সোনিয়াকে সহায়তা করেন।
সকাল সাড়ে ৭টায় তৈরি হয়ে নেন ইন্দিরা। গেরুয়া রঙের শাড়ি পরেন। তাঁর ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করছিলেন পিটার উস্তিনভ। আগের দিন ভুবনেশ্বরেও শুটিং হয়েছিল। দিনের কর্মসূচিতে দুপুরে সাক্ষাতের কথা ছিল ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যালাহানের। তারপর আসার কথা মিজোরাম কংগ্রেসের একজন নেতার। ইন্দিরা সময় মানতেন। দিল্লি সফরে তখন এসেছিলেন ব্রিটিশ রাজকুমারী প্রিন্সেস অ্যান। তাঁর সম্মানে আয়োজন ছিল ডিনারের। সকালের ব্রেকফাস্ট সারলেন ইন্দিরা। প্রতিদিনের মতো সাদামাটা খাওয়া। তারপর এলেন ব্যক্তিগত চিকিৎসক। তাঁর সঙ্গে কথা বললেন। বয়স বাড়া নিয়ে মজাও করলেন। ইন্দিরা এমনই ছিলেন। সবার সঙ্গে কথা বলতেন। ঘড়িতে সকাল ৯টা বেজে ১০ মিনিট। আকবর রোডে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির দুটি ভবনে যাতায়াত করা যেত। দিনটা ছিল রোদঝলমলে। ইন্দিরা বের হলেন। নীল আকাশের দিকে তাকালেন। একটি ভবন থেকে আরেকটিতে যাবেন। তাঁর পাশে ছাতা হাতে সেপাই নারায়ণ সিং। একটু পেছনে ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ান ও পরিচারক নাথুরাম। তাদের পেছনে সাব ইন্সপেক্টর রামেশ্বর দয়াল। প্রধানমন্ত্রী কথা বলছিলেন ধাওয়ানের সঙ্গে। ইয়েমেন সফররত রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিংয়ের সন্ধ্যায় ফিরে আসা ও বিমানবন্দরে যাওয়া নিয়েই তাঁরা কথা বলেন। হঠাৎ পাশে দাঁড়ানো নিরাপত্তাকর্মী বিয়ন্ত সিং রিভলবার বের করে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরপর তিন রাউন্ড গুলি চালায়। ইন্দিরার বুকে ও কোমরে গুলি লাগে। হতভম্ব হয়ে গেলেন ব্যক্তিগত সচিব। সাহায্যের আশায় মুখ তুললেন। দেখলেন টমসন অটোমেটিক কার্বাইন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন নিরাপত্তারক্ষী সতবন্ত সিং। ইন্দিরা ঢলে পড়ার সময় তাঁর দিকে তাকালেন। বিয়ন্ত সিং চিৎকার করে এবার সতবন্ত সিংকে বলল গুলি করতে। সতবন্তের কার্বাইন গর্জে ওঠে। ইন্দিরার শরীরে ২৫টি গুলি একসঙ্গে বিদ্ধ হয়। প্রধানমন্ত্রীর গাড়ির বহরে থাকা অ্যাম্বুলেন্সের চালক সেদিন ডিউটিতে আসেনি। ব্যক্তিগত সচিব ধাওয়ান ও অন্যরা মাটিতে পড়ে থাকা ইন্দিরার রক্তাক্ত দেহ অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে তুললেন। নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। সোনিয়া গান্ধী গুলির শব্দ শুনে দৌড়ে আসেন। গাড়িতে ওঠেন দ্রুত। রক্তাক্ত ইন্দিরার মাথাটা সোনিয়া তুলে নেন নিজের কোলে। কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। গাড়ি হাসপাতালের দিকে ছুটতে থাকে।
গোয়েন্দা সংস্থা আগেই আশঙ্কা করেছিল ইন্দিরা গান্ধীর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের রিপোর্ট ছিল ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করা হতে পারে। তারা ইন্দিরার নিরাপত্তা টিম থেকে সব শিখ রক্ষীকে প্রত্যাহারের একটি ফাইল নিয়ে গিয়েছিল। ইন্দিরা সে ফাইলে স্বাক্ষর করেননি। তিনি তখন বিভিন্ন গোয়েন্দা এজেন্সির প্রধানকে বলেছিলেন, আমরা না ধর্মনিরপেক্ষ দেশ? একটা গোষ্ঠীর নিরাপত্তারক্ষীদের কোন যুক্তিতে সরাবি? ইন্দিরার উদারতা আর বিশালত্বই তাঁর জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। স্বর্ণ মন্দিরে অপারেশন ব্লু স্টারের বদলা নিল তাঁর ব্যক্তিগত শিখ নিরাপত্তারক্ষীরা। নিজের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্তদের ওপর তাঁর আস্থা-বিশ্বাস ছিল। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে সে বিশ্বাস রক্ষীরা রাখল না। তারা ইন্দিরাকে হত্যা করল।
ইন্দিরা হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হারাল এক পরম বন্ধুকে। যিনি শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, ১৯৭৫ সালের নিষ্ঠুর ১৫ আগস্টের পর দাঁড়িয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ের পাশে। তিনি তাঁদের ভারতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ড. ওয়াজেদ মিয়াকে চাকরি দিয়েছিলেন। অশ্রুসজল শেখ হাসিনার কাঁধে ভরসার হাত রেখে বলেছিলেন, তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে তোমার সন্তানদের জন্য এবং বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে। ইন্দিরা এমনই ছিলেন। যখন দরকার কাঠিন্যের, তিনি তা-ই হতেন। আবার খারাপ সময়ে মায়াবী স্পর্শ দিয়ে পাশে দাঁড়াতেন বন্ধু ও স্বজনদের।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন