মো. শফিকুল ইসলাম
প্রতিদিন খবরের কাগজ দেখলে চোখে পড়ে ধর্ষণের খবর, যা খুবই দুঃখজনক। সম্প্রতি কুমিল্লার দেবিদ্বারে ধর্ষণের শিকার চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে। যার জন্য তার এক শিক্ষকই দায়ী। যদিও ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কাছাকাছি সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণকাণ্ড গোটা জাতিকেই নাড়া দিয়েছে। অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যৌন হয়রানিসহ নানা অপকর্মে দৃশ্যমান ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ। এ ছাড়া এসব অপরাধের বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও অপরাধীদের প্রশ্রয়ের কারণে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোনো ক্ষেত্রে ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।
তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এহেন অন্তত একটি অপরাধের বিচার হয়েছে সম্প্রতি, যা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, গত ৩১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতারকে চিঠি দিয়ে এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ দেন এক ছাত্রী। ওই ছাত্রী অভিযুক্ত অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে স্নাতকোত্তরের থিসিস করছেন। থিসিস শুরু হওয়ার পর থেকেই অধ্যাপক তাঁকে বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন করে আসছেন। এ ঘটনায় ১ ফেব্রুয়ারি ওই অধ্যাপককে সাময়িক অপসারণ করেছে কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন কেন্দ্রের অভিযোগ কমিটিও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে। পরে গত মঙ্গলবার এ কমিটি যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্রে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে ঘটনার সত্যতা পায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে রসায়ন বিভাগের সেই অধ্যাপককে স্থায়ীভাবে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ১ হাজার ২২ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬২ জন নারী এবং ৬৬০ জন কন্যাশিশু। এর পাশাপাশি ৫৩ জন নারী এবং ১৩৬ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয় ১৩ জন নারী ও ৩৪ কন্যাশিশু।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২২ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪ হাজার ৩৬০ জন নারী। এর মধ্যে ৪৫০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। একই সময়ে সারাদেশে সহিংসতার শিকার হয় ৯ হাজার ৭৬৪ জন নারী, যা খুবই ভয়াবহ। প্রশ্ন হলো– কেন ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা বারবার ঘটে। সঠিক বিচার হলে এসব বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা।
সোশ্যাল মিডিয়াসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে যেভাবে ধর্ষণ নামে নৃশংস, ঘৃণ্য, বর্বরোচিত ঘটনা দেখতে পাই, যা করোনাভাইরাস বা ডেঙ্গুর চেয়ে ভয়াবহ। ধর্ষণের ঘটনা এত বেড়ে চলেছে, যা আমাদের বাকরুদ্ধ করে দেয়। সমাজে সবাই সুখ-শান্তি এবং নিরাপদে থাকতে চায়। কিন্তু কিছু মানুষরূপী অমানুষের কারণে সেই শান্তি এখন বিনষ্ট হচ্ছে। এখান থেকে উত্তরণ না ঘটলে ভবিষ্যৎ আরও নষ্টের দিকে যেতে পারে।
ধর্ষণ সমাজে একটি মারাত্মক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বা সামাজিক অবক্ষয় এ জন্য অনেকাংশে দায়ী। এই মারাত্মক ব্যাধি থেকে রক্ষায় আমাদের সবাইকে সচেতন এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের ছেলেমেয়ে, ভাইবোন, স্ত্রীকে আরও সচেতন করতে হবে। ধর্ষণ রোধে পরিবারেরও দায়িত্ব রয়েছে। ছেলেমেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কার সঙ্গে চলাফেরা করছে, এসব বিষয়ে খোঁজ রাখতে হবে। অন্যথায় এদের সঠিক পথে পরিচালনা করা সম্ভব হবে না।
ধর্ষণ বন্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকর করতে হবে, যাতে কেউ রাজনৈতিক বা অর্থের জোরে ধর্ষণের বিচার থেকে রেহাই না পায়। ধর্ষণের মতো অপরাধ দমনে ব্যর্থ হলে নারীরা সমাজে নিরাপদ বোধ করবে না। নারী প্রগতি থমকে যাবে; রাষ্ট্র ও সমাজ কারও জন্যই তা ভালো কিছু নয়।
দেশে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের পেছনে কারণগুলো হচ্ছে–নিরবচ্ছিন্ন যৌন ইচ্ছা, যৌন হতাশা, পুরুষতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ, নারীকে দুর্বল মনে করা, শক্তির প্রকাশ, ক্ষমতার রাজনৈতিক দাপট, প্রতিশোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ; সামাজিক রীতিনীতি, বন্ধন, মূল্যবোধের অভাব ইত্যাদি। এ ছাড়া ধর্ষণের পেছনে আরও কারণ রয়েছে। যেমন– ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার না করা, যৌন শিক্ষা এবং ন্যায়বিচারের অভাব। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক অবক্ষয় ছাড়াও এ জাতীয় অপরাধ ক্রমশ বাড়ছে। কারণ সমাজের কোনো অংশই তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না বলে মনে করি।
এসব বন্ধে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রজনন শিক্ষা ও নীতিশাস্ত্রের অধ্যয়নকে অন্তর্ভুক্ত; সামাজিক তদারকি ব্যবস্থা শক্তিশালী এবং আইন প্রয়োগ আরও কার্যকর করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্যদের ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতন বন্ধে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং নারীদের প্রতি পুরুষের অসম্মানজনক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি নির্মূল করতে হবে। ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণে শিক্ষা, জেন্ডার সংবেদনশীলতা এবং আইনি সচেতনতা অপরিহার্য। এ ছাড়া দরকার সুশাসন। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে জনসমক্ষে এসব পুরুষের বিচার করতে হবে।
ড. মো. শফিকুল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন