সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ রোকন
জাতিসংঘ শুভেচ্ছাদূত ও ‘ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট’ ধারণার প্রবক্তা বিবি রাসেল টেকসই তন্তু নিয়ে কাজ করছেন কয়েক দশক ধরে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্প পুনরুদ্ধারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। বিবি রাসেল ১৯৭২ সালে প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে লন্ডন কলেজ অব ফ্যাশনে পড়তে যান। স্নাতক প্রদর্শনীর আগেই ইউরোপে মডেল হিসেবে সাড়া ফেলেন। ১৯৯৪ সালে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে তাঁত, বস্ত্র, হস্তশিল্প সংরক্ষণ ও উন্নয়নে ‘বিবি প্রডাক্টস’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ২০০৪ সালে ইউনেস্কো পিস প্রাইজ, ২০১০ সালে স্পেনের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘ক্রস অব অফিসার অব দ্য অর্ডার অব কুইন ইসাবেলা’, ২০১১ সালে জার্মানির ‘ভিশন অ্যাওয়ার্ড’ এবং ২০১৫ সালে ‘রোকেয়া পদক’ লাভ করেন
সমকাল: আমরা জানি, আপনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্প পুনরুদ্ধারে কাজ করেন। সেই সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের ফুলিয়াতেও কাজ করেছেন। সেই ফুলিয়া তো গত দু’দিন ধরে খবরের শিরোনাম!
বিবি রাসেল: আমি তো গত দু’দিন ধরে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারছি না। আমি ফুলিয়া, নদীয়াতে হস্তচালিত তাঁতসামগ্রী নিয়ে কাজ করছি অনেক দিন ধরে। তারা নিজেরাও এটাকে টাঙ্গাইল শাড়ি বলে। এখান থেকে আমদানি করে। কিন্তু আমাদের দেশের টাঙ্গাইল শাড়ি যে তাদের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পাবে– এটা তো কল্পনারও বাইরে।
সমকাল: টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই রাইটস বা ভৌগোলিক নির্দেশক অধিকার পাওয়ার জন্য ভারতীয়রা যে আবেদন করেছে– এটা কখনও বুঝতে পেরেছিলেন?
বিবি রাসেল: না, না। এটা তো কারও দুঃস্বপ্নেও আসার কথা নয়। কারণ টাঙ্গাইল তো একেবারে সীমান্ত থেকে দূরে। অনেক অঞ্চল দুই বাংলার মধ্যে বিভক্ত হয়েছে; যেমন নদীয়া অঞ্চল, দিনাজপুর অঞ্চল, রংপুর অঞ্চল। সেখানকার কোনো কোনো পণ্য নিয়ে দু’পক্ষের দাবি থাকতে পারে। কিন্তু টাঙ্গাইলের ক্ষেত্রে তো এমন প্রশ্নই আসে না। সেখানে যারা তাঁত নিয়ে, বস্ত্রশিল্প নিয়ে কাজ করে, তাদের প্রায় সবার সঙ্গে আমার পরিচয় ও যোগাযোগ আছে। কিন্তু কখনও এ বিষয়টি জানতে পারিনি। এ ঘটনায় আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি; বিশ্বাসভঙ্গের কষ্টের মতো। আমরা কাছে মনে হচ্ছে, এটা যেন ছিনতাইয়ের ঘটনা।
সমকাল: কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতের খোদ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে দাবি করছে– টাঙ্গাইল শাড়ি ‘পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত’ এবং তাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।
বিবি রাসেল: যে-ই দাবি করুক; এটা এক উদ্ভট ও ভিত্তিহীন দাবি। কারণ ভারতে ‘টাঙ্গাইল’ বলে কোনো জনপদ নেই। আপনাকে মনে রাখতে হবে, টাঙ্গাইল শাড়ি উনিশ শতকে প্রসার লাভ করলেও এর অরিজিন আরও অনেক শতাব্দীপ্রাচীন। এর তাঁতিরা বিশ্ববিখ্যাত বাংলার মসলিন তাঁতিদের বংশধর। ব্রিটিশদের আগমনের পর যখন মসলিন শিল্পের দুর্দিন চলছিল, তখন টাঙ্গাইলের জমিদাররা এই তাঁতিদের পুনর্বাসন করার জন্য টাঙ্গাইলে নিয়ে যান। সেটাও কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের বাইরের কোনো অংশ থেকে মাইগ্রেট করেনি। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ থেকে তারা সেখানে গেছে। প্রথমদিকে তারা শুধু সাদা শাড়ি তৈরি করত। এর সঙ্গে পরে রং ও নকশাযুক্ত হয়ে জামদানি ও টাঙ্গাইল শাড়ি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তাঁতিরাই ধীরে ধীরে নানা মোটিফ তৈরি করেছে। এটা একেবারে বর্তমান বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ।
সমকাল: ফুলিয়ার বসাকরা টাঙ্গাইলের বসাকদেরই একটি অংশ?
বিবি রাসেল: একদম ঠিক বলেছেন। কেউ কেউ দেশভাগের আগে-পরে গিয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করেছে। কিন্তু এখনও এমন অনেক পরিবার আছে, এক ভাই টাঙ্গাইলে, আরেক ভাই ফুলিয়ায় থাকে। তাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ, পণ্য আদান-প্রদান হয়। কিন্তু এই বসাকরাই যখন একই ধরনের শাড়ি ফুলিয়ায় বুনছে, তখন সেটা ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ হচ্ছে না। যে কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৫০ লাখ পিস টাঙ্গাইল শাড়ি আমদানি করতে হয় ভারতকে।
সমকাল: দেশভাগের পরবর্তী সময়ে যারা গেছে, তাদের কি ভারতে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হতো? আমি বলতে চাইছি, টাঙ্গাইলের বসাকদের নদীয়ায় নিয়ে যাওয়ার পেছনে টাঙ্গাইল শাড়ির মেধাস্বত্ব নিয়ে নেওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল কিনা?
বিবি রাসেল: সেটা আমি জানি না। কারণ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়েও অনেকে চলে গেছে। আর তারা তো শুধু শাড়ি নয়; আরও অনেক বস্ত্রপণ্য তৈরি করে। সেখানকার শাড়িরও ভিন্ন নাম রয়েছে; টাঙ্গাইল শাড়ি নয়। নদীয়ায় টাঙ্গাইল শাড়ির অরিজিন বিষয়টি সোনার পাথরবাটি ছাড়া কিছু নয়। আর বিষয়টি শুধু দক্ষতা বা প্রযুক্তির নয়। টাঙ্গাইলে যেমন মিহি শাড়ি তৈরি হয়; সেটা ভারতে হয় না। সে কারণেই তো ভারতকে টাঙ্গাইল শাড়ি আমদানি করতে হয়।
সমকাল: বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে জলবায়ু ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, আমরা জানি।
বিবি রাসেল: সে তো বটেই; মাটি, আর্দ্রতা, কুয়াশা, বর্ষণ, উদ্ভিদের সম্পর্ক রয়েছে। আপনি জানলে খুশি হবেন, এর সঙ্গে নদী অববাহিকারও সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে মসলিন বা জামদানি ঢাকার বাইরে অন্য অঞ্চলে এত ভালো হয় না। কম্পিউটারাইজড ব্যবস্থায়ও হাতে বোনা জামদানির মতো জামদানি তৈরি করা যায় না পাওয়ারলুম দিয়ে।
সমকাল: জিআই-সংক্রান্ত এ খবরের পর সেখানকার তাঁতিদের সঙ্গে কি আপনার কথা হয়েছে? তারা এখন কী বলছেন?
বিবি রাসেল: গত দু’দিনে দুই দেশের বসাকদের সঙ্গেই কথা হয়েছে। তারা সবাই আমার মতো আশ্চর্য হয়েছে। টাঙ্গাইলের বসাকরাও খুব কষ্ট পেয়েছে এ ঘটনায়।
সমকাল: ভারতের কোন কোন তাঁতির সঙ্গে কথা হয়েছে?
বিবি রাসেল: নাম বলতে চাই না। তাতে তারা আবার সেখানে হয়রানিতে পড়তে পারে। কিন্তু আপনি জেনে রাখুন, এ ঘটনা ফুলিয়া বা নদীয়ার ঐতিহ্যবাহী তাঁতিরাও ভালোভাবে নেয়নি। তাদের সমর্থন নেই। কারণ তারা টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাস জানে। শাড়ি তৈরি তো বসাকদের কাছে নিছক জীবিকা বা ব্যবসার প্রশ্ন নয়; ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। এর সঙ্গে তারা মিথ্যা বা জালিয়াতির মিশ্রণ করতে চাইবে না।
সমকাল: এখন তাহলে করণীয় কী?
বিবি রাসেল: যা করার সরকারকেই করতে হবে। কারণ জিআই নিবন্ধন সরকারি সংস্থাকেই করতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা যদি ঘুমিয়ে থাকে– এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে!
সমকাল: এর কারণ কি, জিআই নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সঠিক মানুষ সঠিক জায়গায় নেই? যারা আছেন, তারা শুধু চাকরি হিসেবে নিয়েছেন?
বিবি রাসেল: এ ছাড়া আর কী! দেখুন, আমি বস্ত্রশিল্প নিয়ে এতদিন কাজ করছি। ভারত ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশ আমাকে তাদের ঐতিহ্যবাহী বস্ত্রশিল্প পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের কাজে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যায়। এমনকি লাতিন আমেরিকা থেকেও আমন্ত্রণ আসে। কিন্তু আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিরা কোনোদিন বিষয়টি নিয়ে আলোচনারও প্রয়োজন বোধ করেন না। আমি তো কারও কাছে কোনো অর্থ চাই না। মা-বাবা যা রেখে গেছেন, সেটাই অনেক। বিদেশেও আমি কোনো কনসালট্যান্সি ফি নিই না। মানুষের ভালোর জন্যই কাজ করি। কিন্তু বাংলাদেশে দেখলাম– বস্ত্রশিল্প, তাঁত, জিআই নিয়ে যাদের কাজ করার দায়িত্ব, তারা ঘুমিয়ে থাকে।
সমকাল: টাঙ্গাইল শাড়ির এই ঘটনায় প্রমাণ হলো– ভারতের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ঘুমিয়ে নেই।
বিবি রাসেল: দেখুন, একটা প্রমাণ দিই। দু’দিন হলো, ভারত টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই পণ্যের নিবন্ধন নিয়েছে। এরই মধ্যে তারা উইকিপিডিয়াতেও এই শাড়ির অরিজিন হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের নাম লিখে রেখেছে। আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্তদের খবর আছে? অনলাইন, উইকিপিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে যারা বিরাট বিরাট লেকচার দেন, তারাই বা কী করছেন? স্যরি, আমি খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে আছি।
সমকাল: এখন তাহলে কি সম্ভাব্য সব জিআই পণ্যই দ্রুত নিবন্ধন করে ফেলতে হবে?
বিবি রাসেল: টাঙ্গাইল শাড়ির মতো বহুল পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত জিআই যখন অন্য দেশ পায়; যখন ছিনতাই হয়ে যায়, তখন আর কোনো পণ্য নিরাপদ আছে বলে মনে হয় না।
সমকাল: এখন কি বাংলাদেশ সরকার প্রতিবাদ জানাবে?
বিবি রাসেল: জানানো উচিত। ভানুর মতো বসে বসে দেখি না, কী করে বলার সময় নেই। প্রতিবাদ সরকারকেই জানাতে হবে।
সমকাল: আপনার দিক থেকে কিছু করার আছে?
বিবি রাসেল: সেই সিদ্ধান্ত সরকারকেই নিতে হবে। বাংলাদেশে জিআই পণ্য নিয়ে যেসব মেধা আছে, তাদের কাজে লাগাবে কিনা।
সমকাল: প্রতিবাদ করার পর টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্ব কি আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব? এমন নজির আছে?
বিবি রাসেল: ফিরে আসা উচিত। কারণ বিশ্বের আর কোথাও টাঙ্গাইল নামে জনপদ নেই। এটা যে কেউ বুঝতে পারবে– এর মধ্যে একটা জালিয়াতি আছে। এই শাড়ি যে বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ; গৌরবের বিষয়– এটা ভারতের তাঁতি ও গবেষকরাও স্বীকার করবেন।
সমকাল: যদি স্বত্ব আমরা ফিরে না পাই, তাহলে কি বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবো?
বিবি রাসেল: দেখুন, বিষয়টি বাণিজ্যের নয়; অধিকারের প্রশ্ন। বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ অন্যরা নিয়ে যাবে কেন? তাহলে এত এত মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, সংস্থা, কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন কী জন্য? প্রশ্নটা আপনাকেই করি।
সমকাল: প্রশ্নটা আমরাও রেখে দিলাম। এত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
বিবি রাসেল: সমকালকেও ধন্যবাদ। বিষয়টি নিয়ে ভালোভাবে লিখুন। লেগে থাকুন। কারণ জিআই পণ্যের অধিকার একটি দীর্ঘমেয়াদি লড়াই। হঠাৎ সজাগ হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লে কাজ হবে না।
সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন