’৯৬ সালে আওয়ামী লীগের যে দাবি ছিল তা এখন অন্যরা করলে দোষের কী
11 July 2023, Tuesday
বিরোধী দলগুলোর নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিকে যৌক্তিক মনে করেন লেখক, গবেষক ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর। তিনি বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিএনপি যে দাবি তুলেছে এটা শুধু তাদের নয় বরং দেশের জনগণ ও গণতন্ত্রিপন্থি মহলের দাবি। এটি নতুন কোনো বিষয় না। ১৯৯৬ সালে যেটি আওয়ামী লীগের দাবি ছিল। এখন অন্যরা এ দাবি করলে দোষের কী?
মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তখনও নির্দলীয় সরকারের পক্ষে জনগণের সমর্থন ছিল। যার কারণে বিএনপি দ্বিতীয়বার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল। আওয়ামী লীগ যে আজ বলছে তত্ত্বাবধায় সরকারের দাবি দেশ ও সংবিধানবিরোধী, তা কী করে হয়? ১৯৯৬ সালে তাদের দাবি ন্যায্য হলে এখনও ন্যায্য।
বদরুদ্দীন উমর বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জন নয়, বরং বিরোধীদের বলতে হবে নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। এ নির্বাচন বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, বিএনপি বলছে- আওয়ামী লীগের অধীনে হলে তারা নির্বাচন বর্জন করবে। এর জন্য ব্যাপক আন্দোলন করছে দলটি।
কিন্তু শুধু নির্বাচন বর্জন করবে বলাটা ভুল। এভাবে কোনো কাজ হবে না। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করার পর আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে ফেললে ফলাফল হবে শূন্য। কারণ আওয়ামী লীগ কোনোভাবে নির্বাচন করলেই জিতে যাবে। প্রায় শতভাগ সিট পেয়ে আবারও পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় বসবে। তাই নির্বাচন বর্জনের আওয়াজ নয়, বলতে হবে নির্বাচন বন্ধ করতে হবে। নতুবা বিএনপির আন্দোলন নিষ্ফল হবে। এটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যে বিষয়টি বিএনপি’র মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। এদিক দিয়ে তাদের আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারা যেভাবে আন্দোলন করছে তা ভুল। বলতে হবে নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। এখন থেকে বলতে হবে। লোকদের তৈরি করতে হবে। এ কথাটা নির্বাচনের সময় বললে হবে না। আওয়ামী লীগ একইভাবে নির্বাচন করলে প্রত্যেকটা কেন্দ্র জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ঘেরাও করা হবে। জনগণ যদি সেটি করে তাহলে নির্বাচন হবে না। হলেও সরকার কারো কাছে স্বীকৃতি পাবে না।
তিনি বলেন, সরকার চেষ্টা করছে জনগণের প্রতিরোধ দমন করতে। এর জন্য গণমাধ্যমের ওপরও নানা রকম বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে, সংবাদকর্মীদের ওপরও নির্যাতন করছে। যেটিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে হবে না। সাংবাদিকের নির্যাতনের প্রয়োজন কেন হয়- কারণ সংবাদমাধ্যমে নিয়ন্ত্রিতভাবে হলেও জনগণের ক্ষোভ, চিন্তা-ভাবনা এবং বিরোধীদের প্রতিরোধ প্রকাশিত হয়। তাই এটাকে তখন দমন করার প্রয়োজন হয়, যখন বিরোধীদের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা দেয়। এর কারণে সংবাদমাধ্যমের ওপর আক্রমণ হয়। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা না।
বিরোধীদের আন্দোলন সম্পর্কে প্রবীণ এ রাজনীতিক বলেন, দমন-পীড়ন চললে যেকোনো দলের জন্য আন্দোলন করা সহজ নয়। আবার বিএনপি আগে অনেক ভুল করেছে। ২০১৪ সালে তারা জ্বালাও-পোড়াও করে নিজেদের জনপ্রিয়তা নষ্ট করেছে। যে জনপ্রিয়তা উদ্ধার করতে তাদের অনেক সময় লেগেছে। ২০১৮ সালে সে জ্বালাও পোড়াও থেকে দলটি সরে এসে নিজেদের অবস্থানের উন্নতি করেছিল। কিন্তু নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের ব্যাপক কারচুপির কারণে হেরে গিয়েছিল। তখন জনগণের মধ্যেও প্রতিরোধ এখনকার মতো হয়নি। সবকিছুই পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। তিনি বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকার চিরস্থায়ী নয়। কেউ নিজেকে জমিদার মনে করলেই হয়ে যাবে না। দেশে জনগণ আছে- এটা অনেক বড় ফ্যাক্টর।
যতই দমন-পীড়ন হোক এখান থেকে একটা প্রতিরোধ হবে। বর্তমানে প্রতিরোধটা যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে আওয়ামী লীগ ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করতে পারবে না। করলেও আগের মতো মসৃণ হবে না। কারণ দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ব্যাপক আন্দোলন হচ্ছে। বিরোধী দলসমূহ বিশেষ করে বিএনপি এ আন্দোলনকে উপরে তুলছে। আবার আন্তর্জাতিকভাবেও বিষয়টি জানাজানি হয়েছে যে, বাংলাদেশে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। পশ্চিমারা বলছে নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে হবে। যার জন্য বিরোধীদের সঙ্গেও তারা কথা বলছে। এমন পরিস্থিতি আগে ছিল না। কাজেই আওয়ামী লীগ যতোই মনে করুক সব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে আবার মসৃণভাবে ক্ষমতায় আসবে- এটা বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্ভব না বলে মনে করি। এখন তাদের ব্যাপকভাবে প্রতিরোধের সম্মুক্ষীণ হতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনার সম্মুক্ষীণ হতে হচ্ছে। যেটি দলটির জন্য নেতিবাচক। নির্বাচন নিরপেক্ষ হলে আওয়ামী লীগ ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের মতো ১০টা সিটও পাবে না।
সংলাপ নিয়ে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংলাপ দরকার। কিন্তু বর্তমানে দেশে বিরোধীদের সঙ্গে সরকারের আলাপ-আলোচনা হওয়ার কোনো গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নেই। এখানে আওয়ামী লীগ যদি বলে তাদের অধীনে নির্বাচন হবে আর বিরোধীরা যদি বলে তত্ত্বাবধায় ছাড়া নির্বাচন করবো না, তাহলে আলোচনার পথ কমে যায়। তবে আলোচনার দরকার। নতুবা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে একটি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। যদিও সংলাপ করে সবকিছু ঠিক করার সম্ভবনা খুবই কম। কারণ দুই দলই নিজেদের অবস্থানে অনড়। এমতাবস্থায় সংলাপের কী ফল হতে পারে। আমার মনে হয় না যে, শেষ পর্যন্ত সংলাপ হবে। শেষ পর্যন্ত হয়তো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন হবে।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ ২০১৪ ও ’১৮ সালের মতো নির্বাচন দিয়ে আবার ক্ষমতায় এলে দেশে বড় ধরনের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। একটা ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের অবস্থা দেখা দেবে। তাই প্রশাসন ও পুলিশের জন্যও বিএনপি’র বার্তা থাকা উচিত। পুলিশ ও আমলাদের বিএনপি’র বলা উচিত তারা যেন ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আওয়ামী লীগকে কারচুপিতে সহায়তা না দেয়। ইতিমধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। কারণ এসব আমলাদের মধ্যে অনেকের বাড়ি-ঘর, টাকা-পয়সা বিদেশে আছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে- নির্বাচনে কারচুপিতে সাহায্য করলে ভিসা দেয়া হবে না। এ পরিস্থিতি হলে আমলারা বিপদে পড়বে। তাই শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়, এটা বিএনপি ও বিরোধীদেরও বলা উচিত যে, আপনারা এমন করতে পারবেন না। জনগণ থেকেও এমন আওয়াজ আসতে হবে।
মানবজমিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন