শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, সমাজ বিশ্নেষক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের আহমদ শরীফ চেয়ার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে চার দশক ধরে শিক্ষকতা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৬৫ সালে তিনি স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৬৬ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে মুক্তিসংগ্রাম, কালের যাত্রার ধ্বনি, নৈতিক চেতনা :ধর্ম ও মতাদর্শ, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন, উনিশ শতকের মধ্যশ্রেণি ও বাংলা সাহিত্য উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। আবুল কাসেম ফজলুল হক ১৯৪৪ সালে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
সমকাল: বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার একটা মূল্যায়ন দিয়ে শুরু করতে চাই।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কী বলব? এটা বলতে পারি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো না; অনেক দিন ধরেই তা ভালো না।
সমকাল: আরেকটু ব্যাখ্য করে বলবেন?
ফজলুল হক: ১৯৭১ সালে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তার আগে ৬ দফা আন্দোলন, তারও আগে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন; তারও আগে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন- এই সবকিছুর মধ্যে আমাদের জাতির একটা শক্তি এবং রাজনৈতিক বুদ্ধির প্রকাশ ঘটেছিল। তখনও অনেক খারাপ কিছু ছিল; তবে সেই খারাপকে অতিক্রম করে ভালোর দিকে যাওয়ার একটা শক্তি ও চিন্তা আমাদের জাতির মধ্যে ছিল। এখানে জাতি বলতে আমরা বলব, ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির পর যে পাকিস্তান হলো, তার মধ্যে পূর্ববাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান হলো; এ শক্তিটা ভালো-মন্দ মিলিয়ে ভালোই ছিল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি; বিষয়টার সাংবিধানিক স্বীকৃতি, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ- এ সবের কিছুই হতো না, যদি তখনকার জাতীয় চরিত্র এখনকার মতো থাকত। আমাদের বর্তমান খারাপ হলেও ভবিষ্যৎ ভালো হবে- এ রকম একটা বিশ্বাস জনগণের মধ্যে ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রের মধ্যে তাঁর ক্ষমতা সুসংহত করতে পারেননি। তখন চরম একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ছিল। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীও; এমনকি যাঁরা অনেক আগে থেকেই দলটি করে আসছিলেন, তাঁরাও মত্ত হয়ে গেলেন ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে; দুর্নীতি-সন্ত্রাস-লুটপাটে।
সমকাল: বিরোধী দল তখন কী করেছে?
ফজলুল হক: তখন বিরোধী শক্তি বলতে তেমন কিছু ছিল না; অল্প কিছু ছিল- যেমন বামপন্থিরা; যাদের একটাই কাজ ছিল অন্যায়-অবিচার-দুঃশাসন ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো। তবে এই প্রতিবাদ করার শক্তি বামপন্থিদের পাকিস্তান আমলে যতটুকু ছিল; পরবর্তী সময়ে ততটুকুও ছিল না। ধীরে ধীরে শক্তি ক্ষয় হতে লাগল। আওয়ামী লীগও মুক্তিযুদ্ধের পরে কী লক্ষ্য নিয়ে এগোবে, সেটা খুব স্পষ্ট ছিল না। পাকিস্তান আমলে তাদের লক্ষ্যের মধ্যে ভালো কিছু মহৎ কিছুর দিকে যাত্রার মনোভাবটা বোঝা গেছে। তারা তখন যেটুকু করেছে, সেটাকেই আমরা সন্তোষজনক কিছু বলব।
সমকাল: বিরাজনীতিকীকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে আপনি কখনও কখনও আক্ষেপ করে থাকেন। এই প্রক্রিয়া কখন থেকে শুরু হলো?
ফজলুল হক: আশির দশক থেকে আমাদের রাজনীতি খারাপ থেকে খারাপের দিকে যাচ্ছে। তখন থেকে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর অর্থায়নপুষ্ট ও নিয়ন্ত্রণাধীন এনজিও আর সিএসও-সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন, তাদেরকে এনজিওই বলা যায়; এ দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে। এতে সমস্যা ছিল না যদি যথার্থ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তারা কাজ করত। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি সংস্থা যেভাবে উন্নয়ন সাধন করতে চায়, ওরা সেভাবেই কাজ করতে থাকে। তারা শুধু মানবাধিকারের কথা বলে; রাজনীতির যথাযথ উন্নতির জন্য যা প্রয়োজন, তা বলে না। এই যে বিরাজনীতিকীকরণ প্রক্রিয়া, তা চলতে চলতে আজকে আমাদের একেবারে রাজনীতিশূন্য একটা পরিস্থিতিতে ঠেলে দিল।
সমকাল: নাগরিক সমাজকে এককভাবে দায়ী করছেন কেন?
ফজলুল হক: ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের যে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা; সেটাতে অনেক ভালো ভালো কথা আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিষয় বাদ দিয়ে শুধু মানবাধিকারের কথা বলার কোনো মানে হয় না। কথা বলার স্বাধীনতা চাই, সভা করার স্বাধীনতা চাই, হরতাল ডাকার স্বাধীনতা চাই ইত্যাদি বিষয়ই তো জাতিসংঘের ওই ঘোষণায় আছে। নাগরিক সংগঠনগুলো তাদের বক্তব্যকে শুধু এসব বিষয়ে সীমাবদ্ধ রাখে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ইত্যাদি দাবির নামে তারা গণতন্ত্র বাদ দিয়ে এখানে এক ধরনের নির্বাচনতন্ত্র দাঁড় করিয়েছে। সেই ১৯৮০-এর দশক থেকেই নির্বাচন সম্পর্কে সব রকম অবিশ্বাস-সন্দেহ দেখা দিয়েছে। পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নির্বাচন নিয়ে যত কথা হয়েছে, সেগুলোতে কখনও নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে আজকের মতো এতটা অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়নি। এখানে কোনো দল সরকার গঠনের মতো আসন না পেলেই নির্বাচন কমিশনের প্রতি চরম অনাস্থা দেখিয়েছে; তার বিরুদ্ধে অপর পক্ষকে দুর্নীতির মাধ্যমে জিতিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে। আমি বলতে চাচ্ছি, গোটা রাজনীতিকে এখানে নির্বাচনসর্বস্বতায় পর্যবসিত করা হয়েছে।
সমকাল: বাংলাদেশের ব্যাপারে বিদেশিদের এত আগ্রহের কারণ কী?
ফজলুল হক: বিদেশি নানা শক্তি সক্রিয় রয়েছে দেশের রাজনীতিতে। এক সময় শিক্ষিত শ্রেণির মানুষ বাংলাদেশকে মনে করতেন একটা ছোট, ঋণগ্রস্ত দেশ হিসেবে। এর কোনো ভবিষ্যৎ থাকতে পারে বলে তাঁরা বিশ্বাস করতেন না। কালক্রমে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জাপান ইত্যাদি বৃহৎ শক্তি বাংলাদেশের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠল। দেখা যায়, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দেশটা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলে এ অঞ্চলে ওই শক্তিগুলোর জাতীয় স্বার্থ রক্ষা সহজ হয়।
সমকাল: আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতির পথে নাগরিক সমাজ- এই বিষয়টি সরলীকরণ হয়ে গেল কিনা?
ফজলুল হক: ১৯৮০-এর দশক থেকে এনজিও বা সিএসওর ভূমিকা এ দেশে সরকার গঠন বা পরিবর্তনে সীমাহীন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাজনীতির ভেতরে যাতে রাজনীতি না থাকে এবং শুধু ভালো একটা নির্বাচন করতে পারলেই আমাদের রাজনৈতিক কর্তব্য শেষ হলো- এ রকম একটা ধারণা এরা ক্রমাগত প্রচার করেছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর থেকে একাধিক নাগরিক কমিটি হয়েছে; সেসব কমিটিতে এনজিও ব্যক্তিত্বদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এবং আছে। এ ধরনের নাগরিক কমিটি বিগত বিএনপি আমলে প্রায় এক বছর সারাদেশে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে সভা করেছে; এ জন্য তারা বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে। তাদের মূলকথা ছিল- যোগ্য প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করা। এই যে যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন তাঁরা করলেন, তারই ফল ছিল ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই যে বলা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভালো নির্বাচন করেছে; সেটা তো হয়েছে বিদেশি শক্তির সহায়তায়। ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সের প্রতিনিধি, জাতিসংঘের প্রতিনিধি, কমনওয়েলথের প্রতিনিধি এসব মানুষ বেশ বড় সংখ্যায় এখানে এসেছেন এবং ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে ঘুরেছেন; নির্বাচন ওয়াচ করেছেন। তখন সাংবাদিকও বেশি সংখ্যায় এসেছেন বিদেশ থেকে। আমার কথা হলো, এভাবে বিদেশি শক্তির তত্ত্বাবধানে ভালো নির্বাচন হলেও তা বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো উন্নত অবস্থা নির্দেশ করে না। গণতন্ত্রের মূল বিষয়গুলো বাদ দিয়ে নির্বাচনকে যখন সবকিছুর কেন্দ্রীয় বিষয় করা হলো; রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও উন্নয়নকে আলাদা করে দেওয়া হলো; বলা হলো- সরকার প্রশাসন দেখবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে আর উন্নয়ন করবে এনজিওরা- এর ফলে সৃষ্ট বাস্তবতায় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিশূন্য হয়ে গেছে।
সমকাল: ইদানীং রাজনীতি আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে। এ সম্পর্কে কী বলবেন আপনি?
ফজলুল হক: রাজনৈতিক অস্থিরতা মানে আমাদের প্রধান দু'দলের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ বেড়েছে। এ সংঘাত মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক। এখানে রাজনীতি বা আদর্শের কিছু নেই।
সমকাল: দুটো দলকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন আপনি?
ফজলুল হক: আওয়ামী লীগ একটা সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অধিকারী। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ভাসানীর নেতৃত্বেই ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে। আবার বিশেষত ৬ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বড় দলে পরিণত হলেও তার মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা খুব একটা ছিল না। তখন বঙ্গবন্ধুর একটা ইমেজ গড়ে তোলা হয়েছে। তার ভিত্তিতে পুরো দল বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে চলেছে। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, সব ক্ষমতা শেখ মুজিবের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। তিনি যা বলেছেন, সেভাবেই দল পরিচালিত হয়েছে। তবে তখন অন্তত এক ধরনের আদর্শবোধ মানুষের মধ্যে ছিল; নেতৃত্বের মধ্যেও এক ধরনের সততা ছিল। যে সময়ে রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর হাতেখড়ি হয়েছে, তখন কারও মধ্যেই অর্থলোলুপতা দেখা যায়নি। শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী- কেউই আর্থিকভাবে অসৎ ছিলেন না। শেরেবাংলা তো আদালত কর্তৃক ঋণগ্রস্ত ঘোষিত হয়েছিলেন। তাঁর কি অনেক ভূসম্পত্তি ছিল? সোহরাওয়ার্দী আইনজীবী হিসেবে অনেক অর্থ উপার্জন করেছেন, তবে তা দলের পেছনে, কর্মীদের জন্য খরচ করেছেন। সোহরাওয়ার্দীই তো বঙ্গবন্ধুকে ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন। আরেকটা কথা, বঙ্গবন্ধু কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর চেয়ে অগ্রসর চিন্তার মানুষ ছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর কাছে রাজনীতি মানেই ছিল ক্ষমতা, নির্বাচন, মানবাধিকার ইত্যাদি। এসবের বাইরে অর্থনীতি-সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে তাঁর কোনো ভাবনা ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলেছিলেন। তিনি মনে করতেন, আমরা মুসলমান হলেও আগে মানুষ। এই বঙ্গবন্ধুনির্ভর দল ১৯৭২-এ ক্ষমতায় এসে আর শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে পারছিল না।
সমকাল: বিএনপি নিয়ে বলুন।
ফজলুল হক: বিএনপি সুষ্ঠু কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে আজ পর্যন্ত আসেনি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছিলেন তখনকার জনগণের বৃহত্তর অংশের মধ্যে বিরাজমান আওয়ামী লীগবিরোধী মনোভাবকে পুঁজি করে। তাঁর বক্তব্য ছিল অনেকাংশেই সাম্প্রদায়িক। ব্রিটিশ আমলের শেষদিকের সাম্প্রদায়িকতাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন তিনি। সরাসরি হিন্দুবিরোধী বক্তব্য না বললেও তাঁর গোটা রাজনীতি ছিল ভারত ও হিন্দুবিরোধী। একেবারে আমেরিকাপন্থি ছিলেন তিনি। ধর্মকে বিএনপির স্বার্থে ব্যবহার করতেন। তাঁর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে কোনো সুষ্ঠু ধারণার পরিচায়ক ছিল না। মূলত আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদের পাল্টা হিসেবেই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলেছিলেন। আর এখনকার বিএনপি নেতৃত্ব অত্যন্ত দুর্বল; স্পষ্ট কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নেই তাদের। আওয়ামী লীগের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ছাড়া আর কোনো কথা নেই তাদের। জনগণের মধ্যে বর্তমান সরকার সম্পর্কে যতটুকু অসন্তোষ আছে, সেটাকে পুঁজি করেই রাজনীতি করছে তারা।
সমকাল: এখন তো জনগণের মধ্যে তাদের বেশ সমর্থন দেখা যাচ্ছে।
ফজলুল হক: হ্যাঁ, আগে তারা জনসভা করলে লোক তেমন হতো না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ জনসভা করে দেখাত, তাদের বিপুল জনসমর্থন আছে। গত কয়েক মাস ধরে এ নিয়ে দু'দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। বিএনপিও জনসভা করে দেখাতে চাচ্ছে- জনসমর্থন তাদের দিকে। এটার মধ্যেও যে বিএনপির পরিচ্ছন্ন রাজনীতির চিন্তা আছে, তা নয়। আওয়ামী লীগেরও যে রাজনৈতিক বক্তব্য আছে, তা বলা যাবে না। আগে কিছু রাজনৈতিক বক্তব্য দিলেও ইদানীং তারাও নিছক নির্বাচনকেন্দ্রিক বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। এ প্রেক্ষাপটে বলা যায়, গোটা বাঙালি জাতিই রাজনীতিমুক্ত হয়ে গেছে।
সমকাল: বিএনপি নেতারা বলছেন, বর্তমান সরকারকে রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে উৎখাত করা হবে।
ফজলুল হক: বিএনপির বর্তমান কাজের ধারাকে কোনো দিক থেকেই ভালো মনে করি না। তাদের বলা উচিত ছিল- আওয়ামী লীগ থেকে অমুক অমুক ক্ষেত্রে আমরা ভালো কিছু করব; জাতি ও জনগণের সমাধানযোগ্য সমস্যাগুলো সমাধান করব। এ রকম বক্তব্য নিয়ে দাঁড়ালে বিএনপির পক্ষে প্রবল জনসমর্থন দেখা দিত। অবশ্য রাজনীতিশূন্য যে ক্ষমতার লড়াই; তাতেও বিএনপি উল্লেখযোগ্য সমর্থন পাচ্ছে। পাশ্চাত্যে দুই মেয়াদের বেশি এক নেতার ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নেই। আমাদের এখানে তেমন বিধান থাকা দরকার ছিল; তবে তা যে এখানে নেই সেটা আমাদের জাতীয় দুর্বলতা; শুধু আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে দোষ দিলে হবে না। দুটো দলই এখন রাজনীতিশূন্য হয়ে পেশিশক্তি প্রদর্শন করছে। এর মধ্যে গণতান্ত্রিক চিন্তা-মন-মানসিকতা নেই।
সমকাল: বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের কথা বলছে। আপনার বিবেচনায় তা কতটুকু সম্ভবপর?
ফজলুল হক: আগেই বলেছি, এ বিষয়টা বাইরে থেকে আমদানিকৃত; ওই বিদেশি অর্থে পুষ্ট সিভিল সোসাইটি এর প্রবক্তা। এ ধরনের ব্যবস্থায় প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৯১ সালে। অনেকে বলেন, নির্বাচনটা খুব ভালো হয়েছিল। কিন্তু কোনো বিবেকবান, দেশপ্রেমিক ও চিন্তাশীল মানুষ এভাবে বলবেন না। এ ব্যবস্থায় আমেরিকা, ব্রিটেন, জাপান বা ফ্রান্স সমর্থন জোগাচ্ছে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে। এর মাধ্যমে আমাদের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাগুলো দূর হচ্ছে না বরং ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। আমাদের জরুরি কর্তব্য হলো রাজনৈতিক দুর্বলতাগুলো ধীরে ধীরে কাটিয়ে উন্নতির দিকে যাওয়া। এ প্রক্রিয়ায় জনগণের প্রকৃত সরকার নির্বাচিত হয়ে আসবে।
সমকাল: জনগণের প্রকৃত সরকার নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান আমরা গড়তে পেরেছি?
ফজলুল হক: সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার গঠন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। নিজেদের দলীয় নেতৃত্ব ভালোভাবে গড়ে তোলা এবং দলীয় বক্তব্য বাস্তবসম্মতভাবে তৈরি ও উপস্থাপন করতে হবে। সাংগঠনিক কাজের মধ্য দিয়ে জনগণের সঙ্গে একাত্ম থাকা- মাও সেতুঙের ভাষায় গণলাইন অবলম্বন করা। গণলাইন মানে জনগণের অর্থনীতি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নতির বক্তব্য নিয়ে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে রাজনীতি করতে হবে।
সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ।
ফজলুল হক: সমকালকেও ধন্যবাদ।
সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন