জাতীয় ঐক্যের একটি প্রেক্ষাপট বহু আগেই সৃষ্টি হয়েছিল। তারপরও জাতীয় ঐক্যের ভিত তৈরি হয়নি। কারণ, মতপ্রধান রাজনীতিবিদ এবং মতাদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করেছে। তাই জাতীয় ঐক্যের তাগিদ বা প্রয়োজন থাকার পরও জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠেনি। এত দিন পর যে ঐক্যের মঞ্চ আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটা কয়েকটি পজেটিভ চিন্তার ঐক্য, একই সাথে কয়েকটি নেগেটিভ চিন্তার ফসল।
পজেটিভ চিন্তার বিষয়গুলো আপাতত একমঞ্চে ওঠার একটা প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করেছে। বাস্তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর আদর্শিক ভাবনার দূরত্ব অনেক বেশি নয়। প্রায় সব দল এখন গণতন্ত্র চায়। কারণ, সরকার বাস্তবে গণতন্ত্রের কবর দিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া সরকারের প্রতিপক্ষ হতে পারে, শক্তি আছে, সামর্থ্য আছে, জনশক্তি আছে, জনসমর্থন আছে- সেসব দলের নেতাদের ব্যাপারে সরকার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরই বাস্তবে দমন-পীড়নের উদ্যোগ নিয়েছে। হামলা-মামলা শুরু করে দিয়েছিল তখন থেকেই। তখন অন্য দলগুলো বড় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বরং ভেবেছে, ওরা তাদেরও প্রতিপক্ষ হতে পারে। অন্তত আদর্শিক বিবেচনায়।
তাই সরকারের দমন-পীড়ন, হামলা-মামলার ব্যাপারে প্রতিবাদী হতে চায়নি। সেই সুযোগ সরকার পুরো মাত্রায় নিয়েছে। তখনই যদি রাজনৈতিক দলগুলো সোচ্চার হতো এবং নীতিনিষ্ঠ অবস্থানে বসে দলান্ধ চিন্তা ও মতান্ধ চিন্তার ব্যাপারে কোনো ক্ষুদ্র চিন্তা ঠাঁই না দিত, তাহলে সরকার তখনই আপস মানতে বাধ্য হতো। কোনো কোনো দলকে অফিসে বসতে দেয়নি। কোনো কোনো নেতাকে নিজের বাসায় ঘুমাতে দেয়নি। দৌড়ের ওপর রেখেছে। সক্ষম জনশক্তিকে নানাভাবে হয়রানির ভেতর রেখেছে। এখনো আমরা ‘ভুতুড়ে’ মামলার কথা শুনছি এবং দেখছি। এ অবস্থা আজকে সবার দৃষ্টিতে পড়ছে, অথচ সরকার যখন এ ধরনের একটি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছিল; অন্যরা-এমনকি রাজনৈতিক মিত্ররাও সামনে এগিয়ে এসে দুটো কথা বলার সাহস দেখায়নি। এ সুযোগটাই সরকার একে একে বাস্তবায়ন করে শেষ পর্যন্ত সবার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। কাউকে করেছে গুম, কাউকে দিয়েছে ক্রসফায়ারে, অন্য অনেককে জেলে পাঠিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ঠেকিয়েছে।
জামায়াতকে দিয়ে সরকার এই কৌশল বাস্তবায়ন শুরু করেছে। অন্যরা টুঁ শব্দটি করেনি, ভেবেছে ‘মৌলবাদী স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ’কে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কেউ বাহবা দিয়েছে, কেউবা নীরবে সমর্থন জুগিয়েছে। এরপর জামায়াত-বিএনপি দূরত্ব সৃষ্টির সব চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত ষোলআনা সফল না হলেও জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে একঘরে করে দেয়া সম্ভব হয়েছে। জামায়াতকে যখন একঘরে করে দেয়ার সব আয়োজন মোটামুটি চৌদ্দআনা সফল হলো- তখন হাত পড়ল বিএনপির ওপর। বিএনপিকে অফিসেও টিকতে দেয়া হচ্ছিল না, তাদের অফিস ফাঁকা থাকত। বিএনপির ওপর সরকারের ক্রোধ-বিদ্বেষ এতটা বেড়ে গেল যে, তাদের জনসভা করা, মিটিং মিছিল করার পথেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলো। তার জের চলল; খালেদা জিয়াকে জেলে নিয়েও সরকার স্বস্তি পাচ্ছে না। এর বাইরে ২০ দলীয় জোটের অন্য দলগুলোর নেতাদের তো বটেই, কর্মীদেরও চোখে চোখে রাখতে শুরু করে।
অন্য দিকে, আওয়ামী লীগকে বাস্তবে গড়ে তোলা হলো বাকশালের আদলে। ছাত্রলীগকে এতটা বেপরোয়া করে তোলা হলো যে, তারা প্রতিপক্ষের কাছে আতঙ্ক হয়ে দেখা দিলো। এর সর্বশেষ নজির দাঁড়ায় কোটা আন্দোলনে, এমনকি নিরাপদ সড়কের দাবিতে তারুণ্যের জাগৃতিও ছাত্রলীগকে দিয়ে দমন করার চেষ্টা চলেছে।
এর আগে দলীয়করণের সব চেষ্টা সাঙ্গ করে এই সরকার। এমন কোনো অফিস নেই, আদালতপাড়া থেকে পুলিশ, ক্যাডার সার্ভিসের লোকজন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, প্রশাসনের কর্মকর্তা থেকে পাইক-পেয়াদা পর্যন্ত সবাইকে দলীয় বলয়ে নিয়ে আসা হলো। উন্নয়নের নামে একধরনের কসমেটিক উন্নয়নের দিকে নজর দেয়া হয়।
তাতে সুবিধাভোগী বানানো হলো কেবল দলীয় লোকদের। এভাবে প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হলো। অন্য দিকে, দলীয় ক্যাডারদের সামর্থ্য বাড়িয়ে তোলা হলো। এভাবেই কোনো প্রতিপক্ষকে আর সামর্থ্যবান রাখা হলো না। জেলে ঢুকিয়েই শুধু ক্ষান্ত হলো না, মামলার পর মামলা সাজানো হলো। একটা মামলা থেকে জামিন পায় তো, অন্য মামলায় জেলগেট থেকেই আবার গ্রেফতার দেখানো হলো। আমলাতন্ত্রে রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত করে শত শত যোগ্য, সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখা হলো। কাউকে বাড়ি পাঠিয়ে বেকার জীবনের অভিশাপ বহন করতে বাধ্য করা হলো।
সাধারণত গণতন্ত্রে একদল ক্ষমতায় যায়, অন্য দল থাকে ক্ষমতার বাইরে। অন্যান্য ছোট দল নিজেদের ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়ার জন্য বা নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। গণতন্ত্রে বহুদলীয় ধারণাকে ঘৃণা করা হয় না। বরং পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া হয়, যাতে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ছোট দলই একসময় রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয় করে বড় দলে রূপ নিতে পারে।
বিশ্বজুড়ে এখন দ্বিদলীয় ধারণাই প্রাধান্য পেতে শুরু করেছে। একদল ক্ষমতায় যায়, অন্য দল বিরোধী দলে অবস্থান করে। সেখানে রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করা হয়। যেমন ভারতে দ্বিদলীয় ধারণাই পুষ্ট হয়ে আছে। একই অবস্থা ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অপরাপর দেশেও। এর মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছোট দলও অনেক সময় শক্তি সঞ্চয় করে দ্বিধারার রাজনীতিতে জায়গা করে নেয়। এসব স্থানে প্রতিযোগিতা আছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে, তবে আমাদের দেশের মতো প্রতিপক্ষকে শত্রু ভাবার মতো পরিবেশ নেই।
তবে আমাদের দেশেও হালে রাজনীতিতে গ্রহণ-বর্জনের একটা ভাঙাগড়া শুরু হয়েছে। ডান-বাম একযোগে কাজ করছে। আবার একসময়কার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পরে বন্ধুতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এটা বলা চলে, অনেকটাই ঠেকে শেখার মতো একটা অবস্থা। এই ঠেকে শেখার কারণেই জাতীয় ঐক্যের মতো একটা প্লাটফরম আপাতত দাঁড়িয়েছে। আমরা মনে করছি না, এটাই সব কিছুর উপসংহার টানতে সক্ষম হবে। তবে আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে- এর মাধ্যমে আমাদের রাজনীতি ধীরে ধীরে আবার একটা প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আরেকটি বড় সত্য কথা হচ্ছে, আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধের ইস্যু কমে আসছে।
‘বাঙালি’ ও ‘বাংলাদেশী’ বিতর্কের একটা উপসংহার প্রায় হয়ে গেছে। ‘স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ’ ইস্যুরও উপসংহার টানা হয়ে যাচ্ছে। বড় মাপের একটা দূরত্ব এখনো রয়ে গেছে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে। কারণ এ ক্ষেত্রে পড়শি দেশ অনেক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে। এটাও একটা সময়ে এসে নিঃশেষ হয়ে যাবে। কারণ, বিতর্কের ইস্যুগুলো একটা একটা করে সমাধা হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের শক্তি যতটা বাড়বে, সরকারের মেরুদণ্ড যতটা শক্ত হবে; ততটাই বিদেশনীতিতে একটি মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়ে যাবে। তা ছাড়া এখন যত বড় পড়শি হোক, এককভাবে কোনো ছোট প্রতিবেশীর ওপর ছড়ি ঘুরানোর সুযোগ নেই। কারণ, রাজনৈতিক বলয়ে দূরের শক্তিধর দেশগুলোও প্রভাবক হয়ে উঠছে। তাই বিদেশনীতিতে একক খবরদারি করার সময়ও বোধ করি, ফুরিয়ে আসছে। এর বাইরে রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে কতগুলো বিষয় নিয়ে এখন আর বিরোধ সৃষ্টি করার সুযোগ কম। কারণ, সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। গণতন্ত্রও আগের সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ নেই।
ইসলামকে নিয়ে যারা রাজনীতি করেন তারাও কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণাকে আত্মস্থ করে মডারেট হয়ে গেছেন। তারপরও বলা যায়, চরমপন্থী সব যুগে ছিল। বর্তমানেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে তারা রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়ে রাষ্ট্রশক্তি নিয়ন্ত্রণ করার মতো অবস্থানে যেতে চাইলেও বাস্তবে পারবে না। কারণ, মানুষের ভেতর চিন্তার রূপান্তর ঘটেছে। বস্তুবাদ ও ধনতন্ত্র যেমন জায়গা পাচ্ছে, তেমনি নৈতিক শক্তি উত্থানের একটা নিরন্তর চেষ্টাও কাজ করছে।
এর বাইরে, আন্তর্জাতিকবাদ এখন শুধু স্লোগান নয়, বাস্তবতাও। কারণ, ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ বলে একটা কথা আছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ মানুষকে কাছাকাছি এনে দিচ্ছে। আবার স্বার্থের বোঝাপড়ার একটা বিষয়ও সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। তাই ভূঁই দখলের জমানা শেষ, আকাশ দখলের যুদ্ধও প্রায় শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু মেধার বিকাশ থেমে নেই। তাই মেধাই আগামী দিনের শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে বিশ্বকে পরিচালিত করবে। সে ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ভূমিকা হবে এমন যে, বোতাম টিপে তাবৎ বিশ্বকে ধ্বংস করে দেয়া যাবে, আবার অন্য বোতামটিকে ঠেকানোর মতো অবস্থাও নতুন প্রজন্ম দেখতে পাবে। তাই রাজনীতিতে বিভেদের দেয়াল ভেঙে ঐক্যের সুর বাজানোর সময় এটাই। যারা এ ক্ষেত্রে যতটা সক্ষমতা দেখাবে, তারাই টিকে থাকবে। অন্যরা প্রতিযোগিতায় থাকবে। সে ক্ষেত্রে হিংসা-বিদ্বেষ ও মারমুখী হওয়ার সুযোগ কমে আসতে বাধ্য।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন