সরকারি দল আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতৃবৃন্দ থেকে নিয়ে তাদের ঘরানার কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী যেভাবে নিজেদের দল ও দলীয় লোকদের সতর্কবাণী দিচ্ছেন তার থেকে বোঝার অসুবিধা নেই যে, আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো হওয়ার উপায় নেই।
বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অর্থাৎ সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তর্ক-বিতর্ক কখনই জনগণের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা অথবা জাতীয় সমস্যা নিয়ে হয় না। এটা সব সময়েই হয় কতকগুলো তুচ্ছ ও কল্পিত বিষয় নিয়ে। জাতীয় সংসদে বক্তৃতা ও তর্ক-বিতর্কের চরিত্র ও মান একই প্রকার। এটাই স্বাভাবিক। কারণ দলের যারা নেতৃস্থানীয়, তারাই তো জাতীয় সংসদের আসন অলংকৃত করেন।
১৯৭২ সাল থেকে এ দেশে একের পর এক দলের সরকার ও সামরিক সরকার যেসব খেলা দেখিয়েছে তাতে শুধু যে দেশের সামাজিক কাঠামোকেই তারা প্রায় ভেঙে ফেলেছে তাই নয়, শাসক বুর্জোয় শ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলোকেও পরিণত করেছে একেকটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, বাংলাদেশে জাতীয় সংসদের সদস্যদের ৮০ শতাংশই হচ্ছেন ব্যবসায়ী এবং বাকিরা কোনো না কোনোভাবে ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত।
এই মুহূর্তে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে জনগণের মধ্যে প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বেশ বড় আকারে দানা বেঁধেছে। সম্প্রতি এ নিয়ে শিক্ষার্থীরাও বড় আকারে আন্দোলন করেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এ সমস্যার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। উপরন্তু প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। কারণ সড়ক দুর্ঘটনা সরকারি দলের ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত।
তাদের লোকরাই বাস-ট্রাকের মালিক। দুর্ঘটনার আসল কারণ ড্রাইভাররা নয়, এরাই। ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাহীন- শাসকশ্রেণীর লোকরা অক্টোপাসের মতো দেশের শিল্প, বাণিজ্য, কৃষিসহ সমগ্র অর্থনীতিকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে যে, এদের দ্বারা এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ও উন্নতি কোনোমতেই সম্ভব নয়।
কাজেই সরকারি দলের নেতৃবৃন্দ এবং তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যতই তাদের লোকদেরকে সতর্কবাণী দেন এবং অপকর্ম থেকে বিরত থাকতে বলেন, তাতে কিছুই এসে যায় না। ব্যবসায়ীদের শ্রেণীচরিত্রই এক্ষেত্রে বড় বাধা। শাসকশ্রেণীর সরকারি ও সরকারবহির্ভূত দলগুলো সরকারি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাচ্যুত না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতির মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সম্ভব নয়।
যে দেশের রাজনীতিবিদরা পরস্পরের সঙ্গে সভ্যতা বজায় রেখে বিতর্ক করতে অপারগ, সেদেশের শাসকশ্রেণীর সাধারণ সাংস্কৃতিক মান যে নিুস্তরের হবে, এটা এক স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেটা দেখা যায়। এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা গ্রাম্য মোড়লের মতো আচরণ করেন এবং তাদের তর্ক-বিতর্ক ‘তুই করেছিস’, ‘তুই করেছিস’-এর পর্যায়ের উপরে উঠতে পারে না।
মনে হয়, এই নেতারা কোমরে কাপড় বেঁধে পরস্পরের সঙ্গে গ্রাম্য কোন্দল ছাড়া আর কিছু জানে না। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের অবস্থা নিতান্তই করুণ। যেভাবে এই উচ্চপর্যায়ে অশালীন ভাষা ব্যবহার করা হয়, খিস্তিখেউড় পর্যন্ত হয়, এটা এক ব্যতিক্রমী ব্যাপার। অন্য কোনো দেশের জাতীয় সংসদে এটা চিন্তা করাই যায় না।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংস্কৃতি এবং রাজনীতির মান ও চরিত্র সম্পর্কে এখানে এসব কথা বলার উদ্দেশ্য, বাংলাদেশ এখন যে সার্বিক সংকটের মধ্যে পড়েছে তার মূল কারণটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কে না জানে যে, বাংলাদেশের সরকার ও শাসকশ্রেণীর মধ্যে এখন চোর, দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্তদের ছড়াছড়ি। কে না জানে যে, এসব কাজ যারা করে তাদের চরিত্র এবং আচরণগত সংস্কৃতির মান অতি নিু না হয়ে অন্য কিছু হওয়ার উপায় নেই।
সরকারি দলের নেতৃবৃন্দের অনেক লম্বাচওড়া কথাবার্তার আড়ালে এখন এমন আতঙ্ক বিরাজ করছে যে, তাতে মনে হয় তাদের সরকারের পতন ঘটলে তাদের কী অবস্থা দাঁড়াবে এটা তাদের এক বড় ভাবনার বিষয়। এসব নিয়ে তারা নিজেরাই কেউ কেউ এখন এমন সব কথা বলছেন, যা বিরোধী দলের কেউ বললে তার বিপদ আছে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, তারা কেউ কেউ নিজেদের লোককে সতর্ক করার জন্য এসব কথা বলতে বাধ্য হচ্ছেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এদিক দিয়ে একেবারেই বেপরোয়া।
মনে হয়, তার ক্ষেত্রে লাগাম টানার কোনো ব্যাপার নেই। এ কারণে তিনি এখনও জোরে জোরে বলে যাচ্ছেন যে, বিএনপি নির্বাচনে না এলেও নির্বাচন হবে! কীভাবে হবে? বাংলাদেশের সংসদীয় ব্যবস্থায় বিএনপি একটি বড় এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ দল। পরিস্থিতি এখন এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, ২০১৩ সালের মতো বিএনপির মারদাঙ্গা করে লাভবান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তারা নিজেরাও সেটা এখন বোঝে।
তাদের রাজনৈতিক বোধবুদ্ধির উদয় হয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে আওয়ামী লীগ কিন্তু তাদের পূর্ব অবস্থাতেই আছে। তারা মনে করছে, ২০১৩ সালে মারদাঙ্গা, জ্বালাও-পোড়াও করে বিএনপি যেমন দুর্বল অবস্থায় ছিল, তাদের প্রতি জনগণের একটা বিরোধিতা যেভাবে ছিল, সেটা এখনও আছে। কাজেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যেভাবে তারা নির্বাচন কমিশন ও পুলিশকে ব্যবহার করে ‘নির্বাচন’ করেছিল এবারও তারা সেটা করতে সক্ষম হবে।
কাজেই তাদের বলতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও নির্বাচন হবে! সুযোগ বুঝে নির্বাচনকে নিয়ে বিশেষ অবস্থায় কিছু খেলা দেখানো যায়, যেমন তারা দেখিয়েছিলেন ২০১৪ সালে। কিন্তু দেশের নির্বাচন কারও হাতের মোয়া নয়। নির্বাচন আসলে এমন ব্যাপার যাতে সংসদীয় ব্যবস্থাতেও চুরি-দুর্নীতি-কারচুপি-সন্ত্রাস করে বারবার পার পাওয়া যায় না।
ভেতরকার ব্যাপার যাই হোক, আওয়ামী লীগের মুখপাত্র, তাদের সাধারণ সম্পাদক এখনও পর্যন্ত এ ধরনের অসার কথাবার্তা বলেই তাদের রাজনৈতিক আসর গরম রাখতে চাইছেন। তার এই বেপরোয়া কথাবার্তা যে জনগণের মধ্যে, এমনকি তাদের নিজেদের দলীয় কর্মীদের মধ্যেও কোনো প্রভাব ফেলছে না, ফেলতে পারে না, এটা এখন খুব স্পষ্ট। কাজেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এখন বাস্তবত অরণ্যে রোদন করে জনগণের এক করুণার পাত্রেই পরিণত হয়েছেন।
অন্যদিকে সতর্কবাণী প্রদানকারীরাও একইসঙ্গে করুণার পাত্র। তাদের মতো অনুগতদের কোনো কথায় কর্ণপাত করার অভ্যাস নেতানেত্রীদের নেই। কারণ তারা এদেরকে অনুগ্রহপ্রার্থী ছাড়া আর কিছুই মনে করেন না।
নির্বাচনের দিন এগিয়ে আসছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি কোনো গোছানো দল নয়। তাদের সাংগঠনিক সমস্যা আছে। যেমন সাংগঠনিক সমস্যা আছে আওয়ামী লীগেরও। বিএনপির সব থেকে বড় সাংগঠনিক সংকট এখন দাঁড়িয়েছে জামায়াতকে নিয়ে। এমনভাবে তারা দীর্ঘদিন জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আছে যে, সেটা ছিন্ন করা তাদের পক্ষে সহজ নয়। কিন্তু জামায়াত থেকে মুক্ত না হলে বিএনপির রাজনৈতিক চরিত্র একদিকে যেমন অধিকতর প্রতিক্রিয়াশীল হতে বাধ্য, তেমনি তা তাদের স্বাধীন বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক।
তারা এতদিন যদি জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া না বেঁধে আওয়ামী লীগের মতো তাদের সঙ্গে কৌশলগত মৈত্রী বজায় রেখে চলত, ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানির’ মতো সম্পর্ক রাখত, তাহলে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিকভাবে তারা নিজেদের অবস্থান শক্ত রাখতে পারত। কিন্তু আওয়ামী লীগের থেকে বিএনপির কৌশলজ্ঞান কম। এ কারণে তারা এমনসব বিড়ম্বনায় জড়িত হয়েছে, যা তাদের শক্তি বৃদ্ধিতে বাধা হয়ে আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিএনপি যে ২০১৪ সালের মতো অবস্থায় আজ নেই এটা ঠিক। রাজনৈতিকভাবে তাদের অবস্থান এখন তখনকার থেকে অনেক শক্তিশালী হয়েছে।
সরকার এখন বিএনপির নেত্রীকে যে কারাগারে বন্দি রেখে মোটা চালের ভাত খাওয়াচ্ছে, এ থেকেই এটা বোঝা যায়। কিন্তু এভাবে খালেদা জিয়াকে জেলে আটক রেখে আওয়ামী লীগ যে ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন করবে এ চিন্তা এখন উন্মাদ ছাড়া আর কেউ করতে পারে না।
পরিস্থিতি এখন অনেক বদলে গেছে। বিদেশেও বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি আর আগের মতো নেই। সরকারি দলের জনপ্রিয়তা যে শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের পর একেবারে নিম্ন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, এ খবরও তাদের কাছে আছে। তাদের পত্রপত্রিকাতেও এ বিষয়ে রিপোর্ট এখন প্রকাশিত হচ্ছে। কাজেই ২০১৪ সালে নির্বাচনের সময় বিদেশিদের যে সমর্থন আওয়ামী লীগ পেয়েছিল অথবা আওয়ামী লীগের ভুয়া নির্বাচনকে তারা দেখেও দেখেনি, এবার আর সেটা হওয়ার নয়। এবার তারা চোখ-কান খোলা রেখেছে। তারাও স্পষ্ট ভাষায় বলছে, তারা সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন চায়।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কয়েকটি মেয়র নির্বাচনের সময় দেখা গেল যে, নির্বাচন কমিশন তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও পুলিশ বাহিনীকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত রেখে ভোটারদের অনেক কেন্দ্রে যেতেই দেয়নি।
নিজেরা ভোটের বাক্স ভেঙে, ব্যালট পেপারে সিলছাপ্পর দিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। কেন্দ্রে সরকারি দল ক্ষমতায় থাকায় এভাবে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ পার পেয়েছে। কিন্তু আগামী জাতীয় নির্বাচনে এভাবে হবে না। এমনকি এ নির্বাচন বর্তমান সরকারকে অটুট রেখে, অথবা এই সরকারের স্বার্থের উপযোগী কোনো সর্বদলীয় ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করে হবে না।
সরকারি মুখপাত্ররা বলছেন, বর্তমান জাতীয় সংসদের সদস্যদের নিয়েই নির্বাচনকালীন ‘সর্বদলীয় সরকার’ গঠন করবেন। কিন্তু তার সম্ভাবনা কম বা নেই বললেই চলে। কারণ বিএনপি এই সংসদে নেই এবং বাস্তবত বিএনপি আগামী নির্বাচনে একটা গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। তাদেরকে বাদ দিয়ে কোনো ‘সর্বদলীয় সরকারের’ কথা বলা অবাস্তব কথাবার্তা বলার শামিল। নির্বাচনের নির্ধারিত সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। এখন এসব নিয়ে যদি সরকার বিএনপিসহ অন্যান্য সংসদীয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একটা কার্যকর সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে না পারে, তাহলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে এক মহাসংকটজনক পরিস্থিতি তৈরি হবে, যা সামাল দেয়া কারও পক্ষে সহজ হবে না।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন