জিয়াউর রহমান ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুল থেকে কমিশন পান, ১২তম লং বা দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের একজন সদস্য হিসেবে। তার অন্যতম সতীর্থ (সামরিক পরিভাষায় কোর্সমেইট) ছিলেন সফিউল্লাহ। ১৯৫৫ সালে কমিশন পাওয়ার সময় মেধা তালিকায় জিয়াউর রহমান ছিলেন জ্যেষ্ঠ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জিয়াউর রহমান ও সফিউল্লাহ উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ সময়োচিত নেতৃস্থানীয় ভ‚মিকা পালন করেন; উভয়েই সেক্টর কমান্ডার এবং ফোর্স কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭২ সালের এপ্রিলের কথা। জ্যেষ্ঠ জিয়াউর রহমানকে ডিঙিয়ে বা পাশ কাটিয়ে, সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করা হয়েছিল কনিষ্ঠ সফিউল্লাহকে ও জিয়াউর রহমানকে করা হয়েছিল সেনাবাহিনীর উপপ্রধান। আমার মূল্যায়নে, সে দিন সরকার একটি পেশাগত ও কৌশলগত ভুল করেছিল। তিন বছর চার মাস পর, ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট তৎকালীন মোশতাক সরকার, জিয়াউর রহমানকে সফিউল্লাহর স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন। ততদিনে সফিউল্লাহ সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে তিন বছর চার মাস দায়িত্ব পালন করেছেন। সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আড়াই মাসের মাথায় সংঘটিত হয় ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এর ঐতিহাসিক ঘটনা। জিয়াউর রহমান অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় জড়িত হওয়া শুরু করেন ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখ থেকে। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, ১৯৭৭ সালে নিজে পদত্যাগকরত তৎকালীন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। এই সময় থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত জিয়াউর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে ছিলেন। প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় তিনি শাহাদতবরণ করেন ৩০ মে ১৯৮১।
শোকাবহ ৩০ মে’র সাথে সংশ্লিষ্টতা
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুটি ছিল চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থানকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি অংশ কর্তৃক পরিচালিত বিদ্রোহের ফল (ইংরেজি পরিভাষায় : আফটার ইফেক্ট অব অ্যা মিউটিনি কন্ডাক্টেড বাই অ্যা পার্ট অব দ্য বাংলাদেশ আর্মি লোকেটেড ইন চিটাগং ক্যান্টনমেন্ট)। বিদ্রোহকে সামরিক-ইংরেজি পরিভাষায় মিউটিনি বলা হয়। ১৯৮১ সালের ৩০ মে সংঘটিত চট্টগ্রাম সেনা বিদ্রোহের বা মিউটিনির বিচার হয়েছিল; কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হত্যার কোনো বিচার হয়নি। মিউটিনির বা বিদ্রোহের বিচার হয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আইনের (ইংরেজি পরিভাষায় : বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্ট) ৩১ ধারা মোতাবেক। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আইন মোতাবেক, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ব্যারিস্টার অ্যাডভোকেট তথা আইনজীবী অথবা সেটি সম্ভব না হলে সামরিক অফিসারদের মধ্য থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনকারী কর্মকর্তা (সামরিক আইনের ইংরেজি পরিভাষায় : ডিফেন্ডিং অফিসার) পাওয়ার অধিকার রাখতেন। ২৯ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে ২৫ জনই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার বা মুক্তিযোদ্ধা জুনিয়র কমিশনড অফিসার। অতএব স্বাভাবিকভাবেই, ওই ২৯ জনের আবেদন ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মধ্য থেকেই যেন, কাউকে না কাউকে আত্মপক্ষ সমর্থনকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্তি দেয়া হয়। ১৯৮১ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ মোট তিনজন আত্মপক্ষ সমর্থনকারী কর্মকর্তা (ইংরেজি সামরিক পরিভাষায় : ডিফেন্ডিং অফিসার) নিযুক্ত করতে সম্মত হয়। ১৯৮১ সালের জুন মাসের জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে ওই তিনজন ব্যক্তি ছিলেন : (এক) ১৯৭৩-৭৪ সালে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত আর্টিলারি কোরের অফিসার, ব্রিগেডিয়ার (পরে মেজর জেনারেল) আনোয়ার হোসেন, (দুই) মুক্তিযোদ্ধা, কর্নেল (পরে মেজর জেনারেল) মোহাম্মদ আইনুদ্দিন বীর প্রতীক, (তিন) মুক্তিযোদ্ধা, লেফটেনেন্ট কর্নেল (পরে মেজর জেনারেল) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, তথা এই কলামের লেখক। পাঠক যেন মনে করেন না যে, এই তিনজন ব্যক্তির দায়িত্ব ছিল প্রেসিডেন্ট হত্যা সমর্থন করা। এই তিনজন অফিসারের দায়িত্ব ছিল ২৯ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থন করা; তথা এটা প্রমাণে সহায়তা করা যে, তারা বিদ্রোহের জন্য দায়ী নন বা তারা বিদ্রোহ করেননি। কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে অভিযুক্তদের বিচার হয়েছিল; সেনাবাহিনী আইন (অর্থাৎ বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্ট) মোতাবেকই কোর্ট মার্শালের রায় বাস্তবায়ন হয়েছিল। কিন্তু সেই কোর্ট মার্শাল সম্বন্ধে, সেই কোর্ট মার্শালের পরিচালনা সম্বন্ধে, সেই কোর্ট মার্শালের নিরপেক্ষতা সম্বন্ধে আমার ব্যতিক্রমী মতামত আছে, যেটি আমার বইয়ে লিখেছি (দ্রষ্টব্য ‘মিশ্র কথন’, প্রকাশক অনন্যা, ২০১১ সাল। বইটি এখন ই-বুক হিসেবে পাঠকের জন্য উন্মুক্ত)। স্থানের অভাবে এখানে লিখছি না। কোর্ট মার্শাল (তথা আদালতটি) বসেছিল এবং চলেছিল চট্টগ্রাম মহানগরের লালদীঘির পাড়ে অবস্থিত কারাগারের অভ্যন্তরে। ওই কারাগারেই অভিযুক্ত ২৯ জন বন্দী ছিলেন। ওই ২৯ জনের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হলে ঘটনা সম্বন্ধে জানতেই হবে। জানার নিমিত্তে ওই ২৯ জন অভিযুক্তের সাথে আমরা নিবিড়ভাবে আলাপ করেছিলাম, ওই ২৯ জনের মধ্যে বেশির ভাগেরই পিতা-মাতা, স্ত্রী, ভাই-বোন প্রমুখের সাথেও আমরা কথা বলেছিলাম। আমরা তিনজনের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার আনোয়ার একটু কম জড়িত হয়েছিলেন; কর্নেল আইনুদ্দিন ও লেফটেনেন্ট কর্নেল ইবরাহিম বেশি জড়িত হয়েছিলেন; বেশি কথা শুনেছিলেন; বেশি খবর জেনেছিলেন। আলাপের কারণে তাৎক্ষণিক ঘটনা প্রসঙ্গে এবং তার আগেরও অনেক ঘটনা প্রসঙ্গে আমাদের জানার সুযোগ হয়েছিল। এটা অত্যন্ত বিরল সুযোগ ছিল। আশ্চর্যজনক মনে হলেও বাস্তবতা হলো : ভীতিকর পরিস্থিতিতে আমরা কোনো লিখিত নোট রাখতে পারিনি, যা কিছু জমা রাখার সেটি জমা রেখেছিলাম স্মৃতির মণিকোঠায়। অপ্রিয় বাস্তবতা হলো, কালের পরিক্রমায় অনেক কিছুই আমার স্মৃতিশক্তি থেকে ছুটে যাচ্ছে।
একটি সামরিক দুর্ঘটনার দায়দায়িত্ব
সেনাবাহিনীতে চাকরি করার কারণে, সক্রিয় চাকরি জীবনে, এই ধরনের মিউটিনি ও কোর্ট মার্শাল ইত্যাদি বিষয়ে লেখালেখি কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত ছিল; কিন্তু ঘটনার তিরিশ বছর পর (১৯৮১-২০১১) আমি ‘মিশ্র কথন’ নামক বইটি লিখেছি। বইটি লেখার সময় অনেক কথা যেগুলো অভিযুক্তদের কাছ থেকে জেনেছিলাম সেগুলো উল্লেখ করতে পারিনি। কারণ সেগুলো গবেষকের দৃষ্টিতে বা আইনজীবীর দৃষ্টিতে প্রমাণ করা কষ্টকর; কিন্তু আমার কাছে অতি বিশ্বাসযোগ্য। প্রখ্যাত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ দীর্ঘ দিন গভীর ও বিস্তৃত গবেষণার পর তার বই লিখেছেন ইংরেজি ও বাংলা ভাষায়। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে অনেক ঘটনা আমার বইয়ে আলোচনায় আনিনি; মাহফুজ উল্লাহ তার বইয়ে এনেছেন। সারমর্ম : তৎকালীন (১৯৭৮-মে ১৯৮১) চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পদাতিক ডিভিশনের জিওসি তৎকালীন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর বীর উত্তম চাচ্ছিলেন জিয়াউর রহমানকে কাবু করতে; জেনারেল মঞ্জুরকে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও সুনির্দিষ্ট-পরোক্ষভাবে উৎসাহ জোগাচ্ছিলেন ঢাকায় অবস্থানকারী কয়েকজন ভিভিআইপি বা ভিআইপি ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশের বাইরের কেউ না কেউ। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের দুই-একটি পত্রিকায় এবং অন্যান্য দেশের পত্রিকায় প্রকাশিত বিশ্লেষণমূলক সংবাদে এবং অনেক বাংলাদেশী লেখকের গ্রন্থে এই ধরনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। তিনটি উদাহরণ : (১) বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব এবং ১৯৯১ সালের তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ইমাম উদ্দিন চৌধুরী কর্তৃক লিখিত আত্মজীবনীমূলক পুস্তক; (২) প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘনিষ্ঠ সহচর এবং ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ঘনিষ্ঠ সরকারি সহকর্মী কর্নেল অলি আহমদ বীর বিক্রম কর্তৃক লিখিত পুস্তক; (৩) মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম কর্তৃক লিখিত পুস্তক। তারা তাদের লেখা বইয়ে বা কলামে বা ইন্টারভিউতে এই ধরনের ইশারা দিয়েছেন।
শহীদ জিয়ার মূল্যায়ন
মানুষ মরণশীল; প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও মরণশীল ছিলেন। জীবন ও মৃত্যু মহান আল্লাহ তায়ালার হাতে; এখানে বান্দার হাত রাখার কোনো জায়গা নেই। মানুষ হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কোনো না কোনো দিন মারা যেতেন। পৃথিবীর বহু দেশের বহু রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী বা জাতীয় নেতা দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন। আমাদের দেশে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, পরিবেশগত কারণে শাহাদতবরণ করেছেন। কিন্তু স্মৃতিতে অমর। চট্টগ্রাম মহানগরের ষোলোশহরে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর প্রথম প্রহরেই তিনি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। ২৭ মার্চ তারিখে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে, প্রথমে নিজের নামে ও নিজের দায়িত্বে ঘোষণা করেন। পরে একই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে পুনরায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস যাবৎ সেক্টর কমান্ডার ও ফোর্স কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তথা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। অতঃপর একজন শৃঙ্খলামুখী অফিসার হিসেবে ১৯৭৫-এর ২৪ আগস্ট সকাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে চাকরি করেন। পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনী প্রধান হন। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব টলটলায়মান ছিল তখন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সুদৃঢ়ভাবে, প্রত্যক্ষভাবে সেনাবাহিনীর এবং পরোক্ষভাবে পুরো জাতির হাল ধরেন। তিনি ছিলেন জনগণের হৃদয়ের মানুষ। তিনি ছিলেন কাজের মানুষ। সামরিক শৃঙ্খলাকে, সামরিক আবেগকে তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিয়ে আসেন। তার রাজনৈতিক বিরোধীরা তার সমালোচনা করতেই পারেন; কিন্তু বিশ্লেষণমূলক ব্যক্তিরা বিনা দ্বিধায় বলবেন যে, জিয়াউর রহমান সমন্বয়ের রাজনীতি, সহনশীলতার রাজনীতি, সমঝোতার রাজনীতি ও বহুদলীয় রাজনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। গবেষকগণ স্বীকার করেন যে, তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তৃণমূল মানুষের অংশগ্রহণে বিশ্বাস করতেন, কঠোর শৃঙ্খলায় বিশ্বাস করতেন এবং নিজেকে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে রাখায় বিশ্বাস করতেন। তিনি তরুণ ও মেধাবীদের রাজনীতিতে আগ্রহী করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে তিনি সেনাপতি থেকে রাষ্ট্রনায়ক হয়েছিলেন; তিনি বন্দুকের যোদ্ধা থেকে কোদালের কর্মী হয়ে দেশ গড়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছিলেন। মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর এবং তার সঙ্গীরা নিজেদের প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে, তারা জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে ভুল করেছিলেন।
বহিরাঙ্গন
জিয়াউর রহমানের দূরদৃষ্টিমূলক, রাষ্ট্রনায়কোচিত কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে প্রথম পা রাখে; বাংলাদেশ পৃথিবীর জাতিগুলোর মিলনমেলায় নিজের নাম উজ্জ্বলভাবে প্রস্ফুটিত করে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো, তাৎক্ষণিক প্রতিবেশী অমুসলিম দেশগুলো এবং বিশ্বের নেতৃত্ব প্রদানকারী পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সাথে, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। ইরাক ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল; উভয় পক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ওই যুদ্ধ নিরসনের লক্ষ্যে যে তিন সদস্যের তথা তিনজন রাষ্ট্রপ্রধানের কমিটি করা হয়েছিল, সেই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। সর্বোপরি সবেমাত্র উদীয়মান সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি চীনের সাথে যুগপৎ ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন জিয়াউর রহমান।
ক্রসরোডে বা জংশনে জিয়াউর রহমান
দায়িত্ব নেয়ার পর জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে একাধিক বিষয়ে যথা প্রশাসনিক বিষয়ে, উন্নয়ন বিষয়ে, পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে, সামরিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। তাকে কোনো না কোনো একটি মহাসড়ক বেছে নিতে হয়েছিল। এই কলামের পাঠকের চিন্তার সুবিধার্থে আমি উদাহরণস্বরূপ পাঁচটি অপশন বা বিকল্প যেটি সেই সময়ে জিয়াউর রহমানের সামনে উপস্থিত হয়েছিল সেগুলো এখানে লিখছি। তখন বাংলাদেশের সামনে বেছে নেয়ার জন্য রাস্তাগুলো ছিল নিম্নরূপ : (এক) উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের পরিপূরক সড়ক অথবা, গণতন্ত্র ব্যতীত শুধু উন্নয়নের সড়ক। উল্লেখ্য, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে তত্ত¡ ও অভ্যাসগুলো সেগুলো হলো সততা বা অসততা, নীতি বা দুর্নীতি এবং সংযম অথবা লুটপাট। (দুই) মুসলিম বিশ্বের সাথে যথাসম্ভব সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে বাকি বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপন অথবা মুসলিম বিশ্বকে অবহেলা করে বাকি বিশ্বের সাথে দহরম-মহরম করা। (তিন) বাংলাদেশের তাৎক্ষণিক প্রতিবেশীদের প্রাধান্য দিয়ে বাকি বিশ্বের সাথে সম্পর্ক রাখা অথবা প্রতিবেশীদেরকে অবহেলা করে বাকি বিশ্বের সাথে দহরম-মহরম করা। (চার) শিক্ষানীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদিতে ধর্মীয় মূল্যবোধের উপস্থিতি রাখা অথবা ধর্মীয় মূল্যবোধের উপস্থিতি না রাখা। ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সম্পর্ক নৈতিকতা, সামাজিক আচার-আদবের। (পাঁচ) দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কি বাকশালী তথা একদলীয় তথা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির মডেলটি অব্যাহত রাখা হবে নাকি বহুদলীয় উন্মুক্ত গণতন্ত্র পুনরায় চালু করা হবে? বাংলাদেশ কোন রাস্তাটা বেছে নেবে সেটি নির্ভর করছিল বাংলাদেশের তৎকালীন নীতিনির্ধারকমণ্ডলীর ওপর এবং সেই নীতিনির্ধারকমণ্ডলীর কর্ণধার ছিলেন জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। আমরা এখানে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারছি না স্থান-অভাবে। শুধু দু’টি বিষয় আলোচনা করব; যথা বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সার্ক।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের সিদ্ধান্ত
জিয়াউর রহমান বহুদলীয় রাজনীতিকে বাংলাদেশে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেন, যার ফলে আগে থেকেই পরিচিত বহু রাজনৈতিক দল নব উদ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কাজ শুরু করে। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের আগে তথা সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাকশাল নামক একক রাজনৈতিক দল কায়েমের আগে যে রকম আওয়ামী ছিল, সেই আওয়ামী লীগ পুনরায় কাজ শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগে যে জামায়াতে ইসলামী ছিল, তারা সেই নামে আবিভর্‚ত হতে পারেনি। তাই প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তারা ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লিগ বা আইডিএল নামক দলের মাধ্যমে রাজনীতিতে পুনরায় সক্রিয় হন। কয়েক বছর পর আইডিএল বিলুপ্ত হয় এবং জামায়াতে ইসলামী পুরনো নামে পুনরায় রাজনীতি করা শুরু করেছে। ওই ধারাবাহিকতায় জামায়াতে ইসলামী এখন একটি বিশাল সুসংগঠিত গণতান্ত্রিক দল। বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের ফলে তখন একাধিক নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছিল, যার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তথা বিএনপি। বিএনপি জিয়াউর রহমানের অমর সৃষ্টি। তাই বলা হয়, জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের কয়েকদিন মাত্র ছিলেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট; অতঃপর তিনি হয়ে যান প্রধানমন্ত্রী এবং এভাবে জানুয়ারি ১৯৭৫ পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করেন। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু পুনরায় দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী হন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর, খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশ চালান; মোশতাকই সামরিক শাসন জারি করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন। মোশতাকের অপসারণের পর ৫ নভেম্বর ১৯৭৫ থেকে বিচারপতি সায়েম দেশ চালান। সেই ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমানও রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার অব্যাহত রেখেছিলেন।
সার্ক বা দক্ষিণ এশিয়া সহযোগিতা সংস্থা
সার্ক মানে ইংরেজিতে সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন। বাংলাদেশের জন্মে বা স্বাধীন আবির্ভাবে ভারতের ভ‚মিকা অনস্বীকার্য ও অনবদ্য। স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাবের কারণে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র আকারে ক্ষুদ্র হয়ে যায় এবং ভারতের সাথে পারস্পরিক শক্তির ভারসাম্য পাকিস্তানের বিপক্ষে যায়। অপর পক্ষে বাংলাদেশকে পাশে নিয়ে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত হেভিওয়েট ব্যক্তিত্বে বা শক্তিতে পরিণত হয়। ভারতের প্রভাব বলয় থেকে সসম্মানে বের হয়ে নিজের স্বাধীন সত্তা বিকশিত করার জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তুত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। অপর পক্ষে ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ এবং পারস্পরিক উপকারিতার স্বার্থে ভারতের সাথে বাংলাদেশকে একটি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেই হতো। এই চিন্তাটি ১৯৭৭ বা ১৯৭৮ বা ১৯৮০ সালে যেমন জিয়াউর রহমান মহোদয়ের মানসপটে প্রোথিত ছিল, তেমনই আজো আমি বা আমার মতো আরো কোটি মানুষের মনে প্রোথিত আছে। জিয়াউর রহমান তাই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি সহযোগিতামূলক সংগঠনের চিন্তা উপস্থাপন করেন। জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ নামক প্রতিষ্ঠান তথা থিংক ট্যাংক বা চিন্তার আধার স্থাপিত হয়েছিল। তাদের মাধ্যমেই পররাষ্ট্রনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এরূপ একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা তিনি দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর শীর্ষ রাজনীতিবিদ ও চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গের সামনে সফলভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এরশাদ সরকারের আমলে সার্ক আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সর্বোত্তম উছিলা
যারা জিয়াউর রহমানকে ভালোবাসেন তাদের অনুভ‚তি হলোÑ জিয়াউর রহমান ১৯ দফার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের জন্য একটি ভিশন তুলে ধরেছিলেন। জিয়াপ্রেমিকদের অনুভ‚তি হলোÑ জিয়ার অনুসরণের মধ্যেই বিএনপির সাফল্যের চাবিকাঠি নিহিত। জিয়াউর রহমানের স্মৃতি কারো প্রতিদ্ব›দ্বী নয়, জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক সাফল্য কারো প্রতিদ্ব›দ্বী নয়Ñ এই দু’টি কথা আন্তরিকভাবে মেনে নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কলামের লেখক অর্থাৎ আমি নিজে একজন রাজনৈতিক কর্মী এবং ২০ দলীয় জোটের অংশীদার একটি দলের প্রধান। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে আমি মনে করি, গত তেরো বছর যাবৎ বিএনপি নিজে কিছু ভুল করেছে এটা যেমন সত্য, তার থেকেও অনেক বড় সত্য হলো বিএনপির ওপর নির্যাতন নিপীড়নের খড়গহস্ত নেমে এসেছে। আমি মনে করি, বিএনপিকে ক্ষতিগ্রস্ত বা বিএনপিকে নির্মূল করা মানে, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী ঘরানার রাজনীতিকে ক্ষতি করা বা নির্মূল করা। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি মনে করি ধৈর্যের মাধ্যমে বিচক্ষণতার মাধ্যমে বিএনপির অখণ্ডতাকে সুরক্ষা দিতে হবে; এই কাজে আমি একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক সহযোগী হয়ে নিজেকে সৌভাগ্যমান মনে করি। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শ, রাজনৈতিক ক্যারিশমা ও দেশগঠনের আদর্শের ক্ষতি করার জন্য অতীতে বহু চক্রান্ত হয়েছে; বর্তমানেও যে হচ্ছে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? অতএব সাধু সাবধান!
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন