বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের আঙ্গিকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তারিখের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫; সিপাহি-জনতার বিপ্লব দিবস। সঠিক ইতিহাস জানার স্বার্থে এবং সেই ইতিহাস থেকে উপযুক্ত শিক্ষা (ইংরেজি : লেসন) আহরণের স্বার্থে আমাদের ৭ নভেম্বর প্রসঙ্গে জানা প্রয়োজন। এ জন্য উৎস হচ্ছে ওই আমলে জড়িত ব্যক্তিদের বা সাক্ষীদের মুখের বক্তব্য অথবা লিখিত বই অথবা কলাম। ইতোমধ্যে অনেক কলাম ও বই প্রকাশিত হয়েছে। একটি মাত্র কলামে যেহেতু পূর্ণ ধারণা দেয়া সম্ভব নয় এবং কোনো পাঠক যেন এই তাৎপর্যপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়টিতে আমাকে ভুল না বোঝেন, সেহেতু আমার নিজের লেখা বইয়ের রেফারেন্স এখানে দিচ্ছি। ‘অনন্যা’ নামক প্রখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ২০১১ সালের বইমেলায় প্রকাশিত, ‘মিশ্র কথন’ পুস্তকের পঞ্চম অধ্যায়টির নাম ‘১৯৭৫ : রাজনৈতিক ইতিহাসে বিভাজন রেখা; গ্রন্থের ১৪৬ থেকে ১৯৩ পৃষ্ঠায় নভেম্বরের ঘটনাবলি নিয়েই আলোচনা আছে।
১৫ আগস্ট
পঁচাত্তরের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনাবলির উৎপত্তি বা শিকড়, নভেম্বরেই নিহিত নয়। কিন্তু এর বিস্তারিত আলোচনা, স্থানের অভাবে এখানে সম্ভব নয়; ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে বাকশাল কায়েম হয়েছিল। বাকশালের অষ্টম মাস ছিল আগস্ট। দেশের ভেতরের কিছু অপ্রীতিকর কারণ, দেশের বাইরের কিছু ষড়যন্ত্রমূলক কারণ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সবকিছুর ফলে ঘটেছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড। ১৫ আগস্ট দিনটি শোকাবহ। এর ঠিক পরের অনুচ্ছেদটি এই ১৫ আগস্ট প্রসঙ্গে। ১৫ আগস্টের ঘটনার নায়ক একজন নয়; সংখ্যায় একাধিক এবং একাধিক অঙ্গনের। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যম ও কনিষ্ঠ সারির কিছু অফিসার একটি আঙ্গিকের ও একটি অঙ্গনের নায়ক। অন্য একটি আঙ্গিকের কথা বলি। স্বাধীনতার পূর্বেকার পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর দুই দশকের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও সহচর ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধুর নামের উপর প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ছিলেন খন্দকার মোশতাক। স্বাধীন বাংলাদেশে, প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন কেবিনেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন খন্দকার মোশতাক। এই মোশতাকসহ বেশ কিছু সংখ্যক আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ছিলেন আরেকটি আঙ্গিকের নায়ক বা নায়কমণ্ডলী। দেশের বাইরের নায়কদের নামও এতদিনে সবার প্রায় জানা হয়ে গিয়েছে। যা হোক, আমরা একটি দিন তথা ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর নিয়ে এখানে আলোচনা করছি।
১৫ আগস্ট পরবর্তী ডায়লেমা
আমরা ১৯৭৫-এর কথা বলছি। ওই আমলের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও অর্থাৎ ’৭৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ অংশ বা সেনাবাহিনীর উচ্চতম পর্যায়ের অফিসাররা ব্যস্ত এবং তৎপর ছিলেন তাদের ওই সব সদস্যকে নিয়ে, যারা ১৫ আগস্টের সাথে জড়িত ছিলেন। ওই আমলের সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ এবং মধ্যম সারির বেশির ভাগ কর্মকর্তার চিন্তা ছিল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারদের ভেঙে যাওয়া চেইন-অব-কমান্ডকে জোড়া লাগানো বা পুনঃস্থাপন করা। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, কেন? যেহেতু ১৫ আগস্টের ঘটনায় জড়িত অফিসাররা, তাদের উপরস্থ জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের অনুমতি ছাড়াই গিয়েছিলেন, তাদের কী হবে, এটাই ছিল বিবেচ্য বিষয়। আগস্টের ২৪ তারিখ থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নবনিযুক্ত প্রধান ছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। সেনাবাহিনী অত্যন্ত ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছিল। ১৯৭২ সালের শুরুতেই সৃষ্টি করা এবং ক্রমান্বয়ে আকৃতি ও ক্ষমতায় বর্ধিষ্ণু হওয়া, জাতীয় রক্ষীবাহিনী বা জেআরবি নামক সংগঠনটিকে জিয়াউর রহমানের আনুষ্ঠানিক সুপারিশেই, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ভেঙে দেয়া হয়নি বা বাতিল করা হয়নি বরং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যেই বা সেনাবাহিনীর ভেতরে একীভূত বা আত্মীকৃত করে ফেলা হয়েছিল। উল্লেখ্য, জাতীয় রক্ষীবাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য রণাঙ্গনের তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন; কেউ কেউ বিএলএফের সদস্য ছিলেন, কেউ কেউ গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন। জাতীয় রক্ষীবাহিনী প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত প্রদানকারী ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরে যেসব স্টাফ অফিসার কাজ করছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ছিলাম আমি, তখনকার আমলের মেজর সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। ওই সুবাদে বলছি যে, সময় খুব ব্যস্ত ছিল এবং ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ ছিল। এর মধ্যে চাপা অবস্থায় বিরাজমান ছিল একটি দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বটি কী? দ্বন্দ্বটি হলো, যারা ১৫ আগস্ট সংঘটিত করে ফেলেছে তারা কোথায় যাবে কোন অবস্থায় থাকবে, কোন দায়িত্বে থাকবে? নাকি, তাদের দ্বারা কৃত কর্মটিকে শৃঙ্খলা ভঙ্গ বিবেচনা করে সেটির বিহিত করা হবে? সমাধান পাওয়া যাচ্ছিল না; ঐকমত্য সৃষ্টিতে বিলম্ব হচ্ছিল।
খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান
এরূপ পরিস্থিতিতেই অর্থাৎ কী নিয়মে চেইন অব কমান্ড ফেরত আনা যায় বা কী নিয়মে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করা যায়, এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ অফিসারদের মধ্যে আলোচনা চলছিল। আলোচনা করতে গেলেই মতের ঐক্য হতে পারে আবার মতের অনৈক্যও হতে পারে এবং এটাই হচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে, ওই আমলের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরে কর্মরত, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সাহসী যুদ্ধাহত সেক্টর কমান্ডার, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের নেতৃত্বে একটি প্রতিবাদী কর্মকাণ্ড (অথবা কারো কারো দৃষ্টিতে সংশোধনমূলক কর্মকাণ্ড) সংঘটিত হয়। সামরিক পরিভাষায় বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় এটি ছিল একটি কু-দ্যাতা। বাংলায় বলা যেতে পারে সামরিক অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানটিতে প্রধান সহায়ক শক্তি ছিলেন তৎকালীন ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থানকারী ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম, তার ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার-এর একাধিক অফিসার এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঢাকায় অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা পাইলটগণের কয়েকজন। শাফায়াত জামিলের অধীনস্থ তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়নের মধ্যে সবাই এই বিদ্রোহের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেনি। আমি যেহেতু তখন কোনো ব্যাটালিয়নের সঙ্গে চাকরি করি না, তাই এসব কর্মকাণ্ড বা পরিকল্পনা থেকে দূরেই ছিলাম। অভ্যুত্থানের অংশ হিসেবে খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের নির্দেশে, ৪৬ ব্রিগেডের পক্ষ থেকে অফিসার ও সৈনিকরা গিয়ে, খালেদ মোশাররফের উপরস্থ কর্মকর্তা তথা ওই মুহূর্তের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে গৃহবন্দী করেন ও তাকে বাধ্য করেন পদত্যাগ করতে। অভ্যুত্থানের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন সরকারের পরিকল্পনায় ও হুকুমে, সশস্ত্র ব্যক্তিদের সহযোগিতায়, অতি গোপনে ৩ নভেম্বর রাতে, ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলখানায় বন্দী অবস্থায় থাকা চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। এই খবর তাৎক্ষণিক জানাজানি হয়নি বরং এক-দু’দিন বিলম্বে জানাজানি হয়েছিল। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের ফলে তথা অভ্যুত্থানকারীদের পরিকল্পনায়, খন্দকার মোশতাক আহমদকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারিত করে, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়েছিল; মোশতাকের জারি করা সামরিক শাসন অব্যাহত রাখা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ৩, ৪ ও ৫ এই তিন দিন, সরকারি কর্মকর্তারা বা আমলাতন্ত্র ছিল কিন্তু প্রচলিত অর্থে কোনো সরকার ছিল না। ওই আমলের (অর্থাৎ ৪, ৫, ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখের) পত্রিকা ঘাঁটলে বিরাজমান শাসনতান্ত্রিক সঙ্কটের একটি সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে; স্থানাভাবে এখানে আর বিস্তারিত লিখছি না। ঢাকা মহানগরে ৪ ও ৫ নভেম্বর সংঘটিত লঘুমাত্রার কিছু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের তথা রাজনৈতিক লক্ষণের কারণে, খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানটি রাজনৈতিক অঙ্গনে, সচেতন জনগণের মনের ভেতরে এবং সৈনিকদের মনের ভেতরে একটি ভারতপন্থী অভ্যুত্থান হিসেবে রঙ পেয়েছিল। ফলে সচেতন জনগণ ও সৈনিকরা এই অভ্যুত্থানকে পছন্দ করেনি। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি মোটামুটি স্পষ্ট হয়েছিল; কিন্তু ততদিনে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা, লে. কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তমের মতো কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধারা ‘বিগত’ হয়ে গিয়েছেন।
৭ নভেম্বরের তাৎক্ষণিক প্রেক্ষাপট
৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ঘটনার পর, আরেকটি গোপন গোষ্ঠী সক্রিয় হয়। ১৯৭৩-এর শেষাংশ থেকে, তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে একটি গোপন সংগঠন কাজ করত। সংগঠনটির নাম ছিল ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’। এই প্রসঙ্গে এই কলামে বিস্তারিত কোনোমতেই লেখা সম্ভব নয়। তাই এই কলামের প্রথম অনুচ্ছেদে যে বইটির নাম দিয়েছি, সেই বইটির সংশ্লিষ্ট অধ্যায় পড়ার জন্য অনুরোধ করছি। এই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সাথে যোগাযোগ ছিল সেনাবাহিনীর বাইরের একটি সংগঠন, যথা জাসদ নামক রাজনৈতিক দলের একটি অঙ্গসংগঠন, যার নাম ছিল গণবাহিনী। জাসদ নামক রাজনৈতিক দলের আনুষ্ঠানিক নেতারা ছাড়াও আরো একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন জাসদের গণবাহিনীর প্রধান, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, অন্যতম মেধাবী সাহসী সেনা কর্মকর্তা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এম এ তাহের বীর উত্তম। জাসদ, জাসদের গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা চাচ্ছিল একটি বড় রকমের বিপ্লব হোক। ওই বিপ্লবের লক্ষ্যবস্তু কোনোমতেই আমাদের পরিচিত গণতন্ত্রের সম্পূরক নয় ও সুশৃঙ্খল সামরিক বাহিনী রক্ষণাবেক্ষণের সম্পূরক ছিল না। তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা নীরবে কাজ করছিল অনেক দিন ধরেই। ৩ নভেম্বরের ঘটনা ঘটে যাওয়ায় তারা সবাই অস্থির হয়ে পড়ল এবং মনে করল ‘আবার কোন্ অপরিকল্পিত ঘটনা হঠাৎ এসে তাদের বিপ্লবের পক্ষে বাধার সৃষ্টি করে।’ তাই, তারা স্থির করল ৭ নভেম্বর তাদের কাজটি করে ফেলবে। তাদের মধ্যে যারা চরমপন্থী ছিল বা উগ্রপন্থী ছিল তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে, সেনাবাহিনী হতে হবে অফিসারমুক্ত। তারা ঘোষণা দিলো, ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই।’ চলমান ২০২১ সালে, এই কলামের যেকোনো তরুণ পাঠকের পক্ষে, তিনি যে পেশারই হোক না কেন, ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের এবং ঢাকা মহানগরের বাসিন্দাদের মন-মানসিকতা কিরূপ অস্থির ছিল, আবেগ কী পরিমাণ স্ফীত ছিল এবং চিন্তাশক্তি কী পরিমাণ উত্তেজনাপূর্ণ ছিল, সেটি কল্পনা করা বা হৃদয়ঙ্গম করা অনেক কঠিন কাজ।
সৈনিক বিপ্লব অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল
ঠিক একই সময়ে, অর্থাৎ ৩ নভেম্বরের পরপর দিনগুলোতে, সেনাবাহিনীর মধ্য ও নিম্নস্তরে প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে আলোচনা ও চিন্তা চলছিল, জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে হবে। জিয়াউর রহমানকে বন্দী করা হয়েছিল, এই কাজটিকে সাধারণ সৈনিকরা কোনোমতেই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি; সাধারণ সৈনিকরা বেদনাহত হয়েছিলেন। বলাই বাহুল্য, জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের আমল থেকেই বিবিধ কারণে দেশবাসীর কাছে সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে, যথাক্রমে সেনাবাহিনী প্রধান বা উপপ্রধান নিযুক্ত হওয়ার কিছু দিন পর, সফিউল্লাহ এবং জিয়াউর রহমান উভয়েই মেজর জেনারেল হন। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত হিসাব করলে, মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ তিন বছর সাড়ে চার মাস দায়িত্ব পালন করেছিলেন। নভেম্বরের ৩ তারিখে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করার সংবাদ এবং পদত্যাগে বাধ্য করার সংবাদ যখন এক-দুই-তিন-চার কান হয়ে মানুষের মুখে মুখে পুরো সেনাবাহিনীতে ছড়িয়ে পড়ল, তখন সাধারণ সৈনিকরা বা সাধারণ অফিসাররা এই সংবাদকে ব্যথিতচিত্তে গ্রহণ করেছিল। এটুকু না বললে, ৭ নভেম্বরের প্রেক্ষাপট স্বচ্ছ হতো না বিধায় স্থানের টানাটানি সত্ত্বেও এই কলামে বললাম।
সৈনিক ও জনতার বিপ্লব
খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারের নিয়ম মোতাবেক, ৬ নভেম্বর দিনের শেষে রাত ১২টায় তারিখ বদলে যায় এবং নতুন দিন তথা ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ শুরু হয়। সৈনিকদের বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই সৈনিকদের বিপ্লবটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়। একটি অংশ ছিল অরাজনৈতিক মনোভাবসম্পন্ন নিখাদ বাংলাদেশ প্রেমিক সৈনিকরা। আরেকটি অংশ ছিল জাসদের প্রভাবান্বিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য ও অনুসারীরা। ঘণ্টা তিন-চারেকের মধ্যেই ঢাকা মহানগরের জনগণ জড়িত হতে থাকে। সূর্য উদয়ের ঘণ্টাখানেক আগে থেকেই, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈনিকরা মহানগরে ছড়িয়ে পড়তে থাকেন। বিপ্লব শুরু হওয়ার পরবর্তী কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন অংশে, একাধিক অফিসার ও অফিসারের পত্নী বিদ্রোহী বা বিপ্লবী সৈনিকদের হাতে লাঞ্ছিত বা নিহত হন। তবে কেউ তাৎক্ষণিকভাবে হত্যাকারীদের বা লাঞ্ছনাকারীদের চিহ্নিত করতে পারেননি। মধ্যরাতের এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যেই অরাজনৈতিক শান্তিপ্রিয় সৈনিকরা জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসভবনের সামনে ও পাশে অবস্থান নেন এবং ‘জিয়াউর রহমানের মুক্তি চাই, জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতে হবে’ এরূপ কথা বলে সরব হন। একই সময়ে একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। যেসব সৈনিক ৩ নভেম্বরের প্রথম প্রহর থেকে গৃহবন্দী জিয়াউর রহমানের বাড়ি পাহারা দিচ্ছিলেন, সেসব সৈনিকও সবার সঙ্গে আত্মা ও কণ্ঠ মিলিয়ে জিয়াউর রহমানের মুক্তির জন্য অস্থির হয়ে পড়েন।
ব্যক্তিগত সংশ্লিষ্টতা
১৯৭৫ সালের নভেম্বরের কথা। তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরের সামরিক সচিবের শাখায় মেজর র্যাংকে চাকরি করতাম অর্থাৎ আমি ছিলাম সেনাসদরে কর্মরত একজন স্টাফ অফিসার। আমার তাৎক্ষণিক উপরস্থ কর্মকর্তা ছিলেন তখনকার আমলের কর্নেল এ এস এম নাসিম বীর বিক্রম (পরবর্তীতে সেনাপ্রধান)। আমি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ৫ ও ৬ নভেম্বরের এই দু’দিন ছুটি নিয়েছিলাম এবং ৫ নভেম্বর তারিখে অতি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল, ঢাকার বাইরে বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার মুড়াপাড়া গ্রামে। ৬ নভেম্বর মাগরিবের সময় আমি ঢাকা সেনানিবাসে ফেরত আসি এবং এসেই মুখে মুখে শুনতে পাই যে, আজ রাতে বিপ্লব হবে এবং অফিসারদের ‘কল্লা’ যাবে। ৬ নভেম্বর দিবাগত রাতে তথা ৭ নভেম্বরের শূন্য ঘণ্টায় চতুর্দিকে গোলাগুলির গগনবিদারী শব্দ দিয়ে যখন বিপ্লব শুরু হলো, তখন আমি ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিই যে, বেঘোরে প্রাণ হারানো যাবে না বরং ইতিবাচক ভ‚মিকা রাখতে হবে। তখন আমি আমার মুক্তিযুদ্ধকালীন ব্যাটালিয়ন, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে উপস্থিত হই। সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখতে পাই যে, ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম চৌধুরী এবং ক্যাপ্টেন এনামুল হক নামক দু’জন অফিসার আগে থেকেই ডিউটি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকরা কোনো কিছুর সাতে-পাঁচে ছিলেন না। কিন্তু ৭ তারিখের প্রথম প্রহর তথা রাত একটা-দেড়টা থেকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাপন্থী অর্থাৎ বিপ্লবী সৈনিকরা, শান্তিপ্রিয় শৃঙ্খলাপন্থী দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থানের তিন দিক থেকে বৈরী প্রচারণা এবং আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে শুরু করে। উপস্থিত জ্যেষ্ঠতম অফিসার হিসেবে আমি পুরো ব্যাটালিয়নকে নিয়ন্ত্রণে রাখি। জাসদপন্থী বিপ্লবী সৈনিকরা যেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সীমানার ভেতর অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করি। কোনো অবস্থাতেই যেন, যে যে পন্থীই হোক না কেন, সৈনিকে-সৈনিকে পারস্পরিক গোলাগুলি বিনিময় না হয়, সেটি নিশ্চিত করার জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করি। সূর্য উদয়ের পূর্বেই, দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকদের মিছিলে যেতে সহায়তা করি। জাসদপন্থী সৈনিকদের ও জাসদ কর্মীদের বিপ্লব, সূর্য উদয়ের ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই, পানিতে যেমন চিনি গলে যায় ঐভাবে বিলীন হয়ে যায়। জীবন্ত ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে শান্তিপ্রিয় সৈনিকের এবং হাজার হাজার জনগণের সম্মিলিত বিপ্লব। সেই অবধি এই দিনের নাম হয়েছে সৈনিক জনতার বিপ্লব বা সিপাহি জনতার বিপ্লব বা বিপ্লব ও সংহতি দিবস। যেহেতু ৭ নভেম্বর বিপ্লব শুরু হওয়ার পরপরই বা সূর্য উদয়ের পরই কয়েকজন জ্যেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা এ দিন নিহত হয়েছিলেন, সে জন্য একাধিক রাজনৈতিক দল এই দিনটিকে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস বলে।
বিপ্লবোত্তর চ্যালেঞ্জগুলো
৭ নভেম্বর পরবর্তী সেনা নেতৃত্বের সামনে অনেক প্রকারের চ্যালেঞ্জ ছিল। ৭ নভেম্বরের বিকেল থেকেই পরবর্তী দেড়-দু’দিনের চ্যালেঞ্জ ছিল, বিপ্লবে ব্যর্থ জাসদের কর্মীদের নিরাপদ দূরত্বে রাখা; চ্যালেঞ্জ ছিল সৈনিকদের হাতে হাতে ঘোরা সৈনিকদের অস্ত্রগুলো অস্ত্রাগারে ফেরত আনা; চ্যালেঞ্জ ছিল পথে পথে ঘুরছে এমন সৈনিকদের নিজেদের ব্যারাকে ফেরত আনা। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান অন্য জ্যেষ্ঠ অফিসারদের সহায়তায় দৃঢ় মনোভাব ও বক্তব্যের মাধ্যমে, সৈনিকদের ওপর অফিসারদের নিয়ন্ত্রণ পুনঃস্থাপনের কাজটি শুরু করেন। সৈনিকরা যেন অস্ত্র জমা দেয় সেটি নিশ্চিত করেন। সৈনিকদের মনের ভেতরে পুঞ্জীভ‚ত কষ্টগুলো দূর করার জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, মাত্র দু’দিনের পুরনো যথা ৫ নভেম্বর তারিখ বিকেলে নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। কোনো মন্ত্রিসভা ছিল না। ওই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট সায়েম বাংলাদেশ কিভাবে পরিচালনা করতেন বা করছিলেন, সেটি গবেষণার একটি বিষয়। কঠোর ও গভীর গভার্নেন্স ক্রাইসিস থেকে বাংলাদেশ রক্ষা পেয়েছিল সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। উদারভাবে মূল্যায়ন করলে এটি বলাই যায় যে, একান্তভাবেই হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করেছিল ওই আমলের নেতৃত্ব।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন